গান শোনার অনেক রকম উপায় এখন শ্রোতাদের নাগালে। খুব সহজ হলো হাতে থাকা মুঠোফোন। স্ট্রিমিং এর নানা মাধ্যমে দেশি বিদেশি অনেক রকম গান শ্রোতারা তাদের পছন্দ মাফিক যখন ইচ্ছা শুনতে পারেন। তবে ডিজিটাল মাধ্যমের গান শোনা আর ‘ভাইনাইল রেকর্ড’ যা ‘এলপি’ বা ‘ইপি’ নামেই সুপরিচিত—সেই রেকর্ডের গান শোনার তফাত বিস্তর। ভাইনাইল রেকর্ডের সংগ্রাহক ও অনুরাগী শ্রোতাদের জন্য দিনব্যাপী উৎসবের আয়োজন চলছে ফার্মগেটের সন্নিকটে দ্যা ডেইলি স্টার আর্ট গ্যালারিতে।
আজ শনিবার সকাল থেকে বাংলাদেশ অডিওফাইল সোসাইটির আয়োজনে শুরু হয়েছে দিনব্যাপী ‘রেকর্ড স্টোর ডে-২০২৪’ নামের এই আয়োজন। সকালে দেশের জননন্দিত কণ্ঠশিল্পী খুরশীদ আলম, লালনকন্যা খ্যাত শিল্পী ফরিদা পারভীনকে নিয়ে সংগীতানুরাগী এবং ভাইনালইল রেকর্ড সংগ্রাহক ও বিক্রেতাদের নিয়ে আয়োজনের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়। এবার নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো রেকর্ড স্টোর ডে উদ্যাপিত হচ্ছে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে অডিওফাইল সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক হারুন আল রশীদ বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে ২০০৭ সাল থেকে এপ্রিল মাসের তৃতীয় শনিবারে ‘রেকর্ড স্টোর ডে’ উদ্যাপন শুরু হয়। এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দিবসটি উদ্যাপিত হচ্ছে। বাংলাদেশে গত বছর ব্যক্তিগত ভাবে ভাইনাইল রেকর্ড সংগ্রাহকেরা প্রথমবার ‘রেকর্ড স্টোর ডে’ উদ্যাপন করেছিলেন। এতে ব্যাপক সাড়া মেলে। এরপরে তারা রেকর্ড সংগ্রাহকদের নিয়ে ‘বাংলাদেশ অডিওফাইল সোসাইটি’ নামের সংগঠন গড়ে তুলেছেন। সাংগঠনের তরফে এবার দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।
অডিওফাইলের সভাপতি জিয়া আহমেদ বলেন, রেকর্ড সংগ্রাহক ও বিক্রেতাদের মধ্যে যোগাযোগ গড়ে তোলা, রেকর্ড পাওয়া, বিপণনের সুবিধা সৃষ্টি এবং এ বিষয়ে শ্রোতাদের আগ্রহী করে তুলতেই রেকর্ড স্টোর ডের আয়োজন করা হয়েছে।
শিল্পী খুরশীদ আলম কেক কেটে আয়োজনের উদ্বোধন করেন। তিনি তার সংগীত জীবনের স্মৃতিচারণ করে বলেন, সরকারি উদ্যোগেই আদি রেকর্ড গুলো সংরক্ষণ করা উচিত ছিল। অনেক বিখ্যাত শিল্পীর অনেক গান আর পাওয়া যায় না। আব্বাস উদ্দিন আহমদ বা আবদুল আলীমের মতো কিংবদন্তির শিল্পীদের অনেক গান হারিয়ে গেছে। তিনি এই আয়োজনকে সাধুবাদ জানান। পরে শ্রোতাদের অনুরোধে তিনি আবু হায়দার সাজেদুর রহমানের লেখা ও আজাদ রহমানের সুর করা সিনেমায় গাওয়া তার প্রথম গান ‘বন্দী পাখির মতো মনটা কেঁদে মরে’ গেয়ে শোনান। গানটি ছিল ১৯৬৯ সালে মুক্তি পাওয়া বাবুল চৌধুরী পরিচালিত আগন্তুক সিনেমায়।
শিল্পী ফরিদা পারভীন বললেন, আধুনিক প্রযুক্তি অনেক অগ্রসর হয়েছে। কিন্তু আদি রেকর্ডগুলোর ভিন্ন আবেদন আছে। এই রেকর্ডগুলো সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। ব্যক্তিগত সংগ্রাহকেরা এবং রেকর্ড বিক্রেতারা মিলে এই যে উদ্যোগ নিয়েছেন তা খুবই প্রশংসনীয়। তিনি একই সঙ্গে নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের জনপ্রিয়তার জন্য উদ্গ্রীব না হয়ে সাধনার প্রতি মনোযোগী হতে পরামর্শ দেন।
অনুষ্ঠানে উপমহাদেশের লেক সংগীতের পথিকৃত শিল্পী আব্বাস উদ্দিন আহমদকে বিশেষ সম্মানা জানান হয়। শিল্পীর পরিবারের পক্ষে অডিওফাইলের যুগ্ম সম্পাদক পরিতোষ কুমার দেব ক্রেস্ট গ্রহণ করেন।
