কাঠমান্ডুর দশরথ রঙ্গশালায় শেষ বাঁশি বাজে, প্রথম আলো অফিসের ব্যস্ত বার্তাকক্ষ তালি দিয়ে ওঠে, কলসিন্দুর গ্রাম থেকে আসা ফোনের মধ্যেই শুনতে পাই আনন্দচিৎকার, ওখানকার স্কুলের কোচ জুয়েল মিয়ার গলা ধরে আসে আর রাঙামাটির মনিকা, ঋতুপর্ণার স্কুলের প্রধান শিক্ষক চন্দ্রা দেওয়ান ফোনে শুধু হাসতেই থাকেন, হাসতেই থাকেন।
ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার কলসিন্দুর গ্রাম গতকাল বুধবার রাতে জেগে উঠেছে আনন্দের উচ্ছ্বাসে। সীমান্তঘেঁষা মন্দিরকোনা গ্রামের বৃদ্ধা এনতা মান্দার কাছে নিশ্চয় আজ ছুটে আসবেন গ্রামবাসী হিন্দু-মুসলিম-গারো নারী-পুরুষ। কাঠমান্ডুতে গতকাল মারিয়ার দূরপাল্লার শটটা কি ভোলার মতো? দুই বছর আগে এনতা মান্দার মেয়ে মারিয়া মান্দা যখন সাফ নারী ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয়ে গ্রামে এসেছিলেন, বাড়ির সামনে রাস্তায় কলাগাছ পুঁতে সংবর্ধনা তোরণ সাজিয়েছিলেন গ্রামবাসী। এবারও কি সাফ জয়ের মুকুট পরা মারিয়া ফিরে এলে এই আদিবাসী গ্রাম জেগে উঠবে নৃত্যে-গীতে? যে ফুটবলার মেয়েরা ওই প্রত্যন্ত গ্রামের বাঁশঝাড়ের অন্ধকারে জ্বেলে দিয়েছেন বিদ্যুতের আলো, তাঁদের বিজয়ে গ্রামবাসী হুল্লোড় করে উঠেছে কাল রাতে।
সাতক্ষীরার কালীগঞ্জের মৌতলায় জীর্ণ কুটিরে রাজিয়া সুলতানার মা আবিরন গোবর ছেনে ঘুঁটে বানাচ্ছিলেন, এ বছর ১৯ মার্চ যখন প্রথম আলোর প্রতিবেদক শেখ সাবিহা আলম গিয়েছিলেন এই সাফজয়ী ফুটবলারের বাড়ি। রাজিয়ার বাবা মারা গেছেন যক্ষ্মায় ভুগে, অভাবের সংসার ছিল তাঁদের। বিয়ের কথা গোপন করে পেটে সন্তান নিয়েও খেলেছেন রাজিয়া আর ১৩ মার্চ রাতে সন্তান জন্ম দিয়ে রক্তক্ষরণে মারা গেছেন তিনি। তাঁর কবরটিতে রাতের কুয়াশা আদর ছড়ায়, কবরের ঘাসে জমে শিশিরকণা! অন্যের বাড়িতে কাজ করে ক্লান্ত শরীর নিয়ে ফিরে আসা রাজিয়ার মা আবিরন কি জানতে পেরেছিলেন গতকাল আরও একবার সাফ জয় করেছেন রাজিয়ার বন্ধুরা?
