জাতিসংঘ দলের পর্যবেক্ষণ

গুম-খুনে বিচারহীনতায় জন–আস্থা ভেঙে পড়েছে

বাংলাদেশে রাজনৈতিক বিরোধীদের বিরুদ্ধে ব্যাপক দমন অভিযানের পটভূমিতে এবারের ইউপিআরের পর্যবেক্ষণ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।

জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার কার্যালয়
ছবি: জাতিসংঘ

জাতিসংঘের প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে বিচার প্রশাসন গুরুতর সমস্যার মুখোমুখি উল্লেখ করে বলেছে, তাদের স্বাধীনভাবে ন্যায়বিচার করার ক্ষমতা সম্পর্কে গুরুতর সন্দেহ তৈরি হয়েছে। প্রতিনিধিদল বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমের ঘটনায় আইন প্রয়োগকারীদের দায়মুক্তি এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতার বিষয়ে বিরাজমান গভীর উদ্বেগের কারণে জনগণের আস্থা ভেঙে পড়ার কথা জানিয়েছে। তারা একটি পক্ষপাতমুক্ত, স্বাধীন এবং বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেছে, যারা আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগগুলো তদন্তে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে।

জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার চতুর্থ সর্বজনীন নিয়মিত পর্যালোচনা বা ইউনিভার্সাল পিরিয়ডিক রিভিউ, ইউপিআরের জন্য সংস্থার তৈরি সারসংকলনে বিচারব্যবস্থার প্রতি জন–আস্থা ভেঙে পড়ার এ পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়েছে। সরকার অবশ্য তার পেশ করা জাতীয় প্রতিবেদনে বিচার বিভাগকে শক্তিশালী করতে নতুন বিচারক নিয়োগ, আর্থিক বরাদ্দ বৃদ্ধি এবং মামলা নিষ্পত্তির হার বাড়ার কথা বলেছে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রতিবেদনেও সরকারের ভাষ্যের পুনরাবৃত্তি দেখা গেছে।

বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক করার প্রশ্নে সৃষ্ট রাজনৈতিক বিরোধকে ঘিরে দেশব্যাপী রাজনৈতিক বিরোধীদের বিরুদ্ধে ব্যাপক দমন অভিযানের পটভূমিতে এবারের ইউপিআরের পর্যবেক্ষণ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। আজ সোমবার এই পর্যালোচনা পর্ব অনুষ্ঠিত হবে। এতে উত্থাপিত বিভিন্ন প্রশ্ন ও সমালোচনার জবাব দেওয়ার সুযোগ থাকবে, যার ভিত্তিতে ১৫ নভেম্বর চতুর্থ ইউপিআরের সুপারিশমালা প্রণীত হবে। মানবাধিকার পর্যালোচনায় বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেওয়ার কথা আছে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের।

হাইকমিশনার এবং এসব বিশেষজ্ঞ গুম থেকে সুরক্ষার আন্তর্জাতিক সনদ এবং নির্যাতনবিরোধী স্বেচ্ছামূলক চুক্তি স্বাক্ষরের জন্যও বাংলাদেশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থার এ সারসংকলনে দেখা যাচ্ছে, জাতিসংঘের মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতির যেসব তথ্য পেয়েছেন, তার আলোকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন ও সনদগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তাঁরা বাংলাদেশের ফৌজদারি আইনসহ বিভিন্ন আইন সংস্কারের আহ্বান জানিয়েছেন। হাইকমিশনার এবং এসব বিশেষজ্ঞ গুম থেকে সুরক্ষার আন্তর্জাতিক সনদ এবং নির্যাতনবিরোধী স্বেচ্ছামূলক চুক্তি স্বাক্ষরের জন্যও বাংলাদেশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। বৈষম্য দূর করতে দেশের সব আইন পর্যালোচনার কথাও এতে বলা হয়েছে।

সংস্থার বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ গ্রুপের পাওয়া তথ্য ও মূল্যায়নের ভিত্তিতে তৈরি এ সংক্ষিপ্ত বিবরণীতে সাবেক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাশেলেত ঢাকা সফরের সময় সরকারের কাছে যে সুপারিশগুলো তুলে ধরেছিলেন, সেগুলোর উল্লেখ রয়েছে। বাংলাদেশে জাতিসংঘের প্রতিনিধিদলের মূল্যায়নে তৃতীয় ইউপিআরে বাংলাদেশ যেসব সুপারিশ গ্রহণ করেছিল, তার অধিকাংশই বাস্তবায়িত হয়নি। বাংলাদেশ সব মিলিয়ে ১৭৮টি সুপারিশ গ্রহণ করেছিল বলে জানিয়েছে এবং সেগুলো বাস্তবায়নে প্রাতিষ্ঠানিক ও আইনি পদক্ষেপগুলোর বিবরণ তার প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে।

গুম ও নির্যাতনের অভিযোগগুলোর বিষয়ে মিশেল ব্যাশেলেত ঢাকায় সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে যেসব উদ্বেগ ও সুপারিশের কথা জানিয়েছিলেন, জাতিসংঘের নোটে তা উল্লেখ করে গুমের অভিযোগগুলো তদন্তে একটি স্বাধীন তদন্তব্যবস্থার কথা বলা হয়, যাতে বিশেষজ্ঞরা গুমের শিকার ব্যক্তি, তাঁর পরিবার এবং নাগরিক সমাজের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করবেন। তিনি নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর সদস্যদের জন্য কঠোর বাছাইপ্রক্রিয়া চালুর কথাও বলেছেন। জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থার এ তথ্য সংকলনে দেখা যায়, মিশেল ব্যাশেলেত তাঁর সফরের সময়ে নির্যাতনে মন্ত্রীদের জড়িত থাকার গুরুতর অভিযোগের নিরপেক্ষ, স্বাধীন ও স্বচ্ছ তদন্ত এবং নিরাপত্তা খাতের সংস্কারের কথা আলোচনা করেছিলেন। তবে তাঁর সফরের সময়ে এ বিষয়ে কিছু প্রকাশ পায়নি।

