পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়েতে কেনাকাটায় বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি পেয়েছে সরকারের মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়।
লাইনচ্যুত ট্রেনের চাকা বা দেবে যাওয়া রেললাইন ওপরের দিকে তুলতে যে যন্ত্রটি ব্যবহৃত হয়, সেটি ‘লিফটিং জ্যাক’ নামে পরিচিত। এ ধরনের একটি যন্ত্র ভারত থেকে আমদানি করলে খরচ পড়ে প্রায় ১৯ হাজার টাকা। কিন্তু এই যন্ত্র ঠিকাদারের কাছ থেকে রেলওয়ে কিনেছে ৩ লাখ টাকায়। এ রকম যন্ত্র রেলওয়ে কিনেছে ১২টি।
একটি লিফটিং জ্যাক বা ভার উত্তোলনের যন্ত্র কিনতে যে টাকা খরচ করেছে রেলওয়ে, সেই টাকায় ১৬টি যন্ত্র কেনা যেত। একইভাবে ৬৫ হাজার টাকার একটি ড্রিলিং মেশিন (লোহার পাত ছিদ্র করার যন্ত্র) কেনা হয়েছে ৯ লাখ ৬৫ হাজার ৬০০ টাকায়। প্রতিটি ড্রিলিং মেশিন কিনতে বাজারমূল্যের চেয়ে ১৫ গুণ টাকা বেশি খরচ করা হয়েছে। এখানেই শেষ নয়, বাজারমূল্যের চেয়ে ৮ গুণ বেশি দামে কেনা হয়েছে আরেকটি যন্ত্র, যার নাম ‘কাটিং ডিস্ক’ (দেখতে চাকতির মতো, লোহার পাত কাটার যন্ত্র)।
এ রকম অস্বাভাবিক দামে ঠিকাদারের মাধ্যমে রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের (চট্টগ্রাম) অধীন ট্র্যাক সাপ্লাই কর্মকর্তার (টিএসও) কার্যালয় চার ধরনের মোট ২৮টি যন্ত্র কিনেছে। এসব যন্ত্রের প্রকৃত বাজারমূল্য সাড়ে ১৮ লাখ টাকা। অথচ এগুলো কিনতে ব্যয় করা হয়েছে ২ কোটি টাকা। যন্ত্রগুলো কেনা হয়েছে অবশ্য ২০১৮–১৯ অর্থবছরে। কেনাকাটায় এই অনিয়ম ও আর্থিক ক্ষতির বিষয়টি অবশ্য ধরা পড়ে ২০২০ সালে। কেনাকাটায় অনিয়মের এই বিষয় নিয়ে সরকারের মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক কার্যালয় (সিএজি) গত জুন মাসে প্রতিবেদন দিয়েছে।
ট্রেন পরিচালনার সুবিধার্থে বাংলাদেশ রেলওয়ে দুটি অঞ্চলে বিভক্ত। একটি অঞ্চল যমুনা নদীর পূর্ব পাশে, যা পূর্বাঞ্চল রেলওয়ে(ঢাকা–চট্টগ্রাম–সিলেট–ময়মনসিংহ বিভাগ) হিসেবে পরিচিত। আর যমুনা নদীর পশ্চিম পাশ নিয়ে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে গঠিত (রাজশাহী–রংপুর–খুলনা বিভাগ)। রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের একটি শাখা রয়েছে চট্টগ্রামে, যা জেলা সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় হিসেবে পরিচিত (আরঅ্যান্ডআই শাখা)। এই শাখার একটি কক্ষ মেরামতের নামে মালামাল কেনাকাটা দেখিয়ে ২ কোটি ৬২ লাখ টাকা তছরুপ (আত্মসাৎ) করা হয়েছে। মোট ৫৪ ধরনের মালামাল কেনার নামে কর্মকর্তা ও ঠিকাদারেরা মিলে এই অর্থ আত্মসাৎ করেছে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে। টাকা আত্মসাতের এসব ঘটনা সিএজির গত জুন মাসের একটি নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
এখন নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে এর গভীরে গিয়ে পেছনের ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে জবাবদিহি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে এ ধরনের দুর্নীতি প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়।ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক, টিআইবি
২০১৮-১৯ অর্থবছরে রেলওয়ের পূর্বাঞ্চল (চট্টগ্রাম) ও পশ্চিমাঞ্চলের (রাজশাহী) ১৫টি কার্যালয়ের কেনাকাটায় বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতির খোঁজ পেয়েছে সিএজি। তাদের প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, কখনো উচ্চমূল্যে পণ্য কেনা হয়েছে, আবার কখনো পণ্য না কিনেই টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এসব অনিয়ম–দুর্নীতির কারণে সরকারের ক্ষতি হয়েছে ১১ কোটি ১৮ লাখ ৮১ হাজার ৪২৬ টাকা।