রাজধানীর ৬৮টি স্থানে অপরাধে সক্রিয় ৪১১ হিজড়া

সম্প্রতি পুলিশ সদর দপ্তরে পাঠানো ডিএমপির প্রতিবেদনে এ তথ্য উল্লেখ করে বলা হয়, হিজড়াদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে রাখতে সম্প্রতি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তাঁদের পুনর্বাসিত করতে প্রতিবেদনে কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে

হিজড়াদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে

রাজধানীতে হিজড়াদের চাঁদাবাজির অভিযোগ শোনা যায় প্রায়ই। রাস্তার সিগনাল, যানবাহন, বাসাবাড়ি, দোকানপাটসহ আবাসিক এলাকায় হিজড়াদের চাঁদাবাজি বন্ধে উদ্যোগ নিয়েছে পুলিশ। হিজড়াদের পুনর্বাসনে সুপারিশও করা হয়েছে।

সম্প্রতি পুলিশ সদর দপ্তরে পাঠানো ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) প্রতিবেদনে বলা হয়, ৪১১ হিজড়া রাজধানীর ৬৮টি স্পটে ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও যৌনকর্মে তৎপর। তাঁদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে রাখতে সম্প্রতি ডিএমপি পদক্ষেপ নিয়েছে। একই সঙ্গে তাঁদের পুনর্বাসিত করতে কিছু সুপারিশও তুলে ধরেছে ডিএমপি।

ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার খ. মহিদ উদ্দিন গত শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, প্রথমে হিজড়ারা রাজধানীর যেসব স্পটে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ত, সে বিষয়ে তাঁদের তালিকা তৈরি করা হয়। পরে তাঁদের দলনেতাদের নিয়ে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে সরে যেতে বৈঠক করা হয়। বৈঠকে হিজড়া নেতারা রাস্তার মোড়ে মোড়ে আর চাঁদাবাজি করবেন না বলে অঙ্গীকার করেন। এরপর তাদের সংশ্লিষ্ট স্থানগুলো থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। খ. মহিদ উদ্দিন বলেন, তাঁদের পুনর্বাসন বা নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা না হলে ভবিষ্যতে তাঁরা রাস্তার মোড় বা ক্রসিংয়ে আবার ফিরে আসতে পারেন।

হিজড়াদের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ

পুলিশ সদর দপ্তরে পাঠানো ডিএমপির অপরাধ ও পরিচালন বিভাগের প্রতিবেদনে বলা হয়, সুন্নতে খতনা, নবজাতক জন্মের খবরে হিজড়ারা বাসাবাড়িতে গিয়ে চাঁদাবাজি করেন। চাঁদা দেওয়া না হলে তাঁরা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেন। হিজড়ারা জোর করে নবজাতককে তুলে নিয়ে নাচ–গান করেন এবং নবজাতককে জোর করে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে চাঁদা আদায় করেন। বিয়ে, জন্মদিনসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দলবদ্ধভাবে ঢুকে বিকৃত অঙ্গভঙ্গি করে চাঁদা আদায় করেন। এতে বাধা দিলে মুঠোফোনে অন্য হিজড়াদের ডেকে এনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেন। এক এলাকার হিজড়া অন্য এলাকায় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালাতে গেলে সংশ্লিষ্ট এলাকার হিজড়ারা দখলদারি টিকিয়ে রাখতে স্থানীয় সন্ত্রাসীদের সহায়তা নেন।

হিজড়াদের পুনর্বাসিত করতে পুলিশ সদর দপ্তরে কিছু সুপারিশ পাঠানো হয়েছে। হিজড়াদের পুনর্বাসনে ডিএমপির অপরাধ বিভাগের উপকমিশনারদের পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে।
খ. মহিদ উদ্দিন, অতিরিক্ত কমিশনার, ডিএমপির অপরাধ ও পরিচালন বিভাগ

