বিজয় বইমেলা মঞ্চে বদরুদ্দীন উমর ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে নিজের লেখা বই সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরেন। বাংলা একাডেমির উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ, ১৫ ডিসেম্বর।
বিজয় বইমেলা মঞ্চে বদরুদ্দীন উমর ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে নিজের লেখা বই সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরেন। বাংলা একাডেমির উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ, ১৫ ডিসেম্বর।

বিজয় বইমেলায় বদরুদ্দীন উমর

দেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতির বিবর্তন লেখায় তুলে ধরেছি

বিশিষ্ট লেখক ও সমাজচিন্তক বদরুদ্দীন উমর বলেছেন, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন কেবল শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্যে সীমিত ছিল না। এর সঙ্গে সারা দেশের প্রান্তিক মানুষ, বিশেষ করে শ্রমজীবী ও কৃষকেরা গভীরভাবে যুক্ত ছিলেন। ভাষা আন্দোলন নিয়ে গবেষণা করতে তিনি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মাঠপর্যায়ে কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি জানতে পেরেছেন। বিষয়টিকে তিনি তাঁর ‘পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’ বইয়ে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমার লেখায় দেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতির বিবর্তনের রূপটি তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।’

আজ রোববার সন্ধ্যায় বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে প্রথমা প্রকাশন আয়োজিত বিজয় বইমেলা মঞ্চে নিজের লেখালেখি সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বদরুদ্দীন উমর ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে নিজের লেখা এই বই সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ভাষা আন্দোলন নিয়ে আগে কোনো বিস্তারিত গবেষণামূলক বই ছিল না। ফলে তিনি আন্দোলনে সরাসরি অংশগ্রহণকারী নেতাদের সাক্ষাৎকার, বিভিন্ন প্রচার পুস্তিকা, লিফলেট সংগ্রহ করেছেন। পরে মাঠপর্যায়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে কৃষক শ্রমিকের সংযুক্তির বিষয়টি জেনেছিলেন।

বদরুদ্দীন উমর বলেন, ভাষা আন্দোলনে শহরের শিক্ষিত শ্রেণি ও ছাত্ররাই মূলত অংশগ্রহণ করেছে বলে সবার একটি ধারণা ছিল। কিন্তু মাঠের তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে তাঁর এই প্রচলিত ধারণা ভেঙে যায়। ফলে বইটি প্রথমে দুটি খণ্ডে লেখার পরিকল্পনা থাকলেও পরে আরেকটি খণ্ড লিখতে হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে ভাষা আন্দোলনে কৃষক ও মেহনতি মানুষের অংশগ্রহণের বিষয়টি ইতিহাসে যুক্ত হয়েছে।

লেখক বদরুদ্দীন উমরের বক্তৃতা শুনতে তাঁর অনেক অনুরাগী উপস্থিত হয়েছিলেন

লেখক বদরুদ্দীন উমরের বক্তৃতা শুনতে তাঁর অনেক অনুরাগী উপস্থিত হয়েছিলেন। প্রবীণ এই লেখক ৯৩ বছর বয়সে রয়েছেন। প্রথমেই তিনি বলে নিলেন তাঁর শ্রবণে ঘাটতি আছে। তবে যখন বলা শুরু করলেন, তখন শ্রোতারা বিস্ময়ে অনুভব করলেন, তাঁর স্মৃতিতে কোনো ঘাটতি তো নেই–ই বরং তা যেন তাঁর তারুণ্যের মতোই প্রখর। আর কণ্ঠস্বরও সুস্পষ্ট। সেই নবম–দশম শ্রেণিতে লেখালেখির কথা দিয়ে শুরু করে ২০১৯ সালে এসে বিরক্ত হয়ে লেখা বন্ধ করে দেওয়া অবধি নানা তথ্য, বিবিধ ঘটনা, অনেক মানুষের সান্নিধ্য, সহযোগিতার স্মৃতির পাতা এমন করে উল্টে গেলেন, যেন মনে হলো গতকাল মাত্র তাঁদের সঙ্গে দেখা করে এসেছেন।

