মানি লন্ডারিং অপরাধ-২

মামলায় বেশি আসামি ব্যবসায়ী-ব্যাংকার

আর্থিক খাতে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর কার্যকর পদক্ষেপের ঘাটতির কারণে ব্যবসায়ী–ব্যাংকাররা মানি লন্ডারিং অপরাধে জড়িয়েছেন সবচেয়ে বেশি।

মানি লন্ডারিং আইনে তিন পেশার মানুষের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে। তাঁরা হচ্ছেন অসাধু ব্যবসায়ী, ব্যাংকার ও সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারী। তবে মামলা ও আসামির তালিকায় শীর্ষে রয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এঁদের অনেকে এমএলএম, আমদানি–রপ্তানি, ই-কমার্সসহ নানা ব্যবসায় জড়িত। এ পর্যন্ত নিষ্পত্তি হওয়া মামলায় সাজাও বেশি হয়েছে ব্যবসায়ীদের। আসামির তালিকায় এরপরই আছেন ব্যাংকার ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী। পাশাপাশি এই আইনে রাজনৈতিক নেতাদের নামেও মামলা রয়েছে।

আইন, প্রশাসন ও আর্থিক খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মানি লন্ডারিংয়ে ব্যবসায়ী–ব্যাংকারদের জড়িত থাকার সবচেয়ে বড় কারণ আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং দুর্নীতি প্রতিরোধে কাজ করা সংস্থাগুলোর নজরদারি ও জবাবদিহির অভাব। এর বাইরে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। তা ছাড়া এ অপরাধে জড়িত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির নজির কম। এতে দেশে মানি লন্ডারিংয়ের অপরাধ দিন দিন বাড়ছে।

লোভে পড়ে অনেক ব্যাংক কর্মকর্তা আপস করেন, জালিয়াতির আশ্রয় নেন। এতে অসৎ ব্যবসায়ীরা খুশি হন। তাঁরা ব্যাংক কর্মকর্তাদের প্রলোভনের ফাঁদে ফেলে ঋণ নেন, কিন্তু ফেরত দেন না। তখন কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ী—দুজনই ধরা পড়েন।’
আনিস এ খান, অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান

গত ২০ বছরে সারা দেশে দায়ের হওয়া মানি লন্ডারিং–সংক্রান্ত অভিযোগে ৭৫২টি মামলার তথ্য মিলেছে। এর মধ্যে দুই শতাধিক মামলার নথিপত্র প্রথম আলো পর্যালোচনা করেছে। এতে দেখা গেছে, মানি লন্ডারিং আইনে ১৭ ধরনের অপরাধের অভিযোগে মামলা তুলনামূলক বেশি। প্রায় ৩০ শতাংশ অভিযোগ হচ্ছে, জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাংকসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ আত্মসাৎ। এ ছাড়া ঘুষ–দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ২২ শতাংশ, প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে ১৪ শতাংশ এবং আমদানি–রপ্তানির নামে মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে ১৩ শতাংশ মামলা রয়েছে। এ ছাড়া এমএলএম, ই–কমার্স, হুন্ডি, সোনা চোরাচালানসহ নানা অভিযোগে আরও ২১ শতাংশ মামলা হয়েছে।

৬৭ শতাংশ আসামি ব্যবসায়ী-ব্যাংকার

সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরদারির অভাবের সুযোগ নিয়ে নামসর্বস্ব কাগুজে কোম্পানি বানিয়ে ব্যাংকসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে ঋণের নামে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে একশ্রেণির ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে। পাশাপাশি জাল কাগজপত্র তৈরি করে আমদানি–রপ্তানির নামে বিদেশে অর্থ পাচার করা হয়েছে বলে দুদক, সিআইডিসহ ছয়টি তদন্ত সংস্থার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

মানি লন্ডারিংয়ের ৭৫২ মামলার মধ্যে ৫০৬টিতে ব্যবসায়ী, ব্যাংকারসহ অন্যান্য পেশার মানুষ আসামি রয়েছেন। প্রথম আলোর অনুসন্ধানে ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি চারটি রাষ্ট্রায়ত্ত, ২৩টি বেসরকারি ব্যাংকসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ১৪২ কর্মকর্তাকে আসামি করার তথ্য পাওয়া গেছে। তাঁদের মধ্যে ব্যাংকসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ৫ জন চেয়ারম্যান, ৫ জন ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ৪ জন মহাব্যবস্থাপক, ৬ জন উপমহাব্যবস্থাপক ও সহকারী উপমহাব্যবস্থাপক, ১৭ জন সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট, ৬ জন ভাইস প্রেসিডেন্ট, ৮ জন সহকারী ভাইস প্রেসিডেন্ট রয়েছেন।