কেউ চাঁদা দিতে না চাইলে তাঁকে অশ্লীল গালি দেওয়াসহ অপমান–অপদস্থ করেন হিজড়ারা। হিজড়াদের একটি অংশ রাতে নির্জন এলাকায় যৌনকর্ম ও ছিনতাই করেন। হিজড়াদের অর্থ আয় করার সুযোগ থাকায় কিছু নারী-পুরুষও হিজড়া সেজে ভিক্ষাবৃত্তি, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, যৌনকর্ম ও বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছেন।

ডিএমপির উদ্যোগ

ডিএমপির অপরাধ ও পরিচালন বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার খ. মহিদ উদ্দিন হিজড়াদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঠেকাতে উদ্যোগ নেন। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ডিএমপির সদর দপ্তরে তাঁর সভাপতিত্বে বিশেষ সভা হয়। এতে রাজধানীর বিভিন্ন স্পটে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ত দলনেতাসহ হিজড়াদের তালিকা তৈরি ও তাঁদের সঙ্গে বৈঠক করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) পদমর্যাদার এই কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, হিজড়াদের পুনর্বাসিত করতে পুলিশ সদর দপ্তরে কিছু সুপারিশ পাঠানো হয়েছে। হিজড়াদের পুনর্বাসনে ডিএমপির অপরাধ বিভাগের উপকমিশনারদের পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে।

ডিএমপির অপরাধ বিভাগ ও পরিচালন বিভাগ থেকে পুলিশ সদর দপ্তরে পাঠানো সুপারিশে বলা হয়, হিজড়াদের অবহেলার চোখে না দেখে তাঁদের ভালোবাসতে হবে। সরকারি-বেসরকারিভাবে বিভিন্ন পোশাক কারখানা, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের মতো সংস্থায় কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা বা পুনর্বাসন করা দরকার। এতে তাঁরা সমাজের বোঝা না হয়ে স্বাবলম্বী হতে পারবেন। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে এই চিঠি পাঠানোর সুপারিশ করে ডিএমপি।

কোন এলাকায় সক্রিয় হিজড়ারা

ডিএমপির তালিকাভুক্ত হিজড়ার সংখ্যা ৪৪১। এর মধ্যে অপরাধে সক্রিয় ৪১১ জন।রাজধানীর কলাবাগান থানার পান্থপথ মোড় ও হাতিরপুল মোড়ের ২৪টি স্পটে বিয়ের অনুষ্ঠান, শিশুর জন্ম ও আবাসিক এলাকায় চাঁদাবাজিতে সক্রিয় ২৪ হিজড়া। রমনা মডেল থানা এলাকায় মৌচাকের দুটি স্পটে ভিক্ষাবৃত্তি, চাঁদাবাজি ও জোরপূর্বক টাকা আদায়ে ২ হিজড়া, ধানমন্ডি লেকের ১টি স্পটে ভাসমান হিজড়া, শাহবাগ থানার ওসমানী উদ্যান, হাইকোর্টের আশপাশ, শিশু একাডেমির আশপাশ, বাংলামোটর এলাকা, পান্থপথের পান্থকুঞ্জের সামনে, পরিবাগের ১৬টি স্পটে ১৬ হিজড়া, গোপীবাগ এলাকার ১টি স্পটে ১ হিজড়া সক্রিয় আছেন। গেন্ডারিয়ায় একটি স্পটে ১৫ হিজড়া দোকান থেকে টাকা আদায় করেন। ওয়ারী থানা এলাকা, গুলিস্তান ও বনগ্রাম এলাকার ৩টি স্পটে চাঁদাবাজিতে ৩ হিজড়া, শ্যামপুর থানা এলাকায় বিয়ে ও নবজাতকের জন্ম অনুষ্ঠানে চাঁদাবাজিতে ১ হিজড়া, কদমতলী থানা এলাকায় দোকান থেকে টাকা আদায়ে ৫৭ হিজড়া সক্রিয়, কমলাপুর কবরস্থান গলি, আরামবাগ ও ফকিরাপুলের ৩টি স্পটে ২ হিজড়া ভিক্ষাবৃত্তি করেন। শাহজাহানপুর থানা এলাকায় ৩১ হিজড়া মানুষের কাছ থেকে টাকা আদায় করেন। সবুজবাগ থানা এলাকায় চাঁদাবাজিতে সক্রিয় ১৬ হিজড়া।

