বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ও সংগঠন করার স্বাধীনতা সীমিত করেছে সরকার। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে। কোনো হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় স্বচ্ছ তদন্ত করেনি সরকার। থেমে নেই গুমের ঘটনাও। গত বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৬ জন গুম হয়েছেন। সরকার বারবার মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার লঙ্ঘন করায় হয়রানির ভয়ে অনেক গণমাধ্যম নিজেদের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে রেখেছে। ব্লগাররাও একই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ‘২০২২ কান্ট্রি রিপোর্টস অন হিউম্যান রাইটস প্র্যাকটিসেস’ শীর্ষক প্রতিবেদনের বাংলাদেশ অংশে এসব তথ্য উঠে এসেছে। গতকাল সোমবার মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ওয়েবসাইটে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। ১৯৮টি দেশ ও অঞ্চলের মানবাধিকার পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। এতে বাংলাদেশ অংশের শিরোনাম, ‘২০২২ কান্ট্রি রিপোর্টস অন হিউম্যান রাইটস প্র্যাকটিসেস: বাংলাদেশ’।
প্রতিবেদনে গত সংসদ নির্বাচনের বিষয়টিও উঠে আসে। এতে বলা হয়, ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের কাছে অবাধ ও সুষ্ঠু বলে বিবেচিত হয়নি। ওই নির্বাচনে সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভরানো; বিরোধী দলের প্রার্থীদের এজেন্টসহ ভোটারদের ভয় দেখানোসহ নানা অনিয়মের খবরে পর্যবেক্ষকেরা এমন ধারণা পোষণ করেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকারবিরোধী দলগুলোর জমায়েত নিষিদ্ধ করে চলেছে। জমায়েতের জন্য সরকারের কাছ থেকে পূর্বানুমতি নেওয়ার প্রয়োজনীয়তাকে অযৌক্তিক বলেছেন পর্যবেক্ষকেরা। মাঝেমধ্যে পুলিশ বা শাসকদলের সদস্যরা বিরোধী দল, সংগঠন ও কর্মীদের বিক্ষোভকে ছত্রভঙ্গ করতে বলপ্রয়োগ করেন।
বিরোধী দল বিএনপিকে নিয়মিত কর্মসূচি পালনের অনুমতি দেওয়া হয়নি বা তাদের কর্মসূচির ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ ও ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের দিক থেকে ভয়ভীতি দেখানো হয়েছে।
গত ১৭ সেপ্টেম্বর গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকায় নির্দিষ্ট স্থানে বিএনপির কর্মসূচি সীমাবদ্ধ রাখার নীতি গ্রহণ করেছে সরকার।
গত বছরের মার্চে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ২০২১-২২ সালের প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, বিরোধী রাজনৈতিক দল ও শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে বাধা দেওয়া হয়েছে। এই কাজে কিছু ক্ষেত্রে অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করা হয়েছে।
জ্বালানি-বিদ্যুৎ ইস্যুতে গত বছরের জুলাইয়ে ভোলায় বিএনপির বিক্ষোভ কর্মসূচিতে পুলিশের গুলিতে ১ জন নিহত ও অন্তত ৪০ জন আহত হন। পরে বিএনপির চার শতাধিক নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে দুটি মামলা করে পুলিশ।
গত সেপ্টেম্বরে রাজধানীর বনানী এলাকায় বিএনপির মোমবাতি প্রজ্বালন কর্মসূচিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কর্মীরা হামলা চালান। এতে দলটির বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মী আহত হন। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ও পুলিশের হাতে দলের তিন নেতা-কর্মী নিহত হওয়ার প্রতিবাদে বিএনপি এই কর্মসূচি দিয়েছিল।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটের রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা এই হামলার নিন্দা জানিয়ে দাবি করেন, এ ধরনের সহিংসতা দেশকে পিছিয়ে দিচ্ছে।
বিএনপির ভাষ্যমতে, সেপ্টেম্বরে দলটির ২২০ জনের বেশি সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দলের অন্তত ৪ হাজার ১০০ জনের নাম উল্লেখ করে ৬৫টি মামলা করেছে পুলিশ। এসব মামলায় অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে ২০ হাজার ৫০০ নেতা-কর্মীকে। ওই সময়ে তাঁদের নেতা-কর্মীদের বাড়িঘর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ভাঙচুরের অন্তত ৬০টি ঘটনা ঘটেছে। ক্ষমতাসীন দলের সদস্যরা এসব হামলায় জড়িত।