সরকারি কর্মচারীদের পাশাপাশি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। অনেক সরকারি দপ্তর আছে, যেখানে কে কত টাকা ভাগ পাবেন, তা নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা হয়। এ টাকার ভাগ রাজনৈতিক নেতাদের কাছেও যায়।
গোলাম রহমান, দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান

২০১৬ সালে এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপ অন মানি লন্ডারিংয়েরও (এপিজে) পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, বাংলাদেশের মানি লন্ডারিংয়ের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ খাত হচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক। সোনালী ব্যাংক, বেসিক ব্যাংকসহ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে বেশি জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে।

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক প্রেসিডেন্ট আবুল কাসেম খান প্রথম আলোকে বলেন, ব্যাংক, বিমা, ইনস্যুরেন্স, ই-কমার্সসহ আর্থিক খাতে কার্যকর নজরদারি থাকলে একের পর এক অর্থ আত্মসাৎ ও মানি লন্ডারিংয়ের ঘটনা ঘটত না। আবার অসৎ ব্যবসায়ীসহ মানি লন্ডারিংয়ে জড়িত অন্য পেশার মানুষের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলে অন্যরা ভয় পেত। কিন্তু সেটি তো হচ্ছে না।

২০১৫ সালে জনতা ব্যাংকের পুরান ঢাকার ইমামগঞ্জ শাখা থেকে ৪৮৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে বিদেশে পাচারের অভিযোগে রিমেকস ফুটওয়্যারের মালিক আবদুল আজিজের বিরুদ্ধে মামলা হয়। তাঁকে মানি লন্ডারিংয়ে সহযোগিতার অভিযোগে জনতা ব্যাংকের তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক কাজী রইস উদ্দিনসহ ১৩ কর্মকর্তাকে আসামি করা হয়। ওই ঋণ অনুমোদনের সময় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে ছিলেন সরকারদলীয় কয়েকজন নেতা। মামলাটির তদন্ত এখনো চলছে।

একইভাবে রপ্তানির নামে জনতাসহ চারটি ব্যাংক থেকে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ২০১৩ সালে বিসমিল্লাহ গ্রুপের খাজা সোলেমান আনোয়ার চৌধুরীসহ প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ১২টি মানি লন্ডারিং আইনে মামলা হয়। এসব মামলায় বিসমিল্লাহ গ্রুপের ১৩ জন, জনতা ব্যাংকসহ পাঁচটি ব্যাংকের ৪০ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। ২০১৮ সালে একটি মামলায় খাজা সোলেমান, জনতা ব্যাংকের দুই কর্মকর্তাসহ নয়জনের সাজাও হয়।

‘রাষ্ট্রক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত অনেকে বিদেশে টাকা নিয়ে যাচ্ছেন। যাঁরা অপরাধ করছেন, তাঁদের ধরা হচ্ছে না। আইন অনুযায়ী সবকিছু চললে এমন হতো না। দেশের টাকা বাইরে চলে যাবে, আর কিছু হবে না, তা তো হয় না।’
শফিক আহমেদ, সাবেক আইনমন্ত্রী

২০১৮ সালে এবি ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান এম ওয়াহিদুল হকসহ ব্যাংকটির শীর্ষস্থানীয় আট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুবাইয়ে মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে মামলা হয়। অভিযোগপত্রে তাঁদের বিরুদ্ধে দুবাইয়ে ১৬৫ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ আনা হয়। মামলাটি সাক্ষ্য গ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে।

অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান আনিস এ খান প্রথম আলোকে বলেন, লোভে পড়ে অনেক ব্যাংক কর্মকর্তা আপস করেন, জালিয়াতির আশ্রয় নেন। এতে অসৎ ব্যবসায়ীরা খুশি হন। তাঁরা ব্যাংক কর্মকর্তাদের প্রলোভনের ফাঁদে ফেলে ঋণ নেন, কিন্তু ফেরত দেন না। তখন কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ী—দুজনই ধরা পড়েন।’

ঘুষ–দুর্নীতির ১৭১ মামলা

ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদ অর্জনে অপরাধে ১৭১টি মানি লন্ডারিং মামলার তথ্য মিলেছে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে এ ধরনের মামলা বেশি। এসব মামলায় ১৩৭ সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারী আসামি বলে জানা গেছে। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে (১৭টি মামলা) বেশি আসামি প্রকৌশলী। এ ছাড়া আছেন পুলিশের শীর্ষস্থানীয় তিন কর্মকর্তা, দুই কারা কর্মকর্তা ও বিচার বিভাগের দুই কর্মকর্তা।

আইন ও বিচারপ্রক্রিয়ায় যুক্ত ব্যক্তি এবং দুর্নীতিবিরোধী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা মনে করেন, সরকারের প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে অনিয়ম–দুর্নীতি হয়। কিন্তু সরকারের দুর্নীতি প্রতিরোধে কাজ করা প্রতিষ্ঠানের যথাযথ নজরদারি ও কার্যকর পদক্ষেপের অভাবে একশ্রেণির কর্মকর্তা–কর্মচারী অনিয়ম–দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন।

অনেক ব্যাংকার ও ব্যবসায়ী মানি লন্ডারিংয়ে জড়িত। এসব কেলেঙ্কারির তথ্য তো বাংলাদেশ ব্যাংকের জানা থাকার কথা। এসব মামলায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলে এ ধরনের অপরাধ কমবে।
সালেহউদ্দিন আহমেদ, সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক

তাঁদের অবৈধ সম্পদের তথ্য সংগ্রহের সরকারি কার্যকর ব্যবস্থাও কম। আবার রাষ্ট্রের প্রভাবশালী একটি মহলের কারণে তাঁদের আইনের আওতায়ও আনা যাচ্ছে না। ফলে ঘুষ–দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জন করেও অনেক কর্মকর্তা–কর্মচারী ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছেন।

২০১৭ সালে ফরিদপুরের তৎকালীন পুলিশ সুপার (এসপি) সুভাষ চন্দ্র সাহার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মাধ্যমে ৮ কোটি টাকার সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদক মামলা করে। মামলার অভিযোগ, পুরান ঢাকার একটি ব্যাংকের শাখায় তাঁর ও তাঁর স্ত্রী রীনা চৌধুরীর ছয়টি স্থায়ী আমানতে (এফডিআর) ২ কোটি ৮১ লাখ টাকা তথ্য মিলেছে। একই ব্যাংকের যশোর শাখায়ও তাঁদের ১২টি এফডিআরে ৫ কোটি ৩৩ লাখ টাকা জমা ছিল। মামলাটি এখনো তদন্তের পর্যায়ে রয়েছে।

রেঞ্জ রিজার্ভ ফোর্সের তৎকালীন কমান্ড্যান্ট পুলিশ সুপার মীজানুর রহমানের বিরুদ্ধেও চার বছর আগে মানি লন্ডারিং আইনে দুটি মামলা হয়। দুর্নীতির মাধ্যমে তিনি ৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা অর্জন করেন। দুটি মামলারই তদন্ত চলছে।

২০১১ সালের ২৪ জুন তৎকালীন অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আবদুস সালামের বিরুদ্ধে ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে প্রায় সাড়ে ৫ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন ও বিদেশে মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে মামলা হয়। মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়, তাঁর ব্যাংক হিসাবে প্রায় সাড়ে ৪ কোটি টাকা জমা ছিল। মামলাটির বিচারাধীন।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা বিচারপতি ফজলুল হকের ছেলে চিকিৎসক আফজাল হোসেনের বিরুদ্ধে সরকারি কর্মকর্তাদের বদলি–বাণিজ্যের মাধ্যমে ১০ কোটি ৬১ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ২০০৮ সালে মানি লন্ডারিং আইনে মামলা করে দুদক। মামলায় অভিযোগ করা হয়, তাঁর বাবা বন, ভূমি, আইন ও বিচারবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা থাকাকালে আফজালের বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে বিপুল পরিমাণ টাকা জমা হয়। মামলাটি সাক্ষ্য গ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে।

দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি কর্মচারীদের পাশাপাশি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। অনেক সরকারি দপ্তর আছে, যেখানে কে কত টাকা ভাগ পাবেন, তা নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা হয়। এ টাকার ভাগ রাজনৈতিক নেতাদের কাছেও যায়। তিনি মনে করেন, দেশে দুর্নীতির অন্যতম কারণ রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীদের আঁতাত। এখান থেকে বেশির ভাগ দুর্নীতির জন্ম। পুরো ব্যবস্থাতেই গলদ।

বিরোধী শীর্ষ রাজনীতিকেরাই আসামি

গত দুই দশকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতার বিরুদ্ধে ৩৫টি মানি লন্ডারিং মামলার তথ্য পাওয়া গেছে। এসব মামলার আসামিদের মধ্যে বিভিন্ন দলের ১১ শীর্ষ রাজনীতিক রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে বিএনপির সাতজন, আওয়ামী লীগের দুজন ও জাতীয় পার্টির একজন। স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য আছেন একজন।

আসামিদের তিনজন বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের মন্ত্রীও ছিলেন। দলটির চার নেতার বিরুদ্ধে বিদেশে মানি লন্ডারিং এবং বাকি তিনজনের বিরুদ্ধে ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ আনা হয়েছে। পলাতক অবস্থায় দণ্ডিত হন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান। তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয় ২০০৭ সালে। বাকি ছয়জনের বিরুদ্ধে মামলা হয় ২০১১ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে।

আসামির তালিকায় থাকা বিএনপির অন্য ছয় নেতা হলেন সাবেক মন্ত্রী এম মোর্শেদ খান, আমিনুল হক (মৃত), খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী (মৃত) ও হাফিজ ইব্রাহীম।

দুর্নীতিবিরোধী দেশ-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, গত ২০ বছরে যাঁরা ক্ষমতায় ছিলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে এ আইনে মামলা হয়েছে খুবই কম। বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের অনেক প্রভাবশালী নেতার বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর এলেও সেসবের অনুসন্ধান বা তদন্ত হচ্ছে না। বরং বিরোধী রাজনীতিকদের মামলায় জড়ানোর প্রবণতা বেশি দেখা যায়। এর ফলে রাজনীতিকে ব্যবহার করে যাঁরা বিদেশে মানি লন্ডারিং করেছেন, তাঁদের বিচারের আওতায় আনা হচ্ছে না।

এ ছাড়া পিরোজপুর-১ আসনের সরকারদলীয় সংসদ সদস্য এ কে এম আবদুল আওয়ালের বিরুদ্ধে দুই বছর আগে মানি লন্ডারিং মামলা হয়। বগুড়া-২ আসনের জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য শরীফুল ইসলামের বিরুদ্ধে গত বছর একই অভিযোগে মামলা হয়।

সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাষ্ট্রক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত অনেকে বিদেশে টাকা নিয়ে যাচ্ছেন। যাঁরা অপরাধ করছেন, তাঁদের ধরা হচ্ছে না। আইন অনুযায়ী সবকিছু চললে এমন হতো না। দেশের টাকা বাইরে চলে যাবে, আর কিছু হবে না, তা তো হয় না।’

এমএলএম, ই-কমার্সে ও প্রশ্নপত্র ফাঁসে মানি লন্ডারিং

বহুস্তর বিপণনের (এমএলএম) নামে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে আত্মসাতের অভিযোগ বেশ পুরোনো। এসব অভিযোগে ডেসটিনি–২০০০, ইউনিপে টু ইউ, যুবকসহ বিভিন্ন এমএলএম কোম্পানির মালিকদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, সাজাও হয়েছে। এর বাইরে মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির নামে মানুষ থেকে অর্থ নিয়ে আত্মসাৎ করা হয়েছে। তবে নতুন করে বেশি লাভের প্রলোভন দেখিয়ে ই–কমার্সের নামে মানুষের কাছ থেকে বিপুল অঙ্কের টাকা আত্মসাতের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। একইভাবে বিগত কয়েক বছরে সরকারি–বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি ও স্কুল–কলেজ–মেডিকেল–বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রশ্নপত্র ফাঁস করে একাধিক চক্র বিপুল অঙ্কের টাকার মালিক হয়েছে।

গত ২০ বছরে এমএলএম ব্যবসার মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে মানি লন্ডারিংয়ের ১৮টি মামলার খোঁজ পাওয়া গেছে। এসব মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, এলএলএম ব্যবসার নামে ৫ হাজার কোটি টাকার সম্পদ অর্জন করেছে একাধিক চক্র।

প্রতারণার মাধ্যমে ২৫০ কোটি টাকা আত্মসাৎ ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে ইউনিপে টু ইউর শহিদুজ্জামানের বিরুদ্ধে ২০১১ সালে মামলা হয়। ওই মামলায় ২০১৯ সালে তিনিসহ ছয়জনের সাজা হয়।

এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করে ১৩৪ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে ঢাকায় চারটি মানি লন্ডারিংয়ের মামলা হয়েছে। এতে ৩৭ জনকে আসামি করা হয়। আসামির তালিকায় আছেন চিকিৎসক, ব্যাংক কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, অনেক ব্যাংকার ও ব্যবসায়ী মানি লন্ডারিংয়ে জড়িত। এসব কেলেঙ্কারির তথ্য তো বাংলাদেশ ব্যাংকের জানা থাকার কথা। এসব মামলায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলে এ ধরনের অপরাধ কমবে। (চলবে)