বদরুদ্দীন উমর বললেন, বিগত দেড় দশক শেখ হাসিনার শাসন ছিল ভয়ানক ফ্যাসিবাদের শাসন। তাঁর পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনও ছিল সাংঘাতিক ফ্যাসিবাদী ধরনের। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত তাঁর শাসন নিয়ে কেউ প্রকৃত আলোচনা করেন না। ১৯৭২ সালের আগে তিনি কী করেছেন, সেসব নিয়েই সবাই আলোচনা করেন। তবে তিনি বরাবরই কড়া ভাষায় শেখ মুজিবুর রহমানের সময়ের সমালোচনা করেছেন। তখন হলিডে পত্রিকায় তা নিয়মিত ছাপা হয়েছে। হলিডে সম্পাদক এনায়েত উল্লাহ খানকে তিনি দেশের সাহসী সম্পাদক হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, অনেক সম্পাদক বলেছেন, লেখাটির এখানে বাদ দেন, ওখানে সংশোধন করেন। এভাবে লিখতে তিনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না। শেষে বিরক্ত হয়ে ২০১৯ সাল থেকে লেখাই ছেড়ে দিয়েছেন।

সমসাময়িক বিষয় ও রাজনৈতিক বিশ্লেষণ নিয়ে লেখালেখি করলেও তাঁর লেখাগুলো মূলত সাংবাদিকের দৃষ্টিতে লেখা নয়। উমর বলেন, তাঁর লেখা বরং ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে ঐতিহাসিকের দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা। ফলে এসব লেখায় দেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য ও ক্রমবিবর্তনের বিষয়গুলো পাওয়া যাবে। লেখালেখির পাশাপাশি রাজনীতিতে সক্রিয় থেকেছেন। ৫০ বছর ধরে ‘সংস্কৃতি’ নামে সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি বিষয়ে পত্রিকা প্রকাশ করছেন। বহুমাত্রিক কর্মময় জীবনের অনেকটাই একঝলকে শ্রোতাদের কাছে উপস্থাপন করে বললেন, ‘অনেক তো বললাম। ক্লান্ত লাগছে, এখন থামি।’

অনুষ্ঠানের শুরুতে প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক কবি সোহরাব হাসান বদরুদ্দীন উমরের জীবন ও কর্ম নিয়ে আলোচনা করেন

অনুষ্ঠানের শুরুতে প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক কবি সোহরাব হাসান বদরুদ্দীন উমরের জীবন ও কর্ম নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি বলেন, বদরুদ্দীন উমর কখনো নীতি ও আদর্শের প্রশ্নে আপস করেননি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছেড়েছেন আদর্শের জন্যই। স্পষ্ট কথা বলতে চেয়েছেন, সেটা পেরেছেন। ২০ ডিসেম্বর লেখক বদরুদ্দীন উমরের জন্মদিন, তিনি ৯৪ বছরে পা দেবেন। এই ঘোষণায় শ্রোতারা করতালি দিয়ে লেখককে জন্মদিনের আগাম শুভেচ্ছা জানান।

অনুষ্ঠানের শুরুতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা আবৃত্তি করেন লেখক ও অনুবাদক জাভেদ হুসেন। সঞ্চালনা করেন প্রথমা প্রকাশনের শিশুসাহিত্য সহযোগী সাইদুজ্জামান রওশন।

এইচএসবিসি ব্যাংকের পৃষ্ঠপোষকতায় গত বৃহস্পতিবার থেকে বাংলা একাডেমি চত্বরে শুরু হয়েছে ১০ দিনের বিজয় বইমেলা। মেলা প্রতিদিন বেলা ১১টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত চলবে। শেষ হবে ২১ ডিসেম্বর।

বিজয় বইমেলায় প্রথমা প্রকাশনের বই সর্বনিম্ন ৩০ থেকে সর্বোচ্চ ৭০ শতাংশ, অন্য প্রকাশনীর বই ২৫ শতাংশ এবং বিদেশি বই সর্বনিম্ন ৫ থেকে সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ ছাড়ে কেনা যাবে।

আগামীকাল সোমবারের অনুষ্ঠান

বিকেল সাড়ে চারটায় আলোচনা করবেন অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, আবৃত্তি করবেন আফজাল হোসেন, তাহসিন রেজা ও হুর এ জান্নাত, গান করবেন রফিকুল আলম।