মামলা
মামলা

হত্যাচেষ্টার একটি মামলায় আসামি ৫৩ সাবেক সচিব

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিতে নির্বিচার গুলি চালিয়ে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে করা এক মামলায় ৫৩ জন সাবেক সচিবকে আসামি করা হয়েছে। মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, সাবেক ওই সচিবেরা ‘ভিন্ন দেশের গোয়েন্দা সংস্থার এজেন্ট’।

সাবেক ওই সচিবদের ‘ফ্যাসিবাদের সহযোগী, রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা’ হিসেবে মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে। আসামিদের মধ্যে রয়েছেন মাত্র এক মাস আগে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের পদ থেকে অবসরে যাওয়া মো. মাহবুব হোসেন। অন্যদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব কবির বিন আনোয়ার, সাবেক মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউস, আব্দুস সোবহান সিকদার, তোফাজ্জল হোসেন মিয়া প্রমুখ।

গত ২৯ অক্টোবর ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে মামলাটি করেছেন ছাত্রদলের সাবেক নেতা মোহাম্মদ জামান হোসেন খান। এখন তিনি বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত, পাশাপাশি ঠিকাদারি ব্যবসা করেন। তাঁর করা মামলায় মোট ১৯৬ জনকে আসামি করা হয়েছে।

মামলার এক নম্বর আসামি করা হয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। অন্য আসামিদের মধ্যে রয়েছেন শেখ রেহানা, সজীব ওয়াজেদ জয়, সায়মা ওয়াজেদ, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক। এ ছাড়া সাবেক একজন প্রধান বিচারপতি, দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক একজন চেয়ারম্যান, পুলিশের সাবেক আইজিপিও এই মামলার আসামি। জাতীয় সংসদের সাবেক বিরোধীদলীয় নেতা জি এম কাদেরের নামও আসামিদের তালিকায় রয়েছে।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিভিন্ন মামলায় বিচ্ছিন্নভাবে সাবেক কয়েকজন সচিবকে আসামি করা হয়েছে। তবে একটি মামলায় একসঙ্গে ৫৩ জন সাবেক সচিবকে আসামি করার ঘটনা এটিই প্রথম।

মামলার এজাহারে বাদী জামান হোসেন খান উল্লেখ করেছেন, তাঁর মেয়ে সামিয়া খান আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ বনশ্রী শাখার দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী। গত ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পূর্বঘোষিত শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে যোগ দিতে সামিয়া আফতাবনগরে ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে যায়। সেখানে ছাত্র-জনতা শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করছিল। ছাত্র-জনতার মিছিল চলার সময় আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি করতে থাকে। এ সময় সামিয়া গুলিবিদ্ধ হয়। তার পায়ে এখনো তিনটি গুলি রয়েছে।

বাদী অভিযোগ করেন, ঘটনার প্রায় তিন মাস পর তিনি প্রথমে বাড্ডা থানায় মামলা করতে যান। থানা থেকে আদালতে মামলা করার পরামর্শ দেওয়া হয়। এরপর তিনি সিএমএম আদালতে মামলা করেছেন। আদালত পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) এ মামলা তদন্ত করার নির্দেশ দিয়েছে।

৫৩ জন সচিবকে আসামি করার বিষয়ে জানতে চাইলে মামলার বাদী জামান হোসেন খান প্রথম আলোকে বলেন, একজন সচেতন নাগরিক ও রাজনীতিবিদ হিসেবে তিনি সাবেক ওই সচিবদের সম্পর্কে জানেন। কারও প্ররোচনায় নয়, ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁদের নামে মামলা করেছেন। ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারকে দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষমতায় রাখতে ওই ব্যক্তিরা (সাবেক সচিবরা) সহায়তা করেছেন। ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সময়ে যাঁরা সচিব হয়েছেন, তাঁদের ভূমিকা ছিল অগ্রহণযোগ্য। তাঁরা সরকারকে ঠিকমতো পরামর্শ দেননি। জাতীয় নির্বাচনগুলো ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। নির্বাচন পরিচালনার সঙ্গে যাঁরা যুক্ত ছিলেন, তাঁরা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেননি।

জামান হোসেন খান বলেন, ১৯৯৪-৯৫ সালে তিনি সরকারি তিতুমীর কলেজের ছাত্র সংসদের জিএস ছিলেন। এখন বিএনপির রাজনীতি করেন। পাশাপাশি গণপূর্ত অধিদপ্তরের একজন নিবন্ধিত ঠিকাদার।

১৯৬ জনকে আসামি করার কারণ জানতে চাইলে জামান হোসেন খান বলেন, সাবেক বিরোধীদলীয় নেতাকে আসামি করেছেন তিনি। পাশাপাশি ১৪ দলের নেতাদেরও আসামি করেছেন। আওয়ামী লীগ ফ্যাসিবাদী দল হয়ে ওঠার জন্য তাঁরাও দায়ী।

সাবেক সচিবদের মধ্যে আরও যাঁরা আসামি

মামলার আসামিদের মধ্যে রয়েছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাবেক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ। তিনি জনপ্রশাসন সচিব হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। আরও আছেন সাবেক সচিব কামাল উদ্দিন আহম্মেদ। তিনি জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদ্য বিদায়ী চেয়ারম্যান।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক আরেক চেয়ারম্যান নাছিমা বেগমকেও আসামি করা হয়েছে। তিনিও সাবেক সচিব। আসামিদের তালিকায় রয়েছেন সাবেক সচিব আব্দুর রউফ তালুকদার। তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর। আরও আছেন বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি) সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাদিক। তিনি নির্বাচন কমিশনের সাবেক সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

সাবেক অন্য সচিবদের মধ্যে রয়েছেন মোজাম্মেল হক খান, জুয়েনা আজিজ, ফরিদ উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী, আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম, হেলালুদ্দীন আহমেদ, ফয়েজ আহমেদ, সাজ্জাদুল হাসান, সালাহ উদ্দিন, লোকমান হোসেন মিয়া, আব্দুল মান্নান, আব্দুল মান্নান হাওলাদার, আবু হেনা মোরশেদ জামান, ওয়াহিদা আক্তার, হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন, মাকছুদুর রহমান পাটোয়ারী, মহিবুল হক, উজ্জল বিকাশ দত্ত, জাহাংগীর আলম, এম এ এন সিদ্দিক, শাহজাহান আলী মোল্লা, শ্যামল কান্তি ঘোষ, ইকবাল খান চৌধুরী, মরতুজা আহমেদ, খন্দকার শওকত হোসেন, নিয়াজ উদ্দিন মিয়া, জাফর আহম্মদ খান, বরুণ দেব মিত্র, এম আসলাম আলম, রফিকুল ইসলাম, চৌধুরী মো. বাবুল হাসান, সুরাইয়া বেগম, নজরুল ইসলাম খান, শহীদউল্লা খন্দকার, আব্দুল মালেক, জিল্লার রহমান, ইবরাহীম হোসেইন খান, সম্পদ বড়ুয়া, পবন চৌধুরী, অপরুপ চৌধুরী, সামছুদ্দিন আজাদ চৌধুরী, আক্তারী মমতাজ, শাহ কামাল ও প্রশান্ত কুমার রায়।

আসামিদের তালিকায় থাকা দুজন সাবেক সচিবের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁরা প্রথম আলোকে বলেন, মামলার বিষয়টি তাঁরা জানেন। তবে সংক্ষুব্ধ হয়ে যিনি মামলা করেছেন, তাঁকে চেনেন না। সাবেক সচিবদের নামে এভাবে ঢালাও মামলা জনপ্রশাসনের জন্য বাজে দৃষ্টান্ত হিসেবে ভবিষ্যতে বিবেচিত হবে।

মামলায় নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয়ের বর্তমান অতিরিক্ত সচিব ফরহাদ আহম্মদ খান, সাবেক অতিরিক্ত সচিব জেসমিন টুলি, সাবেক যুগ্ম সচিব আবুল কাশেম ও মোহাম্মদ আবদুল বাতেন এবং নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের এনআইডি শাখার সাবেক পরিচালক ফরহাদ হোসেনকে আসামি করা হয়। তাঁদের মধ্যে জেসমিন টুলি এখন নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের অন্যতম সদস্য।

আরও যাঁরা আসামি

মামলার আসামিদের মধ্যে আরও রয়েছেন সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, সাবেক শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত, সাবেক তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহ্‌মেদ, যুবলীগের সভাপতি শেখ ফজলে শামস পরশ, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক দুই মেয়র আতিকুল ইসলাম ও শেখ ফজলে নূর তাপস, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব বিপ্লব বড়ুয়া প্রমুখ।

সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক, পুলিশের সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনসহ কয়েকজন সাবেক পুলিশ কর্মকর্তাকে আসামি করা হয়েছে। আসামিদের মধ্যে তিনজন সাংবাদিক নেতাও রয়েছেন। তাঁরা হলেন ইকবাল সোবহান চৌধুরী, মোজাম্মেল বাবু ও নঈম নিজাম।

এক মামলায় ৫৩ জন সাবেক সচিবকে একসঙ্গে আসামি করার বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, ফৌজদারি দণ্ডবিধি অনুযায়ী জেনেশুনে ইচ্ছে করে কাউকে হেনস্তা করার উদ্দেশে মামলা করলে তা অপরাধ। দুর্ভাগ্য যে মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা করলে কারও বিরুদ্ধে এত দিন আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। মামলায় যেসব উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে আসামি করা হয়েছে, তাঁদের কেউ হয়তো পাঁচ বছর আগে দায়িত্বে ছিলেন। তাঁকে মূলত হয়রানি করতেই এই মামলা করা হয়েছে। এতে যারা প্রকৃত অপরাধী, তারা পার পেয়ে যাবে।