সারা বিশ্ব জৈবপ্রযুক্তির ওষুধের দিকে ঝুঁকছে। দেশে উৎপাদনের জন্য সরকারপক্ষের নীতি–সহায়তা দরকার।
জিন প্রকৌশল ও জৈবপ্রযুক্তি ব্যবহার করে দেশে প্রথম ওষুধ তৈরি করেছেন এক দল বিজ্ঞানী ও গবেষক। এই ওষুধ চিকিৎসকেরা ব্যবহারও করছেন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও ওষুধবিজ্ঞানীরা বলছেন, নতুন এই উদ্যোগ সহায়তা পেলে দেশের ওষুধশিল্প আরও সমৃদ্ধ হবে।
দেশে প্রথম এই ‘বায়োলজিক ওষুধ’ তৈরিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন করোনার টিকা ‘বঙ্গভ্যাক্স’ আবিষ্কারক কোষবিজ্ঞানী কাকন নাগ ও জিনবিজ্ঞানী নাজনীন সুলতানা। এই বিজ্ঞানী দম্পতির সঙ্গে আছেন আরও ১০ জন তরুণ গবেষক ও বিজ্ঞানী। তাঁরা জিন প্রকৌশল ও জৈবপ্রযুক্তি ব্যবহার করে দেশে ‘ইরাইথ্রোপোয়েটিন’ নামের ওষুধ তৈরি করেছেন। তাঁদের গবেষণায় সহায়তা করেছে গ্লোব বায়োটেক লিমিটেড নামের ওষুধ কোম্পানি। গ্লোবের ইরাইথ্রোপোয়েটিন একটি বাণিজ্যিক নামে এখন বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। উদ্ভাবিত প্রযুক্তির একটি গবেষণা প্রবন্ধ ২০২৩ সালের ২২ জুন ফার্মাসিউটিক্স নামের আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়।
এই সহায়ক উপাদানগুলো প্যারাসিটামলের কার্যকারিতা নষ্ট করে না বা শরীরের কোনো ক্ষতি করে না। এই ধরনের বহু রাসায়নিক ওষুধ বাজারে আছে।
বাজারে দুই ধরনের ওষুধ পাওয়া যায়—রাসায়নিক ওষুধ ও জৈবপ্রযুক্তির ওষুধ বা বায়োলজিক ওষুধ। রাসায়নিক ওষুধের উদাহরণ ‘প্যারাসিটামল’। এই ওষুধের মূল উপাদানকে বড়ি আকারে ব্যবহারযোগ্য করার জন্য আরও কিছু সহায়ক উপাদান ব্যবহার করা হয়। এই সহায়ক উপাদানগুলো প্যারাসিটামলের কার্যকারিতা নষ্ট করে না বা শরীরের কোনো ক্ষতি করে না। এই ধরনের বহু রাসায়নিক ওষুধ বাজারে আছে।
জৈবপ্রযুক্তি বা বায়োলজিক ওষুধ জীবন্ত কোষ বা ডিএনএ থেকে তৈরি হয়। ডায়াবেটিস চিকিৎসায় ব্যবহৃত ইনসুলিন বায়োলজিক ওষুধের উদাহরণ। করোনার টিকাও একধরনের বায়োলজিক ওষুধ।
দেশে তৈরি বায়োলজিক ওষুধ ইরাইথ্রোপোয়েটিন একটি প্রোটিন হরমোন। এই হরমোন তৈরি হয় শরীরের কিডনি ও যকৃৎ থেকে। এই হরমোন অস্থিমজ্জায় বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে লোহিত রক্তকণিকা তৈরি করে। কিডনি ও যকৃৎ ক্ষতিগ্রস্ত হলে শরীরে এই বিশেষ হরমোন উৎপাদন কমে যায় বা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে লোহিত রক্তকণিকা তৈরি বাধাগ্রস্ত হয় অথবা একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। সে কারণে মানুষ রক্তস্বল্পতায় ভোগে। রক্তস্বল্পতার কারণে শরীরে নিয়মিত অক্সিজেন ঘাটতি দেখা দেয়। এতে মৃত্যু পর্যন্ত হয়। এর চিকিৎসায় বাজারে রাসায়নিক ও বায়োলজিক ওষুধ আছে। তবে এর চিকিৎসায় প্রথম দেশেই তৈরি হলো বায়োলজিক ওষুধ ইরাইথ্রোপোয়েটিন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য (শিক্ষা) ও ফার্মেসি বিভাগের অধ্যাপক সীতেশ চন্দ্র বাছার প্রথম আলোকে বলেন, ‘কাকন নাগ ও তাঁর দল বাংলাদেশের ওষুধশিল্প ও চিকিৎসার জন্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। তাঁদের আগে বাংলাদেশে জিন প্রকৌশল ও জৈবপ্রযুক্তিভিত্তিক ওষুধ কেউ তৈরি করেননি। এ থেকে এটা প্রমাণিত যে বাংলাদেশের বিজ্ঞানী, গবেষক ও ওষুধ কোম্পানি বায়োলজিক ওষুধ তৈরি করতে সক্ষম।’
এই হরমোন অস্থিমজ্জায় বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে লোহিত রক্তকণিকা তৈরি করে। কিডনি ও যকৃৎ ক্ষতিগ্রস্ত হলে শরীরে এই বিশেষ হরমোন উৎপাদন কমে যায় বা বন্ধ হয়ে যায়।
কাকন নাগ ও তাঁর গবেষক দলের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রথমে মানুষের কিডনি কোষ থেকে ইরাইথ্রোপোয়েটিন উৎপাদনকারী জিন পৃথক করা হয়। তারপর বেশ কয়েকটি ধাপ অতিক্রম করে ইরাইথ্রোপোয়েটিন উৎপাদনকারী কোষের ক্লোন (প্রতিলিপি) তৈরি করা হয় এবং এর সংখ্যা বহুগুণ বাড়ানো হয়। এরপর সবচেয়ে ভালো মানের ইরাইথ্রোপোয়েটিন উৎপাদনকারী ক্লোনের মজুত গড়া হয়। পুরো প্রক্রিয়া জিন প্রকৌশলের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়।
