পদ্মা সেতুতে ট্রেন। গতকাল দুপুরে সেতুর মাওয়া প্রান্তে।
পদ্মা সেতুতে ট্রেন। গতকাল দুপুরে সেতুর মাওয়া প্রান্তে।

পরীক্ষামূলক চলাচল

সেপ্টেম্বরেই ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে রেল চালুর পরিকল্পনা

আগামী সেপ্টেম্বরে ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত পদ্মা সেতু দিয়ে রেল যোগাযোগ চালুর পরিকল্পনা।

পদ্মা সেতু দিয়ে এবার ট্রেনের চাকা ঘুরল। একটি নতুন ট্রেন ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে প্রথমবার পদ্মা নদী পাড়ি দিয়ে মুন্সিগঞ্জের মাওয়ায় আসে। যাত্রাপথে মানুষকে হর্ষধ্বনিতে স্বাগত জানাতে দেখা গেছে। বাড়ির আঙিনা, রেললাইনের ধারে দাঁড়িয়ে অনেক নারী-পুরুষ মোবাইল ফোনে দৃশ্যটি ধারণ করেছেন। স্কুলের পোশাক পরা শিশুদের ট্রেনের যাত্রীদের উদ্দেশে হাত নাড়তে দেখা গেল।

গতকাল মঙ্গলবার ঘড়ির কাঁটায় সময় ঠিক বেলা ১টা ২১ মিনিট। ভাঙ্গা স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেনের হুইসেল বেজে উঠল। সাদা-লাল-সবুজ রঙের বিশেষ ট্রেনের চাকা ঘোরা শুরু করে সেতু দিয়ে পদ্মা নদী পাড়ি দিতে। পুরো চলার পথে ট্রেনের গতি ঘণ্টায় ২৫ কিলোমিটারের মধ্যে ওঠানামা করেছে। তবে পুরোপুরি চালু হলে এ লাইন দিয়ে ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১২০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলাচল করতে পারবে।

২টা ৩৮ মিনিটে ট্রেন এসে পৌঁছায় পদ্মা সেতুর ভায়াডাক্টে (সেতুর উজানের অংশ)। মিনিট দশেকের মধ্যে ট্রেনটি পৌঁছায় মূল সেতুতে। তখনই ট্রেনের শোঁ শোঁ আওয়াজের সঙ্গে যুক্ত হয় আতশবাজির শব্দ। ৬.১৫ কিলোমিটার পদ্মা সেতু পাড়ি দিতে সময় লেগেছে ১৬ মিনিট। মাওয়া স্টেশনে যখন ট্রেনটি থামে, তখন ঘড়িতে সময় ৩টা ১৮ মিনিট। ভাঙ্গা থেকে মাওয়া পর্যন্ত ৪২.২০ কিলোমিটার পার হতে সময় লেগেছে ১ ঘণ্টা ৫৬ মিনিট। এর মধ্যে পদ্মার মূল সেতু ও ভায়াডাক্ট রয়েছে প্রায় ১০ কিলোমিটার।

এই ট্রেনের যাত্রাকে রেল কর্তৃপক্ষ বলছে ‘টেস্ট রান’। এর যাত্রী ছিলেন রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম, স্থানীয় সংসদ সদস্য ও জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ নূর ই আলম চৌধুরীসহ দুই পাড়ের বিভিন্ন আসনের সংসদ সদস্য, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, সাংবাদিক এবং রেলের কর্মকর্তাসহ প্রায় চার শ মানুষ।

মাওয়া স্টেশনে নেমে রেলমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, এই ট্রেন চলার মধ্য দিয়ে আজ পদ্মা সেতু পূর্ণাঙ্গতা পেল। আগামী সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুবিধাজনক সময়ে ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত পদ্মা সেতু দিয়ে রেল যোগাযোগ উদ্বোধন করবেন। সব ঠিক থাকলে আগামী বছরের জুনের মধ্যে যশোর পর্যন্ত রেললাইন চালু করা যাবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে পরীক্ষামূলক বিশেষ ট্রেনটি মঙ্গলবার বেলা সোয়া ৩টায় মাওয়া স্টেশনে এসে পৌঁছায়

পদ্মা সেতু দ্বিতল। এর ওপর দিয়ে যানবাহন চলাচল শুরু হয়েছে গত বছরের জুনে। রেললাইন বসানো সম্পন্ন হওয়ার পর গতকাল ছয়টি যাত্রীবাহী কোচ, একটি পাওয়ার কার ও সামনে–পেছনে দুটি লোকোমোটিভ (ইঞ্জিন) নিয়ে প্রথম ট্রেন চলল। যুক্তরাষ্ট্র থেকে আনা নতুন ইঞ্জিনের সঙ্গে যে নতুন বগিগুলো লাগানো হয়, সেগুলো এসেছে চীন থেকে।

বিশেষ এ ট্রেনের চালক হয়ে ইতিহাসের অংশ হলেন রবিউল ইসলাম। তাঁর সহকারীর দায়িত্বে ছিলেন আরিফুর রহমান। দুজনই সহাস্যে সাংবাদিকদের নানা প্রশ্নের জবাব দেন। রবিউল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘যে দিন চাকরি পেয়েছি, সেদিন সবচেয়ে খুশি হয়েছিলাম। আজ পদ্মা সেতু দিয়ে প্রথম ট্রেন চালানোর অভিজ্ঞতাও একই আনন্দের।’

পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত ১৬৯ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণে ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি টাকায় প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। জিটুজি (দুই দেশের সরকারের মধ্যে) পদ্ধতিতে বাস্তবায়নাধীন এই প্রকল্পে চীনের ঋণ ২১ হাজার কোটি টাকা। ঠিকাদার চায়না রেলওয়ে গ্রুপ। প্রকল্পের নির্মাণকাজ তিন ভাগে বিভক্ত। এর মধ্যে ঢাকা থেকে মাওয়া অংশের দূরত্ব ৪২.২০ কিলোমিটার। মাওয়া থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত ৩৯.৬৩ কিলোমিটার। আর ভাঙ্গা থেকে যশোর ৮৭.১৭ কিলোমিটার। ১ এপ্রিল পর্যন্ত প্রকল্পের কাজের সার্বিক অগ্রগতি ৭৪ শতাংশ।

এরপর যেসব কাজ

সরকারের সর্বশেষ পরিকল্পনা হচ্ছে—ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ভাঙ্গা পর্যন্ত অংশ আগামী সেপ্টেম্বরে চালু করা হবে। এর মধ্যে মাওয়া থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত অংশের পুরোটাই রেললাইন বসানো হয়ে গেছে। তবে এসব লাইন মজবুতকরণ, কিছু মসৃণ করার কাজ করতে হবে। স্টেশনের নির্মাণ ও সংকেত ব্যবস্থা স্থাপনের কাজ পুরোটা শেষ হয়নি। স্টেশনে ট্রেন থামার জন্য বাড়তি লাইন নির্মাণ করতে হবে। আগামী তিন-চার মাসে এই কাজগুলো শেষ করা হবে। গতকাল যে ট্রেনটি চালানো হয়েছে, সেটি আপাতত বন্ধ থাকবে। একেবারে সব কাজ শেষ হলে পুনরায় পরীক্ষামূলক চলাচল, এরপর যাত্রী নিয়ে চূড়ান্তভাবে চলার উপযোগী হবে পদ্মা সেতু দিয়ে রেল যোগাযোগ।

ঢাকা থেকে মাওয়া অংশে ১২ কিলোমিটার রেললাইন বসানো হয়েছে। আরও প্রায় ৩০ কিলোমিটার পথে রেললাইন বসাতে হবে। স্টেশন ও এই পথে কিছু সেতুর নির্মাণকাজও বাকি আছে। এই পথে সংকেত ব্যবস্থার কাজ শুরু হয়নি।

অবশ্য প্রকল্পের পরিচালক আফজাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, এখন জটিল কাজ নেই। বাকি কাজ দ্রুত এগিয়ে যাবে।

দক্ষিণ-পশ্চিমে ট্রেন যাতায়াত

রাজধানীর কমলাপুর থেকে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা, কেরানীগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর, লৌহজং, পদ্মা সেতু, শরীয়তপুরের জাজিরা, মাদারীপুরের শিবচর, ফরিদপুরের ভাঙ্গা, নড়াইল, মাগুরা হয়ে যশোর পর্যন্ত এই রেলপথে ২০টি স্টেশন থাকবে।

রেলের পরিকল্পনা অনুযায়ী, ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত ট্রেন চালু হলে রাজবাড়ী, গোপালগঞ্জ, চুয়াডাঙ্গার দর্শনা, যশোরের বেনাপোল, খুলনা, রাজশাহী অঞ্চল যুক্ত হয়ে যাবে। যশোর পর্যন্ত সরাসরি ট্রেন চালু হলে নড়াইল ও মাগুরা প্রথমবার রেলপথের আওতায় চলে আসবে। এরপর ভবিষ্যতে বরিশাল বিভাগে রেলপথ সম্প্রসারণ সহজ হয়ে যাবে।

২০১৬ সাল থেকে পদ্মা সেতু রেলসংযোগ প্রকল্পের নির্মাণকাজ শুরু। প্রথমে মাটি ভরাট, স্টেশন ভবনের কাজ, সবশেষ লাইন বসানো হয়। গতকাল প্রথম এই পথে ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও মুন্সিগঞ্জের মানুষ ট্রেন চলতে দেখল। এ জন্য হয়তো এক দিনের চলাচলেও মানুষের উচ্ছ্বাস ছিল চোখে পড়ার মতো। সবাই ট্রেনের দিকে হাত নাড়াচ্ছিল।

গতকাল প্রথম ট্রেনটির যাত্রী হয়েছিলেন ফরিদপুরের আলতাফ চৌধুরী, বিউটি আক্তার ও নজরুল মাতবর। তাঁরা বলেন, পদ্মা সেতু দিয়ে ট্রেন চলবে—এটা শুধু কল্পনাই করা যেত। আজ প্রথম যাত্রার সময়ও স্বপ্নই মনে হয়েছে। যাত্রী নিয়ে চলাচল শুরু হলে নিরাপদ বাহন হিসেবে ট্রেনকেই বেছে নেবেন বলে জানান তাঁরা।

মাওয়া স্টেশনে ট্রেনটি যখন থামে, তখন কথা হয় শিক্ষার্থী ফাহিম তাহমীদের সঙ্গে। ঢাকার একটি কলেজের এই শিক্ষার্থীর পরনে ছিল কলেজ ড্রেস। তিনি বলেন, পদ্মা সেতু দেখতে এসেছিলেন। ট্রেন আসবে শুনে সকাল থেকে অপেক্ষা করছেন। ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে তিনি আনন্দিত।