বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহত এক শিক্ষার্থীকে নিয়ে যাচ্ছেন কয়েকজন। ৩ আগস্ট কুমিল্লার পুলিশ লাইনস এলাকায়
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহত এক শিক্ষার্থীকে নিয়ে যাচ্ছেন কয়েকজন। ৩ আগস্ট কুমিল্লার পুলিশ লাইনস এলাকায়

ছাত্র-জনতার আন্দোলন: নিহত শিশু-কিশোরের সংখ্যা বেড়ে ৮৯

৭৯ শিশু-কিশোরের শরীরে ছররা ও প্রাণঘাতী গুলির চিহ্ন ছিল। যানবাহন ও স্থাপনায় দেওয়া আগুনে মৃত্যু ৯ জনের।

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন, সরকারের পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ ও পরবর্তী সহিংসতায় নিহত শিশু-কিশোরের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে অন্তত ৮৯। এর আগে ১৮ আগস্ট প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে প্রথম আলো ৭০ শিশু-কিশোরের মৃত্যুর তথ্য দিয়েছিল।

নতুন করে যাঁদের মৃত্যুর তথ্য সংযোজন করা হয়েছে, তাঁদের কেউ কেউ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। কারও কারও মৃত্যুর খোঁজ পরে পাওয়া গেছে।

নিহত শিশু-কিশোরেরা

প্রথম আলোর হিসাবে ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থান ও পরবর্তী সময়ে মোট ৭৫৮ জনের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে ১৬ জুলাই থেকে ৩ আগস্ট পর্যন্ত মারা গেছেন ৩৪১ জন। ৪ থেকে ২৪ আগস্টের মধ্যে মারা গেছেন ৪১৭ জন।

বিক্ষোভ দমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ছররা ও প্রাণঘাতী গুলি, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের হামলা ও গুলি এবং সরকার পতনের পর হামলা–অগ্নিসংযোগে শিশু-কিশোরের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।

নিহত কিশোরদের মধ্যে বেশির ভাগই বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিল। তবে শিশু-কিশোরদের কেউ কেউ বাসায় ও বাসার ছাদে খেলতে থাকা অবস্থায়, বাসা থেকে বিক্ষোভ দেখার সময় এবং মা–বাবার সঙ্গে বিজয় মিছিলে যোগ দিতে গিয়ে নিহত হয়েছে।

পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়া আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র শাহারিয়ার খান আনাস (১৬) ৫ আগস্ট বাড়িতে চিঠি লিখে চলে যায় বিক্ষোভে। চিঠিতে সে লেখে, ‘মা, আমি মিছিলে যাচ্ছি। নিজেকে আর আটকে রাখতে পারলাম না। মৃত্যুর ভয়ে স্বার্থপরের মতো ঘরে বসে না থেকে সংগ্রামে নেমে গুলি খেয়ে বীরের মতো মৃত্যু অধিক শ্রেষ্ঠ।’

৫ আগস্ট রাজধানীর চানখাঁরপুলে গুলিতে নিহত হয় আনাস। তার লেখা চিঠিটি প্রথম আলোকে দিয়ে বাবা সাহরিয়া খান বলেন, দেশের মানুষ আনাসকে জানুক। কতটুকু দেশপ্রেম থাকলে সে এভাবে প্রস্ততি নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যায়।

নিহত ৮৯ শিশু-কিশোরের তালিকা

৮৯% মৃত্যু গুলিতে

শিশু আইন ২০১৩ অনুসারে, ১৮ বছরের কম বয়সীদের শিশু বলা হয়। প্রথম আলো যত মৃত্যুর খোঁজ পেয়েছে, তা বিশ্লেষণ করে ৮৯ শিশু-কিশোরের তথ্য পাওয়া গেছে।

হাসপাতালের নথি ও স্বজনদের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৭৯ শিশু-কিশোরের শরীরে ছররা ও প্রাণঘাতী গুলির চিহ্ন ছিল। স্থাপনা ও যানবাহনে দেওয়া আগুনে পুড়ে মারা গেছে ৯ শিশু-কিশোর। একটি শিশুর মৃত্যু সাউন্ড গ্রেনেডের স্প্লিন্টারের আঘাতে হয়েছে।

নিহত শিশুদের মধ্যে সবচেয়ে কমবয়সী শিশুটির নাম আবদুল আহাদ (৪)। সে তখনো স্কুলে যাওয়া শুরু করেনি। ২০ জুলাই রাজধানীর রায়েরবাগে ৮ তলা ভবনের বারান্দা থেকে মা–বাবার সঙ্গে বিক্ষোভ দেখার সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় সে। নিহত শিশু-কিশোরদের মধে৵ দুটি মেয়েশিশুও রয়েছে। তারা হলো নারায়ণগঞ্জের রিয়া গোপ (৬) ও উত্তরার নাঈমা সুলতানা (১৫)। রিয়া বাসার ছাদে ও নাঈমা বারান্দায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়।