সংগঠনের অধিকার বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকারের এনজিও বিষয়ক ব্যুরো প্রায়ই বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) বিদেশি তহবিলের অনুমোদন আটকে রাখে বা বিলম্বিত করে। বিশেষ করে যারা মানবাধিকার, শ্রম-অধিকার, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর অধিকার, এলজিবিটিকিউআই+ অধিকার বা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মানবিক সহায়তার মতো বিষয় নিয়ে কাজ করে, তাদের ক্ষেত্রে এমনটা হয়েছে। সুশীল সমাজের অনেক সংস্থার দাবি, তারা ক্রমবর্ধমান তদন্ত ও আমলাতান্ত্রিক বিলম্বের মুখে পড়েছে।
আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অসংখ্য প্রতিবেদন পাওয়া গেছে। এমন হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সরকার স্বচ্ছ তদন্ত করে না। এমন কত ঘটনা ঘটছে, তা-ও প্রকাশ করে না সরকার।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পুলিশের নির্যাতনে কেউ নিহত কিংবা গুরুতর আহত হয়ে থাকলে তার তদন্ত প্রয়োজন। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের তদন্ত নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো। তাদের অভিযোগ, এসব হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন মানুষ। অল্প কিছু ঘটনায় সরকার দোষী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনছে। তবে দোষীরা সাধারণত প্রশাসনিক শাস্তি পাচ্ছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সন্ত্রাসী কার্যকলাপ, মাদক ও অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার ঠেকাতে সারা বছরই দেশে অভিযান চালায় নিরাপত্তা বাহিনী। অভিযানকালে কিংবা কাউকে গ্রেপ্তারের সময় নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটছে, যা সন্দেহজনক। নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা বলেন, তাঁদের হাতে আটক ব্যক্তিকে নিয়ে অস্ত্র কিংবা আটক ব্যক্তির সঙ্গীকে গ্রেপ্তারের অভিযানে গেলে সন্ত্রাসীরা পুলিশের ওপর গুলি চালালে পুলিশ পাল্টা গুলি চালায়। এ সময় বন্দুকযুদ্ধে সন্দেহভাজন নিহত হন।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সরকার এসব হত্যাকাণ্ডকে ‘ক্রসফায়ার’, ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বা ‘এনকাউন্টার’-এ নিহত বলে আখ্যা দিয়ে থাকে। তবে গণমাধ্যম ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো অভিযোগ করছে, বেশির ভাগ ‘ক্রসফায়ার’ই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। মানবাধিকার সংগঠনগুলো এ-ও অভিযোগ করছে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কোনো ব্যক্তিকে আগে ধরে নিয়ে যাচ্ছে, পরে জিজ্ঞাসাবাদ ও নির্যাতন করে। এরপর তাঁকে ঘটনাস্থলে নিয়ে হত্যা করে।
বাংলাদেশের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (সিজিএস) এক গবেষণা প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর বলছে, ২০১৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত যেসব বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, তার মধ্যে ৫১ দশমিক ২ শতাংশ ঘটনায় গোয়েন্দা সংস্থা এবং ২৮ দশমিক ৮ শতাংশ ঘটনায় র্যাব দায়ী। দেশের যেকোনো অঞ্চলের তুলনায় কক্সবাজারে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বেশি ঘটেছে। সেখানকার আলোচিত মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ডের কথা উঠে এসেছে প্রতিবেদনে।
বাংলাদেশে গত বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৬ জন গুম হয়েছেন। এসব ঘটনা ঠেকাতে সরকারের যথেষ্ট পদক্ষেপ নেই। এসব ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সরকারের পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়।
স্থানীয় গণমাধ্যম ও মানবাধিকার সংগঠনের বরাত গুমের বিভিন্ন ঘটনা তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, এই সময়ে যাঁরা গুম হয়েছেন, তাঁদের অধিকাংশই বিরোধী দলের নেতা, অধিকারকর্মী ও সরকারের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণকারীরা। এই গুমের ঘটনা নজরে আসার পর নিরাপত্তা বাহিনী কয়েকজনকে ছেড়ে দিয়েছে। তবে এসব ঘটনায় কাউকে আইনের আওতায় কিংবা কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০২১ সালের ডিসেম্বরে র্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্রে। এরপর গত বছরের মে