বাংলাদেশে জাতিসংঘের প্রতিনিধিদল জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক এনজিওগুলোকে মানবিক, উন্নয়ন ও অধিকার বিষয়ে স্বচ্ছতার সঙ্গে খোলাখুলিভাবে কাজ করতে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।

এ তথ্য সংকলনে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারবিষয়ক কমিটি (সিইএসসিআর) এবং কমিটি অ্যাগেইনস্ট টর্চারের (সিএটি) বিভিন্ন তথ্য, পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশ স্থান পেয়েছে। সিএটি মানবাধিকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অনুসন্ধান ও মূল্যায়নের জন্য ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত বিশেষজ্ঞ, যাঁরা স্পেশাল র‍্যাপোর্টিয়ার বলে পরিচিত, তাঁদের নয়জনকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানানোর আহ্বান জানিয়েছে। আর হাইকমিশনার গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপকে বাংলাদেশ সফরের সুযোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। সিএটি জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের স্বাধীনতা জোরদার করার সুপারিশ করে যেসব জায়গায় মানুষকে আটক রাখা হয়, সেসব স্থান তদন্তের জন্য উন্মুক্ত করার আহ্বান জানিয়েছে।

সিএটি রাজনৈতিক বিরোধী ও বিক্ষোভকারীদের যথেচ্ছ গ্রেপ্তারে উদ্বেগ প্রকাশ করে তাদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলেছে। যেকোনো পরিস্থিতিতে হেফাজতে মৃত্যু বন্ধ এবং আটকাবস্থায় পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা করা এবং হাজতখানাগুলোতে স্বাধীন পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিদের আকস্মিক পরিদর্শনের ব্যবস্থা করার সুপারিশ করেছে তারা।

নাগরিক সমাজের যেসব প্রতিনিধি, আইনজীবী ও সাংবাদিক কর্তৃপক্ষের সমালোচনা করেন, তাঁদের হয়রানি, যথেচ্ছ গ্রেপ্তার, সহিংসতা ও অমর্যাদাকর আচরণের বিভিন্ন খবরে সিএটি উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। কমিটি তাই তথ্যপ্রযুক্তি আইন, বৈদেশিক অনুদানবিষয়ক আইন সংশোধনের কথা বলেছে। হাইকমিশনারও নাগরিক গোষ্ঠীগুলোর কাজের ক্ষেত্র সংকুচিত হওয়ার কথা উল্লেখ করে এনজিওগুলোর ওপর মাত্রাতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রক্রিয়া বা বিশেষজ্ঞ দলের সঙ্গে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার বিষয়ে সহযোগিতার জন্য মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের প্রতি সব হয়রানি বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন।

সিইএসসিআর আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ও উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর অধিকারবিষয়ক সনদ ১৯৮৯ অনুমোদনের আহ্বান জানিয়েছে। বাংলাদেশে জাতিসংঘের প্রতিনিধিদল জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক এনজিওগুলোকে মানবিক, উন্নয়ন ও অধিকার বিষয়ে স্বচ্ছতার সঙ্গে খোলাখুলিভাবে কাজ করতে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।

এ ছাড়া কমিশন আলাদা করে বিভিন্ন মানবাধিকার গোষ্ঠী ও নাগরিক সংগঠন বা এনজিওর পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশমালার সারসংক্ষেপও প্রকাশ করেছে। এ সারসংক্ষেপে মানবাধিকার পরিস্থিতির গুরুতর অবনতির নানা তথ্য তুলে ধরে উদ্বেগ প্রকাশের পাশাপাশি সংগঠনগুলো তাদের বিবেচনায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলেছে।

অ্যামনেস্টি, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, এশিয়ান লিগ্যাল রিসোর্স সেন্টারসহ আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক ও দেশীয় ৩৯টি সংগঠনের পেশ করা পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশের সারসংক্ষেপে সরকারের বিরোধী মত দমনে গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা, নির্যাতন, সভা-সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে হুমকি, বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠনগুলোর হয়রানি, শিক্ষা ও গবেষণার স্বাধীনতা, সংখ্যালঘু, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ও প্রান্তিক গোষ্ঠীগুলোর প্রতি বৈষম্য, শ্রমিকদের অধিকারের প্রসঙ্গগুলো বিশদভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

অ্যামনেস্টির বিবৃতি

ইউপিআর অধিবেশনের প্রাক্কালে ১১ নভেম্বর এক বিবৃতিতে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল মানবাধিকারের গুরুতর লঙ্ঘনের জন্য বাংলাদেশ সরকারের কাছে জবাবদিহি চাওয়ার জন্য জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্রগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। বিবৃতিতে তারা বলেছে, বাংলাদেশের চতুর্থ ইউপিআর এমন সময়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যখন দেশটির মানবাধিকার ও গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলো, বিরোধী নেতারা, স্বাধীন গণমাধ্যম এবং নাগরিক সমাজ নির্বাচনের প্রাক্কালে পদ্ধতিগতভাবে আক্রমণের মুখোমুখি হচ্ছেন।