মানুষের বিক্ষোভ দমন করতে হত্যার ঘটনাকে ‘জঘন্যতম ও মানবতাবিরোধী অপরাধ’ বলে উল্লেখ করেন জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের সভাপতি এবং সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, হত্যার ধরন দেখেই বোঝা যায়, আতঙ্ক সৃষ্টি করার জন্য মানুষকে লক্ষ্য করে গুলি করা হয়েছে। এ ঘটনাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অন্তর্ভুক্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের কঠোর শাস্তি দেওয়া প্রয়োজন। সরকারের উচিত নিহত ও আহত ব্যক্তিদের পরিবারের পাশে দাঁড়ানো।

ঢাকায় বেশি

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকে কেন্দ্র করে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে গত ১৬ জুলাই। ওই দিন ছয়জন নিহত হন। তাঁদের মধ্যে শিশু-কিশোর ছিল না। শিশু-কিশোর মৃত্যুর প্রথম ঘটনা ঘটে ১৮ জুলাই। ওই দিন থেকে ৪ আগস্ট পর্যন্ত নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে অন্তত ৫৬ জন শিশু-কিশোর। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। ওই দিন থেকে ১১ আগস্টের মধ্যে কমপক্ষে আরও ৩৩ শিশু-কিশোর নিহত হয় বলে তথ্য পাওয়া যায়।

বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৫৭ শিশু-কিশোর ঢাকায় (সাভার, টঙ্গীসহ) নিহত হয়েছে। ঢাকার বাইরে মারা গেছে ৩২ জন।

শিশু-কিশোরের মৃত্যু ও মৃত্যুর সময়

নিহত শিশু-কিশোরের মধ্যে ৪২ জন শিক্ষার্থী। ২৯ শিশু-কিশোর শ্রমে যুক্ত। তাদের কেউ দোকানের কর্মী, ফুটপাতের বিক্রয়কর্মী, পোশাককর্মী, নির্মাণশ্রমিক বা হকার। চারজন শিশু-কিশোরের নাম-পরিচয় জানা যায়নি। ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তাদের মরদেহ ছিল। বাকি ১৭ শিশু-কিশোরের পেশা জানা যায়নি। একটি শিশু (আহাদ) স্কুলে যাওয়া শুরু করেনি।

রাজধানীর রামপুরার মো. মস্তফা জামান সমুদ্র (১৬) এ বছর এসএসসি পাস করেছে। গত ১৯ জুলাই বিক্ষোভে যায় সে। সেখানে পাঁজরে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়। তার বাবা মনিরুজ্জামান তাজল প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা জানতেনও না সমুদ্র বিক্ষোভে অংশ নিচ্ছে। পরে ছেলের বন্ধুদের কাছে শুনেছেন, ১৬ জুলাই থেকে বিক্ষোভে যাচ্ছিল সমুদ্র।

মনিরুজ্জামান বলেন, ‘বিজয় তো এল। আমার ছেলের তা দেখা হলো না।’

বিচারে অগ্রাধিকারের তাগিদ

বাংলাদেশে কোনো আন্দোলন ও বিক্ষোভে এত মানুষের মৃত্যু কখনো ঘটেনি। শিশু-কিশোরের এত মৃত্যুও দেখা যায়নি।

ছাত্র আন্দোলনের সময়ে শিশু-কিশোর হত্যার বিচার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শুরু করার ওপর জোর দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সারা হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অনেক শিশু-কিশোর হত্যার ঘটনার ভিডিও চিত্র ধারণ করা আছে মানুষের মুঠোফোনে। অনেক ভিডিও ইতিমধ্যে ইন্টারনেট জগতে ছড়িয়েছে। যাচাই করা এসব ভিডিও, তথ্য, সাক্ষীসহ অন্যান্য সাক্ষ্য–প্রমাণ দিয়ে হত্যার ঘটনা প্রমাণ করা যাবে। তিনি বলেন, স্বজন হারানো পরিবারের ওপর ছেড়ে না দিয়ে ওই সব তথ্য–প্রমাণ নিয়ে রাষ্ট্রের এখনই মামলা করা উচিত, অন্তত দু–একটি হলেও। এতে মানুষের আস্থা বাড়বে।

সারা হোসেন আরও বলেন, শুধু হত্যার হুকুমদাতা বা প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন পর্যায় থেকে বিক্ষিপ্তভাবে মামলা করলে তা ঝুলে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তবে হুকুমদাতাকেও ছেড়ে দেওয়া যাবে না।