নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে দেশে বছরে প্রায় ২৪ হাজার শিশুর মৃত্যু হচ্ছে। বয়স পাঁচ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই এমন মৃত্যু হচ্ছে। বৈশ্বিক হারের চেয়ে দেশে নিউমোনিয়ায় শিশুমৃত্যুর হার অনেক বেশি। কয়েক বছর ধরে এ ক্ষেত্রে অগ্রগতি থেমে আছে।
দেশের নিউমোনিয়া পরিস্থিতি নিয়ে এ তথ্য জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) বিজ্ঞানীরা। গতকাল বৃহস্পতিবার আইসিডিডিআরবির সম্মেলনকক্ষে আয়োজিত ‘শিশুদের নিউমোনিয়া: আমরা কি যথেষ্ট করছি?’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে বিজ্ঞানীরা এসব তথ্য জানান। ১২ নভেম্বর বিশ্ব নিউমোনিয়া দিবস সামনে রেখে আইসিডিডিআরবি এ অনুষ্ঠান আয়োজন করে। আয়োজন ছিল মূলত সাংবাদিকদের জন্য।
প্রথম উপস্থাপনায় ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিশু বিভাগের সাবেক প্রধান ও বিশিষ্ট শিশুরোগবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবিদ হোসেন মোল্লা নিউমোনিয়া কী কারণে হয় তার বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া নিউমোনিয়ার কারণ। ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া ফুসফুসের রক্তনালিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এর ফলে ফুসফুসের অক্সিজেন গ্রহণের ক্ষমতা কমে যায়, রক্তে অক্সিজেন–স্বল্পতা দেখা দেয়। তিনি বলেন, ‘শুধু অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করে নিউমোনিয়ার রোগী ভালো হয় না। রোগীকে দিতে হয় পর্যাপ্ত অক্সিজেন।’
যেকোনো বয়সের মানুষের নিউমোনিয়া হতে পারে। তবে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের এবং বয়স্ক ব্যক্তিদের ঝুঁকি বেশি। আবিদ হোসেন মোল্লা বলেন, ‘পাঁচ বছরের কম বয়সীর ঝুঁকি বেশি, তার চেয়ে বেশি ঝুঁকি এক বছরের কম বয়সী শিশুর, তার চেয়ে বেশি ঝুঁকি নবজাতকের।’
অনুষ্ঠানে একাধিক আলোচকের বক্তব্যে নিউমোনিয়া চিকিৎসায় অক্সিজেনের গুরুত্ব উঠে আসে। তাঁরা বলেন, অক্সিমিটার দিয়ে সহজে রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ মাপা যায়। শিশু বা যে কারও রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছানোর আগেই রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করার পরামর্শ দেন তাঁরা।
দ্বিতীয় উপস্থাপনায় আইসিডিডিআরবির জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী মোহাম্মদ জোবায়ের চিশতী বলেন, ২০২২ সালে সারা বিশ্বে পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রায় ৫০ লাখ শিশুর মৃত্যু হয়েছিল। এর ১৪ শতাংশ ছিল নিউমোনিয়ায় মৃত্যু। একই সময়ে বাংলাদেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রায় এক লাখ শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ২৪ হাজার বা ২৪ শতাংশ ছিল নিউমোনিয়ায় মৃত্যু। এতে দেখা যাচ্ছে, নিউমোনিয়ায় শিশুমৃত্যুর বৈশ্বিক হারের চেয়ে বাংলাদেশে মৃত্যুহার বেশি। গত চার–পাঁচ বছর মৃত্যুর সংখ্যা একই আছে। পরিস্থিতির উন্নতি দেখা যাচ্ছে না।
অপুষ্টি, অপরিণত শিশুর জন্ম, ঘরের মধ্যে বায়ুদূষণ, অ্যান্টিবায়োটিকের অকার্যকর হয়ে পড়া এবং রক্তে অক্সিজেনের স্বল্পতা ঠিক সময়ে শনাক্ত করতে না পারা—এগুলো নিউমোনিয়ায় মৃত্যুঝুঁকি বাড়ায় বলে মন্তব্য করেন মোহাম্মদ জোবায়ের চিশতী। তিনি বলেন, যেসব ব্যাকটেরিয়ার কারণে নিউমোনিয়া হয়, সেগুলো প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিক–প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে। এটি বড় ধরনের সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে।
আইসিডিডিআরবি সারা বিশ্বে ডায়রিয়া নিয়ে গবেষণার জন্য বিখ্যাত। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রতিষ্ঠানটি নিউমোনিয়া নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু গবেষণা করেছে। অনুষ্ঠানে এসব গবেষণার ফলাফল তুলে ধরা হয়। পাশাপাশি নিউমোনিয়া প্রতিরোধ বা নিউমোনিয়া চিকিৎসার বেশ কিছু কার্যকর পন্থা নিয়ে আলোচনা হয়।
মোহাম্মদ জোবায়ের চিশতী বলেন, ঘরের ভেতরের বায়ুর মান উন্নত করে নিউমোনিয়ায় মৃত্যু অর্ধেক করা যায়, হাত ধোয়ার অভ্যাস ২১ শতাংশ মৃত্যু কমায়, জন্মের পর প্রথম ছয় মাস শিশু শুধু মায়ের দুধ খেলে নিউমোনিয়ায় মৃত্যু ১৫ শতাংশ কমে।
দেখা যায়, শয্যার অভাবে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুকে হাসপাতালে ভর্তি করা যায় না। আবার অনেক মা শিশুকে নিয়ে হাসপাতালে থাকতেও পারেন না। এই সমস্যা সমাধানে হাসপাতালে ‘দিবা যত্ন কেন্দ্র’ সমাধান হতে পারে বলে আইসিডিডিআরবি মনে করছে। এ নিয়ে সীমিতসংখ্যক হাসপাতালে গবেষণা করে সুফল পাওয়া গেছে।
অনুষ্ঠানের শুরুতে আইসিডিডিআরবির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক তাহমিদ আহমেদ বলেন, গবেষণার পাশাপাশি প্রশিক্ষণ ও চিকিৎসায় গুরুত্ব দেয় আইসিডিডিআরবি। আইসিডিডিআরবির হাসপাতালকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার চেষ্টা চলছে। প্রতিষ্ঠানের গবেষণাকে নীতিনির্ধারকদের কাছে তুলে ধরার জন্য পৃথক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।