অনুষ্ঠানে ইউনিভার্সেল মিউজিক, সুরসপ্তক, মিউজিক গার্ডেন, এনালক বিট ও ভাইনাইল এলপি বাংলাদেশ নামের পাঁচটি স্টল রয়েছ। এগুলোর কয়েকটি বাণিজ্যিক বিক্রেতাদের আর কয়েকটি ব্যক্তিগত সংগ্রাহকের। দেশি বিদেশি অনেক শিল্পীদের গান, নাটক, আবৃত্তিসহ বিভিন্ন ধরনের প্রায় ছয় হাজারের মতো এলপি ও ইপির সমাহার রয়েছে এখানে। এলপি গুলোর দাম নির্ভর করে এগুলোর প্রাপ্যতা ও শিল্পীর। মোটামুটি ভাবে এলপির দাম এক হাজার টাকা থেকে শুরু। ইপির দাম তিনশ টাকা থেকে শুরু।
রেকর্ড ছাড়াও একটি দুর্লভ’ ফোনোগ্রাফ’ যন্ত্র প্রদর্শন করেছেন রেকর্ড সংগ্রাহক সৈয়দ আবদুল কাবী। এটি ১৮৮৮ সালে তৈরি করা। টমাস আলভা এডিসন উদ্ভাবিত যে আদি ফোনোগ্রাফ যন্ত্রগুলো বাজারজাত করা হয়েছিল এই যন্ত্রটি তারই একটি। সিলিন্ডার লাগানোর পরে দিব্বি বেজে যাচ্ছে সেগুলো।
টমাস আলভা এডিসন শব্দ ধারণ যন্ত্র আবিষ্কার করেছিলেন ১৮৭৭ সালে। প্রথমে এর নাম ছিল ‘ফোনোগ্রাফ’। এতে শব্দ ধরান করা হতো মোম লাগানো চোঙ বা সিলিন্ডারের ওপর। পরে গ্রামোফোন যন্ত্রের শব্দ রোকর্ড করা হয় লক্ষার চাকতি এবং তার পরে ভাইনাইলের চাকতিতে। এই ভাইনাইল চাকতি লংপ্লে (এলপি) বা এক্সটেন্ড প্লে (ইপি) নামে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বিশং শতকের সত্তর দশক পর্যন্ত ভাইনাইল রেকর্ড তথা এলপি/ইপি রেকর্ডের সোনালি যুগ। আমাদের দেশে সাধারণ লোকের কাছে এর পরিচিতি ছিল ‘কলের গান’। হিজ মাস্টার্স ভয়েসের (এইচএমভি) কুকুরে ছাপ্পা দেওয়া কালোর রঙের ভাইনাইল রেকর্ডের দুই পিঠে গান থাকত (আরপিএম অনুসারে) দুইটি থেকে দশটি পর্যন্ত। টার্ন টেবিলে রেকর্ড চড়িয়ে তার ওপর পিন বসিয়ে ঘুরিয়ে দিলে চোঙের মতো শব্দপ্রক্ষেপন যন্ত্র থেকে শোনা যেত প্রিয় শিল্পীর গান।
সময়ের পরিক্রমায় উন্নত হলো প্রযুক্তি। এল অডিও ক্যাসেটের যুগ। কমে গেল ভাইনাইল রেকর্ডের বিক্রি। ক্যাসেটে সেই জোয়ারে ভাটা পড়ল সিডির আগমনে। অডিও ক্যাসেট বিলুপ্তই বলা চলে। সিডিরও দিনকাল সুবিধে নয়। এখন চলছে স্ট্রিমিং এর জয়যাত্রা। স্পটিফাই, ইউটিউব মিউজিক, টাইডালসহ বিভিন্ন মাধ্যমের দাপটে সিডিও বিলুপ্তির পথে। তবে প্রযুক্তি উন্নত হলেও অননুমোদিত কপি আর পাইরেসির উৎপাতে পুঁজি হারাতে শুরু করে রেকর্ডিং কোম্পানিগুলো। সম্মানি হারাতে শুরু করেন শিল্পীরা। গানের বাজারে ধস নেমে আসে।
কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই ১৯৭৩ থেকে ১৯৮০ পর্যন্ত যেখানে ভাইনাইল রেকর্ড বিক্রি হয়েছে ২৫০ থেকে ৩৫০ মিলিয়ন। ২০০৬ সালে তা নেমে আসে মাত্র এ মিলিয়ন বা ১০ লাখে। এরপর থেকেই ভাইনাইল রেকর্ডের প্রচার প্রসার আবার বাড়ানোর লক্ষ্যে মূলত উৎপাদক ও বিক্রেতারাই উদ্যোগ নেন। শুরু হয় রেকর্ড স্টোর ডে পালনের উদ্যোগ। এখন এলপি রেকর্ডের বিক্রি বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রে ২০২২ সালে রেকর্ড বিক্রির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪১ মিলিয়নে। বিশ্বের অন্যান্য দেশেও রেকর্ড বিক্রি বাড়ছে।
আয়োজকেরা জানালেন, এনালগ পদ্ধতির ভাইনাইল রেকর্ডকে বলা হয় শুদ্ধ মাধ্যম। এতে শ্রোতারা শিল্পীর সামনে বসে গান শোনার অনুভূতি পেয়ে থাকেন। ফলে রেকর্ডে গান শোনার অভিজ্ঞতাই আলাদা। তা ছাড়া এই রেকর্ডগুলো বহু বছর অবদি হুবহু একই রকম থাকে। সে তুলনায় সিডি খুব বেশি দিন টেকে না, শব্দের মানও অনেক ক্ষেত্রে অক্ষুণ্ন থাকে না। এসব কারণে এলপি রেকর্ডের প্রতি শ্রোতাদের আগ্রহ আবার বাড়ছে। এই মাধ্যমটিকে আবার পুনরুজ্জীবিত করতে সংগীতানুরাগীরা তাদের এই উদ্যোগ অব্যাহত রাখবেন বলে জানালেন।