এবারের সেমিফাইনালে ভুটানের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করেছেন কলসিন্দুর গ্রামের তহুরা। তহুরার বাবা ফিরোজ মিয়া চাষাবাদ করতেন নিজস্ব জমিতে। মা সাবেকুন নাহার গৃহিণী। পাঁচ বোন, এক ভাই। সবার বড় বোন, তারপর ভাই, তৃতীয় তহুরা। ২০১৫ সালে ১২ বছরের তহুরা বিদেশে খেলতে যাবেন বলে বিমানবন্দরে যান, জীবনের প্রথম লিফট দেখে ভয়ে ওঠেননি তাতে। সেই তহুরা এখন খ্যাত বাংলার ‘মেসি’ হিসেবে।
আজ পরপর দুবারের সাফ নারী কাপে চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ দলকে নিয়ে আমরা গৌরব বোধ করছি প্রথম আলোর প্রত্যেক কর্মী এবং বিশ্বজুড়ে প্রথম আলোর যে কোটি পাঠকের পরিবার—সবার জন্য এই জয় বিশেষ কিছু। কারণ, আমাদের সবার সঙ্গে বাংলাদেশ নারী ফুটবলের এই দলটার বিশেষ রকমের একটা সম্পর্ক ৯ বছরের। ২০১৫ সালে প্রথম ময়মনসিংহ থেকে প্রথম আলোর প্রতিনিধি কামরান পারভেজ লিখে পাঠান কলসিন্দুর গ্রামের ফুটবলার বালিকাদের গল্প।
এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ টুর্নামেন্টের আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়নশিপে ১৮ সদস্যের বাংলাদেশ দলে একসঙ্গে খেলার সুযোগ পায় কলসিন্দুরের ১০ কন্যা—মার্জিয়া আক্তার, সানজিদা আক্তার, নাজমা আক্তার, শিউলি আজিম, মারিয়া মান্দা, মাহমুদা আক্তার, লুপা আক্তার, শামসুন্নাহার, তাসলিমা ও তহুরা খাতুন। আমরা মুগ্ধ-বিস্ময়ে প্রশ্ন করি, কী আছে এই এক গ্রামে যে তারা এতগুলো চ্যাম্পিয়ন বালিকা উপহার দিচ্ছে বাংলার ফুটবলকে? প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে সে বছর বানানো হয় রেদওয়ান রনি পরিচালিত প্রামাণ্যচিত্র অদম্য মেয়েরা। বিষয় কলসিন্দুরের ফুটবলার মেয়েদের সংগ্রাম আর বিজয়।
একই গল্প বারবার বলেও পুরোনো হবে না—এই সিনেমার শুটিং করার সময় ফুটবলার মেয়েদের বলা হয়েছিল, ‘তোমরা তো অনেক সময় ও শ্রম দিচ্ছ, কিছু একটা চাও’। ওরা বলেছিল, ‘আমরা এক বেলা পেট ভরে ভাত খেতে চাই।’ চোখের জল গোপন করে মুখে হাসি এনে প্রথম আলোর প্রতিনিধি ওদের বলেছিলেন, ‘তোমরা আরও বেশি কিছু চাও।’ ওরা জবাব দিয়েছিল, ‘আমাদের বেশি করে খাবার দিন, বাকিটা আমরা বাড়ি নিয়ে যাব, ভাইবোনেরা এক বেলা পেট পুরে খেতে পারবে।’
২০১৫ সালে প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে সোনারগাঁও হোটেলে আসে কলসিন্দুরের অনূর্ধ্ব-১৪ বালিকারা। তাদের সংবর্ধনা দেওয়া হয়। তাদের জন্য মাসিক বৃত্তির কার্যক্রম শুরু হয়। পরে জাতীয় দল (অনূর্ধ্ব-১৪) চ্যাম্পিয়ন হলে এই দলের সব খেলোয়াড়কে আনা হয় প্রথম আলো ট্রাস্টের বৃত্তির আওতায় (২০১৬-২০১৯)।
আমি কলসিন্দুর গ্রামে দুবার গেছি। এখনো ওই স্কুলের বালিকা-কিশোরীরা ফুটবল খেলে। পেট ভরে খেয়ে মাঠে আসতে পারে না। ২০২২ সালে কিশোর আলোর জন্মদিন উদ্যাপন করতে আমরা যাই কলসিন্দুর গ্রামে। সানজিদা, মারিয়া, তহুরা, শিউলি, শামসুন্নাহারদের বাড়ি গিয়েছি আমরা। ওদের বিজয়ের কারণে গ্রামের অনেক রাস্তাঘাট উন্নত হয়েছে, স্কুল-কলেজ পাকা হয়েছে, গ্রামে বিদ্যুৎ গেছে, গ্রামবাসীর গর্বের সীমা নেই। কিন্তু শিশু-কিশোর ফুটবলারদের ড্যাবডেবে চোখের নিচে অপুষ্টির ছায়া। কিশোর আলোর পক্ষ থেকে ওই গ্রামের ৩২ জন ফুটবলার কিশোরীকে ২০২২ সাল থেকে আমরা বৃত্তি দিয়ে চলেছি। এটা অব্যাহত আছে।