মাসে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব হিউম্যান রাইটস ও এশিয়ান ফেডারেশন অ্যাগেইনস্ট ইনভলান্টারি ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স (এএফএডি) বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন মায়ের ডাক ও অধিকারকে সঙ্গে নিয়ে একটি খোলাচিঠি দেয়। এতে অভিযোগ করা হয়, সরকারের মদদে মানবাধিকারকর্মীরা গুম হচ্ছেন। গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারগুলোকে এ নিয়ে কথা না বলতে প্রায়ই হুমকি দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া রাজনৈতিক দলগুলোর অভিযোগ, গুম ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করতে গেলে পুলিশ নেয়নি।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্বজনদের সংগঠন মায়ের ডাক গত বছরের এপ্রিলে এক সংবাদ সম্মেলনে জানায়, গুমের ঘটনা ঘটছেই। বিশেষ করে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা গুমের শিকার হচ্ছেন। এরপর গত আগস্টে সংগঠনটি জানায়, গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের নারী সদস্যদের চরিত্র হননের চেষ্টায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুয়া ছবি প্রকাশ করছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (সিজিএস) গবেষণার কথা উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৯ থেকে ২০২১ সাল—এই তিন বছরে ৭১ জনের গুমের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এসব ঘটনার ৪০ শতাংশের জন্য র্যাব আর ৩০ শতাংশের জন্য পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) দায়ী। রাজধানী থেকে গুম হয়েছেন এক-তৃতীয়াংশ মানুষ। গুমের শিকার ব্যক্তিদের অধিকাংশই রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী। আর শিক্ষার্থী ১১ শতাংশ।
প্রতিবেদনে ফটোসাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলের কথা তুল ধরে বলা হয়, তাঁর বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা ৩টি মামলার বিচার কার্যক্রম স্থগিত করেছেন হাইকোর্ট। ২০২০ সালে তাঁকে আটক করে সরকার। এরপর ৫৩ দিন তিনি নিখোঁজ ছিলেন। ২০২০ সালের ডিসেম্বর তিনি জামিন পান।
জাতিসংঘের গুমবিষয়ক বিশেষজ্ঞ কমিটির বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, সংস্থাটি ৮১টি ঘটনার তদন্ত করছে। গুমবিষয়ক বিশেষজ্ঞ কমিটি প্রায়ই এমন গুমের অভিযোগ পাচ্ছে। যাঁদের গুমের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে, তাঁদের অধিকাংশই বিরোধী দলগুলোর নেতা-কর্মী।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গ্রেপ্তার বা আটকের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ দিয়েছে বাংলাদেশের সংবিধান। কিন্তু সরকার সাধারণ এই বিধি মেনে চলে না। গণমাধ্যম, নাগরিক সমাজ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো অভিযোগ করছে, সরকারকে শুধু সন্দেহভাজন জঙ্গিদের নয়, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ও বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের গুম করছে। কর্তৃপক্ষ প্রায়ই আটক ব্যক্তির অবস্থান বা পরিস্থিতি তাঁর পরিবার বা আইনজীবীর কাছে প্রকাশ করে না। এমনকি গ্রেপ্তারের বিষয়টি স্বীকার না করেই আটকে রাখার ঘটনাও ঘটে।
সংবিধান গণমাধ্যমসহ অন্যান্য মাধ্যমের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দিয়ে থাকলেও সরকার বারবার এই অধিকার লঙ্ঘন করছে। ইন্টারনেট, কাগজ কিংবা অন্য যেকোনো মাধ্যমে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সীমিত। হয়রানি ও প্রতিশোধের ভয়ে গণমাধ্যমের একটি অংশ নিজেদের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে রেখেছে। ব্লগারদের ক্ষেত্রে একই অবস্থা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে ঘৃণা বা বিদ্বেষ ছড়ানোর বক্তব্য নিয়ন্ত্রণে আইন রয়েছে। কিন্তু ঘৃণা বা বিদ্বেষপ্রসূত বক্তব্য কী, এর কোনো সংজ্ঞা আইনে নেই। ফলে সরকার ঘৃণা বা বিদ্বেষপ্রসূত বক্তব্যের ব্যাখ্যা নিজের মতো দাঁড় করানোর সুযোগ পায়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, রাষ্ট্রের নিরাপত্তাবিরোধী বলে বিবেচিত বক্তব্য, বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র সম্পর্কে বক্তব্য, শালীনতা বা নীতিনৈতিকতা, সরকারি কোনো আদেশের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বক্তব্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারে সরকার। এসব বক্তব্য আদালত অবমাননা, মানহানি বা অপরাধের প্ররোচনার বক্তব্য হিসেবে বিবেচনার সুযোগ রয়েছে আইনে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের যেকোনো সমালোচনাকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করার সুযোগ রয়েছে দেশটির বিদ্যমান আইনে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে (ডিএসএ) উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে এই আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ, জাতীয় সংগীত, জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে যেকোনো অপপ্রচারের দায়ে এই আইনে দোষী ব্যক্তির সাজা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে। কিন্তু বছরজুড়ে সরকারের সমালোচনাকারীদের বিরুদ্ধে আইনটি ব্যবহার করা হয়েছে। করোনাভাইরাসের মহামারি মোকাবিলায় সরকারের পদক্ষেপের সমালোচনাকারীদেরও এই আইনের আওতায় আনা হয়েছে।
মার্কিন প্রতিবেদনে বলা হয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, কোনো ওয়েবসাইট বা ডিজিটাল কোনো মাধ্যমে বক্তব্য দিয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বিচারের ঘটনা ঘটেছে। এমনকি বিদেশে থাকেন, এমন ব্যক্তির বিরুদ্ধেও এই আইনে মামলা হয়েছে।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সিজিএসের এক গবেষণা প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৮৯০ মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ২ হাজার ২৪৪ জনকে আসামি করা হয়েছে। এসব মামলার বেশির ভাগ আসামি রাজনীতিবিদ। এরপরই রয়েছেন সাংবাদিকেরা।
২০২১ ও ২০২৩ সালে এই আইনের মামলায় গ্রেপ্তার বেড়েছে। প্রতি মাসে এই আইনে গড়ে গ্রেপ্তার হচ্ছেন ৩২ জন। শিশুরাও গ্রেপ্তার হচ্ছে। দেশের ১২টি জেলায় ১৩ থেকে ১৭ বছর বয়সী ২০টি শিশুর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, গোয়েন্দা সংস্থা ও ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছেন সাংবাদিকেরা। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে শারীরিক আক্রমণের শিকার হচ্ছেন তাঁরা। মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সরকার ও ক্ষমতাসীন দল ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ব্যবহার করছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সংবাদপত্রের সম্পাদকদের সংগঠন সম্পাদক পরিষদ বলছে, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার কণ্ঠ রোধ করছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে নির্বিচারে গ্রেপ্তার সুযোগের সমালোচনা করছে সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে কাজ করা মানবাধিকার সংগঠনগুলো। এই আইন ব্যবহার করে মিথ্যা অভিযোগে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষদের গ্রেপ্তারের সমালোচনা করা হচ্ছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গণমাধ্যমগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না। রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। এ ছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে বেসরকারি চ্যানেলে বিভিন্ন অনুষ্ঠান বিনা মূল্যে প্রচারের আদেশ দেওয়া হয়। কোনো গণমাধ্যমের নিবন্ধন পেতে রাজনৈতিক প্রভাব লাগে বলে অভিযোগ করছে দেশটির নাগরিক সমাজ।
সাংবাদিক নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি রোজিনা ইসলামের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে প্রতিবেদনে দিয়ে পুলিশ বলেছিল, রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের পক্ষে কোনো উপাদান পাওয়া যায়নি। যদিও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতি নিয়ে অনুসন্ধান করায় তাঁর বিরুদ্ধে ১৯২৩ সালের অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট ও দণ্ডবিধির দুটি ধারায় মামলা করা হয়েছিল। গণমাধ্যমের খবর অনুসারে, তাঁকে সচিবালয়ে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা আটকে রাখা হয়।
পরিবারের দেওয়া তথ্য অনুসারে, রোজিনা ইসলামকে শারীরিকভাবে হেনস্তা এবং তাঁর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা হয়েছে। দোষী সাব্যস্ত হলে তাঁর ১৪ বছরের কারাদণ্ড বা মৃত্যুদণ্ড হতে পারে।