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে রেলওয়ের ১৫টি কার্যালয়ের কেনাকাটায় সরকারের ১১ কোটি ১৮ লাখ ৮১ হাজার ৪২৬ টাকার আর্থিক ক্ষতি।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বাজারমূল্যের চেয়ে ৩৮ গুণ পর্যন্ত বেশি দামে মালামাল কেনার ঘটনাও ঘটেছে। যেমন রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলের একটি কার্যালয় ২৮০ টাকার ‘পাইপ রেঞ্জ’ (নাট–বল্টু সঠিকভাবে প্রতিস্থাপন করার যন্ত্র) কেনা হয়েছে ৮ হাজার ৪৭৫ টাকায়। একটি ২৬০ টাকার ‘প্যাডেল বিন’ (ময়লার ঝুড়ি) কিনেছে সাড়ে ৭ হাজার টাকায়।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের ট্র্যাক সাপ্লাই কর্মকর্তার কার্যালয় ২৮টি যন্ত্র কিনতে খরচ করেছে প্রায় ২ কোটি টাকা। অথচ এগুলোর বাজারমূল্য মাত্র সাড়ে ১৮ লাখ টাকা। এসব যন্ত্র সরবরাহ করেছে নূর–ই–এলাহী অ্যান্ড ব্রাদার্স প্রাইভেট লিমিটেড নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের সরবরাহ করা ২৮টি যন্ত্রের মধ্যে ১২টি লিফটিং জ্যাক। এর মধ্যে ৫টি যন্ত্র ১৫ টন এবং ৭টি যন্ত্র ১০ টন ভার উত্তোলনে সক্ষম। এ ধরনের যন্ত্র সাধারণত ভারত থেকে কেনা হয়ে থাকে। ভারতে এসব যন্ত্রের দাম গড়ে সাড়ে ১১ হাজার রুপি, যা এখন বাংলাদেশি মুদ্রায় ১৬ হাজার ১০০ টাকা। অন্যান্য খরচসহ (পরিবহন ব্যয়) এগুলোর সর্বোচ্চ দাম ১৮ হাজার ৬০০ টাকা হতে পারে। কিন্তু নূর–ই–এলাহী অ্যান্ড ব্রাদার্স প্রাইভেট লিমিটেড এই যন্ত্রগুলো সরবরাহ করে প্রতিটিতে ৩ লাখ টাকা করে বিল তুলেছে।
এসব যন্ত্র অনলাইনে বিক্রি করে ইন্ডিয়ামার্ট নামের একটি ওয়েবসাইট। তাদের ওয়েব ঠিকানায় গিয়ে প্রথম আলোর এই প্রতিবেদক দেখতে পান, ১৫ টন ভার বহনে সক্ষম একটি লিফটিং মেশিনের দাম উল্লেখ করা হয়েছে ৯ হাজার ৫০০ রুপি। এই হিসাবে একটি যন্ত্রের দাম বাংলাদেশি মুদ্রায় ১৩ হাজার ৩০০ টাকা।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৬৫ হাজার টাকার ড্রিলিং মেশিন কেনা হয়েছে ৯ লাখ ৬৫ হাজার ৬০০ টাকা। বাজারমূল্য অনুযায়ী, ৮টি ড্রিলিং মেশিনের দাম হওয়ার কথা ৫ লাখ ২০ হাজার টাকা। তবে এগুলো কিনতে খরচ হয়েছে প্রায় ৭৭ লাখ ২৫ হাজার টাকা। একইভাবে ১ লাখ ৩৮ হাজার টাকার রেল কাটিং ডিস্ক মেশিন কেনা হয়েছে ১০ লাখ ৫ হাজার টাকায়। ৮টি মেশিন কিনতে ১১ লাখ ৫ হাজার টাকা খরচ হওয়ার কথা। তবে এগুলো কিনতে খরচ করা হয়েছে প্রায় ৭৫ লাখ ৭৫ হাজার টাকা।
প্রতিবেদনে কোনো অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য উঠে এলে তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। এরপর কমিটির মতামত অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।জাহাঙ্গীর হোসেন, মহাব্যবস্থাপক, রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল (চট্টগ্রাম)
বাজারমূল্যের চেয়ে অস্বাভাবিক বেশি দামে পণ্য কেনার বিষয়ে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী আবু জাফর মিঞা প্রথম আলোকে বলেন, যখন ওই সব পণ্য কেনা হয়, তখন তিনি দায়িত্বে ছিলেন না। তবে যতটুকু জেনেছেন, জার্মানি থেকে উন্নত মানের ওই যন্ত্রগুলো কেনা হয়েছিল। এ কারণেই হয়তো দাম বেশি পড়েছে।
চট্টগ্রামের শহরের হালিশহর হাউজিং এস্টেট এলাকায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নূর-ই-এলাহী অ্যান্ড ব্রাদার্স লিমিটেডের কার্যালয়। এই প্রতিষ্ঠানের মালিকদের একজন এম এন করিম। তিনি কক্সবাজারের ওশান প্যারাডাইস হোটেলেরও চেয়ারম্যান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, যন্ত্রগুলো জার্মানি থেকে আমদানি করা। তাঁর প্রতিষ্ঠান জার্মানির একটি প্রতিষ্ঠানের স্থানীয় এজেন্ট। গুণগত মানের কারণেই তাঁর প্রতিষ্ঠানের সরবরাহ করা যন্ত্রের দাম ও আয়ুষ্কাল বেশি। সরবরাহ করা মালামালে বিল বেশি নেওয়া হয়নি বলেও দাবি করেন তিনি।
তবে নিরীক্ষা প্রতিবেদন বলছে, নূর-ই-এলাহী অ্যান্ড ব্রাদার্স লিমিটেডের সরবরাহ করা যন্ত্র ও দামের বিষয়ে পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের ট্র্যাক সাপ্লাই কর্মকর্তার কার্যালয়কে ২০২০ সালে দুই দফা চিঠি দিয়েছিল সিএজি। তবে এখন পর্যন্ত চিঠির জবাব আসেনি। সিএজি সূত্র বলছে, ওই যন্ত্রগুলো সাধারণ ভারত থেকেই আমদানি করেন ঠিকাদারেরা।
সিএজির নিরীক্ষা প্রতিবেদনের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০১৮–১৯ অর্থবছরে চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে রেলের বৈদ্যুতিক প্রকৌশলীর কার্যালয়ের জন্য ২১ ধরনের মালামাল কেনা হয়েছিল দুই থেকে তিন গুণ দামে। এতে ৪ লাখ টাকা বাড়তি খরচ করা হয়েছে। এ ছাড়া চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে রেলওয়ের প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় ওই অর্থবছরে ৫০টি ওয়াকিটকি কিনেছিল ৫০ লাখ টাকায়। ৫০টি ওয়াকিটকির বাজারমূল্য ৯ লাখ টাকা। অথচ একটি ওয়াকিটকির বাজারদর ১৮ হাজার ১২৫ টাকা। কিন্তু কেনা হয়েছে প্রায় ১ লাখ টাকায় (৯৯ হাজার ৬০০ টাকা)।
নিরীক্ষা প্রতিবেদন বলছে, ঠিকাদারদের সঙ্গে যোগসাজশ করে সাড়ে পাঁচ গুণ বেশি দামে রেলের কিছু কর্মকর্তা ওয়াকিটকিগুলো কিনেছেন। এতে সরকারের ৪১ লাখ টাকা বাড়তি খরচ হয়েছে। চট্টগ্রামের সিআরবির সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় ৯০টি এলইডি লাইট এবং ৫০টি এলইডিসহ ল্যাম্প কিনেছে ৩২ লাখ টাকায়। কিন্তু এগুলোর বাজারমূল্য ৯ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রায় সাড়ে তিন গুণ দামে এসব সরঞ্জাম কেনার বিষয়টিও নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের অধীনে প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক বিভাগের আরঅ্যান্ডআই শাখার (পাহাড়তলীতে) এক কক্ষের টিনের তৈরি কার্যালয় (১৮৫ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৩৭ ফুট প্রস্থ) মেরামতের নামে ২ কোটি ৬২ লাখ ৭১ হাজার টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। কার্যালয়ের কক্ষ সংস্কার করে কর্মপরিবেশ উন্নয়নের নামে এই অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছিল। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওই বিভাগের কর্মকর্তা ও ঠিকাদারেরা যোগসাজশ করে পুরো টাকাই আত্মসাৎ করেছে। এমনকি মেরামতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়, এমন অনেক মালামাল কেনার নামে ঠিকাদারদের বিল পরিশোধ করা হয়েছে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কক্ষ মেরামতের নামে ৯৫ লাখ ২৪ হাজার টাকার ‘স্ল্যাব’ কেনার নাম করে ঠিকাদারদের বিল পরিশোধ করা হয়।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের (চট্টগ্রাম) মহাব্যবস্থাপক জাহাঙ্গীর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, নিরীক্ষা প্রতিবেদনটি এখনো তাঁর দপ্তরে আসেনি। প্রতিবেদনে কোনো অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য উঠে এলে তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। এরপর কমিটির মতামত অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বাজারে ৮ ইঞ্চির ছোট্ট একটি পাইপ রেঞ্জের দাম ২২০ টাকা। কিন্তু এটি কেনা হয়েছে ৬ হাজার ৪৭৫ টাকায়। একইভাবে ২৮০ টাকার ১২ ইঞ্চি পাইপ রেঞ্জ কেনা হয়েছে ৮ হাজার ৪৭৫ টাকায়। অর্থাৎ ৮ ইঞ্চি পাইপ রেঞ্জ কেনা হয়েছে ২৯ গুণ বেশি দামে, আর ১২ ইঞ্চির পাইপ রেঞ্জ কেনা হয়েছে ৩০ গুণ বেশি দামে। এভাবে ১৯ ধরনের ছোট যন্ত্র কেনায় বড় অনিয়ম করেছে রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের অধীন লালমনিরহাটের সহকারী যন্ত্র প্রকৌশলীর কার্যালয়। এসব মালামাল ক্রয়ে কোনোটিতে বাজারমূল্যের চেয়ে দ্বিগুণ, আবার কোনোটিতে ৩০ গুণ টাকা খরচ করা হয়েছে।
অনিয়ম–দুর্নীতির এই চিত্র সিএজির নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এখানে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, পূর্বাঞ্চলে অনিয়ম–দুর্নীতির ঘটনাগুলো ২০১৮–১৯ সালে হয়েছিল। রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলেও একই অর্থবছরে বিভিন্ন ধরনের কেনাকাটায় অনিয়ম–দুর্নীতি পেয়েছে সিএজি।
রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় (রাজশাহী) কীটনাশক, হারপিক, ব্লিচিং পাউডার, কোদাল, বেলচাসহ অন্তত ৫০ ধরনের মালামাল কিনেছে ২ থেকে ৫ গুণ বেশি দামে। এসব কেনাকাটায় ২ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। সিএজির প্রতিবেদন বলছে, ওই সব মালামালের বাজারমূল্য ৮৮ লাখ টাকা।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব মালামাল কেনার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কার্যালয় সিএজিকে যে জবাব দিয়েছে, তা সন্তোষজনক নয়। এ কারণে বাজারদর অপেক্ষা বেশি দামে কেনার দায় নির্ধারণ করার সুপারিশ করা হয়েছে। পাশাপাশি অতিরিক্ত খরচ করা অর্থ আদায় করে সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
অন্যদিকে রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের প্রধান বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপকের অধীন বিভাগীয় কার্যালয়গুলোতে ২২০টি ‘লাগেজ ট্রলি’ কেনার কাগজ পেয়েছে সিএজি। কিন্তু বাস্তবে এসব ট্রলির খোঁজ পাওয়া যায়নি। অথচ ঠিকাদারদের ২২ লাখ ৬৫ হাজার টাকা বিল পরিশোধ করার বিষয়টি কাগজে দেখানো হয়েছে।
উচ্চমূল্যে কেনাকাটা এবং অর্থ আত্মসাতের বিষয়ে রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের (রাজশাহী) মহাব্যবস্থাপক অসীম কুমার তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, তিনিও সিএজির প্রতিবেদনটি এখনো হাতে পাননি। কেনাকাটার বিষয়ে আপত্তির বিষয়ে তাঁর কাছে জবাব চাইলে তিনি জবাব দেবেন। জবাব সন্তোষজনক মনে না হলে তদন্ত কমিটি গঠন করতে পারে মন্ত্রণালয়। কেউ অনিয়ম করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
রেলওয়েতে কেনাকাটায় অনিয়ম–দুর্নীতির বিষয়ে সিএজির নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একজন দূরদর্শী ব্যক্তি নিজস্ব অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে যেমন সতর্কতা অবলম্বন করেন, ঠিক তেমনি সরকারি অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে প্রত্যেক সরকারি কর্মকর্তাকে একই ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। প্রত্যেক বিভাগীয় প্রধান প্রতিটি ক্ষেত্রে আর্থিক শৃঙ্খলা এবং কঠোর মিতব্যয়িতা প্রতিষ্ঠার জন্য দায়ী। তিনি তাঁর নিজের কার্যালয় এবং তাঁর অধীনে থাকা কর্মকর্তারা যেন বিধিবিধান অনুসরণ করেন, তার জন্য দায়ী।
সিএজির প্রতিবেদনে রেলওয়েতে কেনাকাটার যে চিত্র উঠে এসেছে, এটা প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি বলে মনে করেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বিপুল পরিমাণ রাষ্ট্রীয় অর্থ ব্যয় করা হলেও অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে রেলওয়ের সেবার মান উন্নত হয়নি। রেলওয়ের দুর্নীতিতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী ছাড়াও পেছনে শক্তিশালী মহল রয়েছে। এখন নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে এর গভীরে গিয়ে পেছনের ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে জবাবদিহি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে এ ধরনের দুর্নীতি প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়।
(প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন সুজন ঘোষ, চট্টগ্রাম )