হিজড়াদের আচরণে একপর্যায়ে মানুষ বিরক্ত হয়ে যায়। পুলিশ তাঁদের রাস্তাঘাটের কর্মকাণ্ড থেকে সরিয়ে দিলেও এটা কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। ...তাঁদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে
সালেহ আহমেদ, প্রধান নির্বাহী, বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি

খিলগাঁও থানার বনশ্রী এলাকায় চাঁদাবাজিতে তৎপর ৪০ হিজড়া। এই এলাকায় চাঁদা না দেওয়া হলে হিজড়ারা গণ–উপদ্রব সৃষ্টি করেন। রামপুরা থানা এলাকায় বিয়ে ও জন্মদিনের অনুষ্ঠানে চাঁদাবাজিতে ১১ হিজড়া সক্রিয়। মোহাম্মদপুরের চাঁদ উদ্যান ও শ্যামলী এলাকায় ২টি স্পটে নবজাতকের বাড়ি, দোকান থেকে চাঁদা আদায়ে ২৬ হিজড়া সক্রিয়। আদাবরের বায়তুল আমান হাউজিং এলাকায় চাঁদাবাজিতে ১৮ হিজড়া, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলে রানার ভবনের সামনে নবজাতকের বাড়ি ও এলাকায় চাঁদাবাজিতে ১৭ হিজড়া সক্রিয়। দারুস সালাম থানার টেকনিক্যাল মোড়, গাবতলী বাস টার্মিনাল এলাকায় আর্থিক সহযোগিতার নামে চাঁদাবাজিতে ২ হিজড়া। মিরপুরে শেরেবাংলা জাতীয় স্টেডিয়াম, শাহ আলী মাজারের সামনে, শাহ আলী থানার ডি ব্লক, মণিপুর, পীরেরবাগ, রাইনখোলা মোড়ে নবজাতকের জন্ম ও বিয়ে উপলক্ষে নাচ–গান করার নামে এবং দোকান থেকে চাঁদাবাজিতে সক্রিয় ৪ হিজড়া। উত্তরার আজমপুর, জসিমউদ্দিন রোড, এপিবিএন অফিসের সামনে, আবদুল্লাপুরে গাড়ি থেকে চাঁদাবাজি করছেন ২২ হিজড়া।

উত্তরা পশ্চিম থানা এলাকা, উত্তরার ১, ৩, ৫, ৭, ৯, ১০, ১১, ১৩, ১৪, উত্তরার আবদুল্লাপুর থেকে জসিম উদ্দিন রোডের প্রধান সড়ক পর্যন্ত ৫২ হিজড়া সক্রিয়। তাঁরা বাসাবাড়ি, দোকানপাট, মার্কেট ও গাড়ি থেকে চাঁদাবাজিতে তৎপর রয়েছেন। তুরাগ থানার বাউনিয়া, দক্ষিণখান থানা এলাকায় ২৬ হিজড়া নবজাতকের বাড়ি, নির্মাণাধীন ভবন, রাস্তাঘাট, কাঁচাবাজার, দোকানপাট থেকে চাঁদাবাজিতে সক্রিয়।

হিজড়াদের উন্নয়নে কাজ করছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি’। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী সালেহ আহমেদ গত রোববার প্রথম আলোকে বলেন, হিজড়াদের আচরণে একপর্যায়ে মানুষ বিরক্ত হয়ে যায়। পুলিশ তাঁদের রাস্তাঘাটের কর্মকাণ্ড থেকে সরিয়ে দিলেও এটা কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। কে, কী কাজে পারদর্শী, সেই বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে তাঁদের দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। পরে সেই অনুযায়ী তাঁদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে।