অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে মামলা করেন ভুবন চন্দ্র শীলের স্ত্রী।
পরে মামলাটি হত্যা মামলায় রূপান্তরিত হয়।
তবে এখন মামলার কোনো খোঁজ জানেন না তিনি।
ছয় মাস আগের কথা। ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেলে বাসায় ফিরছিলেন ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের আইন কর্মকর্তা ভুবন চন্দ্র শীল। যানজটের কারণে তেজগাঁওয়ের বিজি প্রেস এলাকায় মোটরসাইকেল তখন থেমে ছিল। এর মধ্যে হঠাৎ গুলি এসে মাথায় লাগে ভুবনের। এর সাত দিন পর হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর রাতের ওই ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ জানতে পারে, গুলিটি করা হয়েছিল তারিক সাঈদ ওরফে মামুন নামের এক ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে। তখন তিনি একটি গাড়িতে ছিলেন। কিন্তু গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে মোটরসাইকেলের পেছনের আসনে বসা ভুবন চন্দ্র শীলের মাথায় লাগে।
গুলিটি করা হয়েছিল মামুন নামের এক ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে। গুলি লাগে ভুবন চন্দ্র শীল নামের আরেক ব্যক্তির মাথায়। পরে হাসপাতালে মারা যান তিনি।
ভুবন চন্দ্র শীল হাসপাতালে থাকা অবস্থায় তাঁর স্ত্রী রত্না রানী শীল বাদী হয়ে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় মামলা করেন। পরে মামলাটি হত্যা মামলায় রূপান্তরিত হয়। এখন মামলাটি তদন্ত করছে তেজগাঁওয়ের শিল্পাঞ্চল থানা পুলিশ।
মামলার তদন্ত-সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র বলছে, প্রযুক্তির সহায়তা ও ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করে হামলায় জড়িত ব্যক্তিদের মধ্যে সাতজনকে চিহ্নিত করা গেছে। তবে তাঁদের মধ্যে ছয়জনই দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। এর মধ্যে তিনজন কুমিল্লার বুড়িচং এবং তিনজন যশোরের বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালিয়ে গেছেন বলে অনেকটাই নিশ্চিত হওয়া গেছে। খুনের ঘটনায় সরাসরি অংশ নেওয়া সাতজনের মধ্যে এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত শুধু একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মারুফ বিল্লাহ ওরফে হিমেল নামের ওই আসামি এখন কারাগারে।
২৪ বছর কারাবন্দী থাকার পর গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে মামুন জামিনে মুক্ত হন। এরপর পুরোনো অপরাধজগতের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করেন মামুন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে মামুনকে হত্যার পরিকল্পনা করেন কারাবন্দী ইমন।
তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) দুলাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, হামলার ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা গেছে। আসামিদের কেউ কেউ বিদেশে পালিয়ে যেতে পারেন।
মামুনের ওপর হামলার কারণ হিসেবে তদন্ত–সংশ্লিষ্ট পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানান, মামুন ও সানজিদুল ইসলাম ওরফে ইমন এক সময় ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর ও তেজগাঁও এলাকার অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ করতেন। তাঁরা একটি বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন, যার নাম ‘ইমন-মামুন’ বাহিনী। তাঁরা দুজনই চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী এবং সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের ভাই সাঈদ আহমেদ ওরফে টিপু হত্যা মামলার আসামি। দুই দশকের বেশি সময় আগে ইমন ও মামুন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। ২৪ বছর কারাবন্দী থাকার পর গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে মামুন জামিনে মুক্ত হন। এরপর পুরোনো অপরাধজগতের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করেন মামুন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে মামুনকে হত্যার পরিকল্পনা করেন কারাবন্দী ইমন।
আমার তো সব শেষ হয়ে গেছে। এখন শুধু মেয়েটাকে নিয়ে বাঁচতে চাই।রত্না রানী শীল
তদন্ত–সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, মামুনকে খুনের চেষ্টা করা ছয়জনের মধ্যে একজন আনিসুর রহমান ওরফে শামীম। তিনি ইমনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। মামুনের ওপর কীভাবে হামলা চালানো হবে, সেই ছক তৈরি করেছিলেন তিনি। তবে ঘটনার পর শামীমও দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন।
পালিয়ে যাওয়া অন্য পাঁচজনের নাম প্রকাশ করা কিংবা তাঁদের বিষয়ে কোনো তথ্য দিতে চাননি পুলিশের ওই কর্মকর্তা।
মামলার তদন্ত-সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র বলছে, প্রযুক্তির সহায়তা ও ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করে হামলায় জড়িত ব্যক্তিদের মধ্যে সাতজনকে চিহ্নিত করা গেছে। তবে তাঁদের মধ্যে ছয়জনই দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন।
‘সব শেষ হয়ে গেছে’
হামলার ওই ঘটনার পর থেকে মামুন আর প্রকাশ্যে আসছেন না বলে পুলিশ সূত্রগুলো বলছে। ঘটনার পর মামুনকে জিজ্ঞাসাবাদও করেছিল পুলিশ। তাঁর ওপর হামলা হলেও তিনি তখন মামলা করতে আগ্রহী ছিলেন না। মামুন এখন কোথায় আছেন, সেটি তদন্ত–সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলতে পারছেন না। তবে তাঁরা বলছেন, প্রয়োজন হলে আদালতের অনুমতি নিয়ে কারাবন্দী ইমনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
গুলির ঘটনায় নিহত ভুবন চন্দ্র শীল গোমতী টেক্সটাইল লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানের আইনি পরামর্শক হিসেবে কাজ করতেন। প্রতিষ্ঠানটির কার্যালয় গুলশানে। তিনি আরামবাগের একটি বাসায় ভাড়া থাকতেন। তাঁর স্ত্রী ও মেয়ে থাকেন নোয়াখালীর মাইজদীতে। স্ত্রী রত্না রানী শীল মাইজদীর একটি উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক। তাঁর মেয়ে ভূমিকা রানী শীল নোয়াখালীর একটি কলেজে পড়েন।
রত্না রানী শীলের সঙ্গে গতকাল শনিবার মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মামলার কোনো খোঁজ জানেন না তিনি। যাঁরা খুনে জড়িত, তাঁরা সন্ত্রাসী টাইপের লোক। তাঁদের বিরুদ্ধে লড়াই করা কঠিন। এ জন্য তিনি আর মামলার খোঁজ রাখছেন না। তিনি বলেন, ‘আমার তো সব শেষ হয়ে গেছে। এখন শুধু মেয়েটাকে নিয়ে বাঁচতে চাই।’