২০২২ সালে সাফ চ্যাম্পিয়ন হয়ে ফিরে আসেন বাংলাদেশের নারী ফুটবলাররা। ওই খেলার আগে সানজিদা ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছিলেন, ‘পাহাড়ের কাছাকাছি স্থানে বাড়ি আমার। পাহাড়ি ভাইবোনদের লড়াকু মানসিকতা, গ্রামবাংলার দরিদ্র ও খেটে খাওয়া মানুষদের হার না-মানা জীবনের প্রতি পরত খুব কাছাকাছি থেকে দেখা আমার। ফাইনালে আমরা একজন ফুটবলারের চরিত্রে মাঠে লড়ব এমন নয়, এগারোজনের যোদ্ধাদল মাঠে থাকবে, যে দলের অনেকে এই পর্যন্ত এসেছে বাবাকে হারিয়ে, মায়ের শেষ সম্বল নিয়ে, বোনের অলংকার বিক্রি করে, অনেকে পরিবারের একমাত্র আয়ের অবলম্বন হয়ে।’
২০২২ সালে রেদওয়ান রনির নির্মাতা দল আবার যায় কলসিন্দুরে। এবার বলা হবে শামসুন্নাহার জুনিয়রের গল্প। আর এক কলসিন্দুরের সাফল্যের পথ ধরে অনুপ্রাণিত হয়ে বাংলার জনপদে জনপদে যে মেয়েদের ফুটবল ছড়িয়ে পড়েছে, সেই গল্প, ‘সে আগুন ছড়িয়ে গেল সবখানে।’ ২০২২ সালের নভেম্বরে প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে সাফ চ্যাম্পিয়ন টিমকে এনে পাঁচতারা হোটেলে সংবর্ধনা দেয় প্রথম আলো। আর দেশের বিশিষ্টজন এবং প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় দেড় কোটি টাকা সংগ্রহ করে। এর মধ্যে ১ কোটি ২০ লাখ টাকা তুলে দেওয়া হয় বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের হাতে, নারী ফুটবলের কল্যাণে। ৩০ লাখ টাকা দেওয়া হয় খেলোয়াড় ও স্টাফদের।
রাঙামাটির ঘাগড়া স্কুল থেকে প্রধান শিক্ষক চন্দ্রা দেওয়ানের ফোন আসে একদিন। তিনি বলেন, ‘আমার স্কুল জাতীয় দলে দিয়েছে পাঁচজন নারী ফুটবলার—মনিকা চাকমা, রুপনা চাকমা, ঋতুপর্ণা চাকমা, আনুচিং মগিনি ও আনাই মগিনি। আপনি আমাদের স্কুলে আসেন।’ ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে আমরা যাই ওই স্কুলে—দিয়ে আসি ২ লাখ টাকার চেক।
তবু মনে হয়, ফুটবল নিষ্ঠুর খেলা। শত শত কিশোরী ফুটবল খেলছে, অনুশীলন করছে। কিন্তু জাতীয় দলে আসে অল্প জনই। এদের সংসার চলে না। জাতীয় দলে সুযোগ না পাওয়া বা জাতীয় দল থেকে বাদ পড়াদের কাহিনি কেউ বলে না, কেউ শোনে না। বিশাল বাংলার নিধুয়া পাথারে মিশে যায় তাদের দীর্ঘশ্বাস।
যারা জাতীয় দলে সুযোগ পায়, ক্যাম্পে থাকে, তাদেরও মাসোয়ারা বেশ কম। খেলার বয়স আর কিছুদিন পর থাকবে না! কী করবেন তখন এই নারী ফুটবলাররা? তবু আমাদের মেয়েরা ফুটবল খেলবে। এ মুহূর্তে রংপুরে, দিনাজপুরে, টাঙ্গাইলে, সাতক্ষীরায়, রাঙামাটিতে আধপেটা খেয়ে জুতা ছাড়া খালি পায়ে ফুটবল খেলছে একদল বালিকা। এদের চোখে দেশকে চ্যাম্পিয়ন করার স্বপ্ন। এদের পেট ভরে ভাত নেই, মন ভরে আছে স্বপ্নে। আর বাংলাদেশের চ্যাম্পিয়ন নারী ফুটবল দলের দিকে তাকান। বৈচিত্র্য আর অন্তর্ভুক্তির পোস্টার। ডাইভার্সিটি আর ইনক্লুসিভনেস।
খেলোয়াড়ের নাম সাবিনা, সানজিদা, স্বপ্না, কৃষ্ণা, মারিয়া মান্দা, রুপনা চাকমা, আনুচিং মগিনি। এই বাংলাদেশের কথাই তো গ্রাফিতিতে এঁকে রেখেছে নতুন প্রজন্ম, রক্ত দিয়ে যারা মুক্তি এনে দিয়েছে।
অভিনন্দন, আমাদের মেয়েদের। তবু কি ভুলতে পারব কলসিন্দুরের বালিকা ফুটবলারদের সেই উক্তি, যারা ২০১৫ সালে বলেছিল, ‘আমাদের বেশি করে খাবার দিন, বাকিটা আমরা বাড়ি নিয়ে যাব, ভাইবোনেরা এক বেলা পেট পুরে খেতে পারবে!’
উফ্, আমার বাংলাদেশ কবে দারিদ্র্যমুক্তিতে চ্যাম্পিয়ন হবে?