ওই ক্লোনের মজুতকে সংরক্ষণ করে, বাঁচিয়ে রেখে, ব্যবহার উপযোগী করে ইরাইথ্রোপোয়েটিন উৎপাদন করা হয় যে প্রযুক্তির মাধ্যমে, সেটি জৈবপ্রযুক্তি। এভাবে বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের জন্য ইরাইথ্রোপোয়েটিন উৎপাদন করা হচ্ছে। দেশের গবেষকেরা দেশে কিডনি রোগ, রক্তস্বল্পতার এই ওষুধ তৈরি করেছেন।
কাকন নাগ ও তাঁর দল বাংলাদেশের ওষুধশিল্প ও চিকিৎসার জন্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। তাঁদের আগে বাংলাদেশে জিন প্রকৌশল ও জৈবপ্রযুক্তিভিত্তিক ওষুধ কেউ তৈরি করেননি। এ থেকে এটা প্রমাণিত যে বাংলাদেশের বিজ্ঞানী, গবেষক ও ওষুধ কোম্পানি বায়োলজিক ওষুধ তৈরি করতে সক্ষম।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য (শিক্ষা) ও ফার্মেসি বিভাগের অধ্যাপক সীতেশ চন্দ্র বাছার
২০২১ সালে সরকারের ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অনুমোদন নিয়ে ইরাইথ্রোপোয়েটিনের ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা করেন দেশের খ্যাতিমান গবেষকেরা। ১৮ বছরের বেশি বয়সী ৪২ জন মানুষের শরীরে তা প্রয়োগ করা হয়। পরীক্ষায় দেখা যায়, উৎপাদিত ওষুধটি মানসম্পন্ন, নিরাপদ ও কার্যকর।
২০২৩ সালে গ্লোব বায়োটেক লিমিটেডের কারখানায় তৈরি ওষুধটি বাজারজাত করার অনুমোদন দিয়েছে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। সীমিত আকারে হলেও দেশে ওষুধটির ব্যবহার শুরু হয়েছে। এ বিষয়ে একটি গবেষণা প্রবন্ধ ২০২৩ সালের ১ আগস্ট আর্কাইভস অব ক্লিনিক্যাল অ্যান্ড বায়োমেডিকেল রিসার্চ নামের আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের হেমাটোলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান আলমগীর কবির তাঁর রোগীদের দেশে তৈরি এই ওষুধ ব্যবহারের পরামর্শ দিচ্ছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি রোগীদের ওষুধটি দিচ্ছি। এখনো কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা কানে আসেনি। ওষুধটি কতটা কার্যকর, তা বলার জন্য আরও কিছু সময়ের দরকার আছে।’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়েও ওষুধটি ব্যবহৃত হচ্ছে বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশ ওষুধে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। দেশে ব্যবহৃত ওষুধের ৯৭ শতাংশ তৈরি করে দেশি ওষুধ কোম্পানিগুলো। দেশে ব্যবহৃত বায়োলজিক ওষুধ বেশির ভাগ আসে বিদেশ থেকে। যদিও বিশ্বজুড়ে প্রবণতা বায়োলজিক ওষুধ উদ্ভাবন ও উৎপাদনের দিকে।
বাংলাদেশ অন্য দেশে উদ্ভাবিত ওষুধ তৈরি করছে। মেধাস্বত্বের জন্য কোনো অর্থ বাংলাদেশকে দিতে হয় না। সে কারণে বাংলাদেশে কম খরচে এখনো ওষুধ উৎপাদন করতে পারছে। কিন্তু ২০২৬ সালে এলডিসিতে উত্তরণের পর বাংলাদেশকে প্রতিটি ওষুধের মেধাস্বত্বের জন্য বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হতে পারে। তখন ওষুধের দাম বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকবে। দেশেই ওষুধ উদ্ভাবন করা সম্ভব হলে খরচ অনেক কমবে।
কাকন নাগ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বায়োলজিক ওষুধ তৈরি করে আমরা বৈজ্ঞানিক জ্ঞান, সর্বসাম্প্রতিক প্রযুক্তিগত দক্ষতা প্রমাণ করেছি। আমরা মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি এবং ইনসুলিনসহ আরও অনেক বায়োলজিক ওষুধ তৈরি করতে পারব। শুধু দরকার সুষ্ঠু পরিবেশ, নীতি ও সহায়তা।’
আমি রোগীদের ওষুধটি দিচ্ছি। এখনো কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা কানে আসেনি। ওষুধটি কতটা কার্যকর, তা বলার জন্য আরও কিছু সময়ের দরকার আছে।ঢাকা মেডিকেল কলেজের হেমাটোলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান আলমগীর কবির