রোকিয়া আফজাল রহমান ছিলেন গত শতকের ষাটের দশকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম নারী ব্যাংক ব্যবস্থাপক। স্বাধীন দেশে ১৯৮০ সালে তিনি হিমাগার স্থাপন করে কৃষি ব্যবসা শুরু করেন। পরে তিনি অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের মাধ্যমে নারীদের মর্যাদা বৃদ্ধি এবং নারী নির্যাতন বন্ধের লক্ষ্য নিয়ে কাজ শুরু করেন। তিনি ছিলেন নারী উদ্যোক্তা তৈরির অন্যতম কারিগর। বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রোকিয়া আফজাল রহমানের স্মরণসভায় বক্তারা এভাবে তাঁর মূল্যায়ন করেন।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান মাইক্রো ইন্ডাস্ট্রিজ ডেভেলপমেন্ট অ্যাসিস্ট্যান্স অ্যান্ড সার্ভিসেস (মাইডাস) ও মাইডাস ফাইন্যান্সিং লিমিটেড (এমএফএল) আজ শনিবার রাজধানীর ধানমন্ডিতে মাইডাস সেন্টারে এ স্মরণসভার আয়োজন করে। গত ৫ এপ্রিল সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ নোভেনা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রোকিয়া আফজাল রহমান মারা যান। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮২ বছর। তিনি আর্থিক প্রতিষ্ঠান এমএফএলের চেয়ারপারসন ও মাইডাসের পরিচালক ছিলেন।
সভায় রোকিয়া আফজাল রহমানের সম্পর্কে বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন তাঁর বড় মেয়ে ইরাম মরিয়ম। মা একটি পূর্ণ জীবনযাপন করেছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, মায়ের জগৎ ছিল পরিবার, স্বজন ও কর্মস্থলের মানুষদের নিয়ে। নারী উদ্যোক্তাদের তিনি বলতেন ‘আমার মেয়েরা’।
রোকিয়া আফজাল রহমানের বোন বাংলাদেশ ফেডারেশন অব উইমেন এন্ট্রাপ্রেনিউরস (বিএফডব্লিউই) সহসভাপতি খাদিজা আফজাল বলেন, তাঁর বোন পরিবারের প্রত্যেকের প্রয়োজনের সময়ে পাশে থাকতেন। বোনের কারণে তিনিও উদ্যোক্তার জীবন পেয়েছেন।
রোকিয়া আফজাল রহমান মিডিয়া ওয়ার্ল্ড লিমিটেডের চেয়ারপারসন ছিলেন। মিডিয়া ওয়ার্ল্ড থেকে ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার প্রকাশিত হয়। তিনি মিডিয়া স্টার লিমিটেডেরও পরিচালক ছিলেন। মিডিয়া স্টার থেকে প্রথম আলো প্রকাশিত হয়। স্মরণসভায় ২০০৫ সালের ১১ জুন প্রথম আলোর ক্রোড়পত্র ‘ছুটির দিনে’ রোকিয়া আফজাল রহমানকে নিয়ে প্রকাশিত একটি লেখার অংশবিশেষ পড়ে শোনান মাইডাসের পরিচালক পারভীন মাহমুদ। তাতে রোকিয়া আফজাল রহমান বলেছিলেন, ‘মেয়েদের ব্যবসায়িক ব্যবস্থাপনা, হিসাবের জ্ঞানবুদ্ধি খুব ভালো। সবচেয়ে ভালো তাদের ঋণের টাকা ফেরত দেওয়ার প্রবণতা। দেশে যেখানে ঋণখেলাপিদের নিয়ে ব্যাংকগুলো বিব্রত, সেখানে মাইডাসে নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ ফেরত দেওয়ার শতকরা হার ৯৯ দশমিক ৫। আমি তো রীতিমতো গর্বিত।’
পারভীন মাহমুদ বলেন, রোকিয়া আফজাল রহমানের জীবনকাহিনি সবার জন্য অনুপ্রেরণার। পরিশ্রম বা কাজকে তিনি কখনো ভয় পাননি।
রোকিয়া আফজাল রহমান মানুষকে সম্মান করতেন, মর্যাদা দিতে জানতেন বলে উল্লেখ করেন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার। তিনি রোকিয়া আফজালের প্রতিষ্ঠান এমএফএলের চেয়ারম্যান। তাঁর সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতার আলোকে আলী ইমাম মজুমদার বলেন, রোকিয়া আফজাল রহমানের সামাজিক যোগাযোগের পরিসর ছিল ব্যাপক। এমএফএলকে তাঁর প্রত্যাশা অনুযায়ী চালিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যের কথা বলেন তিনি।
রোকিয়া আফজাল রহমান দেশে নারীর ক্ষমতায়নে কাজের ক্ষেত্রে পথিকৃৎ ছিলেন বলে মন্তব্য করেন এমএফএলের পরিচালক (স্বতন্ত্র) ও ভোক্তা অধিকার রক্ষায় কাজ করা কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান। তিনি বলেন, নারীর ক্ষমতায়নে তাঁর প্রচেষ্টা ও আকুতি ছিল। তিনি ছিলেন একটি আদর্শের নাম।
এমএফএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, রোকিয়া আফজাল রহমান নারী উদ্যোক্তা সৃষ্টির অন্যতম কারিগর ছিলেন। মাইডাস বলতে মানুষ তাঁকেই বোঝেন। তাঁর শূন্যতা অপূরণীয়।
রোকিয়া আফজাল রহমান আরলিঙ্কস গ্রুপের চেয়ারম্যান ছিলেন। বাংলাদেশ ফেডারেশন অব উইমেন এন্ট্রাপ্রেনিউরসের (বিএফডব্লিউই) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। এ ছাড়া আরও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন।
স্মরণসভায় এমএফএলের পরিচালক নাসির উদ্দিন চৌধুরী বলেন, রোকিয়া আফজাল রহমানের ব্যক্তিত্ব অনুকরণীয়। তাঁর গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে তিনি চিরদিন বেঁচে থাকবেন।
রোকিয়া আফজাল রহমান ১৯৯৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের আয়োজনে বিশ্বের নারী উদ্যোক্তা নেতৃত্বের পুরস্কার পেয়েছিলেন। তিনি অনেকের জন্য বড় অনুপ্রেরণা ছিলেন বলে উল্লেখ করেন মাইডাসের চেয়ারম্যান জাহিদা ইস্পাহানী। তিনি বলেন, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ও নারী উদ্যোক্তা তৈরিতে তাঁর অনেক বড় অবদান রয়েছে। তাঁর মানবতাবোধ এবং সাধারণ মানুষের সঙ্গে মেশার ক্ষমতা ছিল অসাধারণ।
মাইডাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ এস এম মশিউর রহমান বলেন, রোকিয়া আফজাল রহমান ১৯৮৬ সাল থেকে মাইডাসের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। নারী উদ্যোক্তাদের অর্থায়ন, তাঁদের পণ্য বাজারজাতকরণসহ বিভিন্ন উন্নয়ন নিয়ে তিনি চিন্তা করতেন। তাঁর ভাবনা ছিল, নারী উদ্যোক্তা সৃষ্টি হলে সমাজে নারী–পুরুষে সমতা আসবে, নারী নির্যাতন বন্ধ হবে। মাইডাসের কাজে তাঁর এই চিন্তার প্রতিফলন সব সময় থাকবে।
রোকিয়া আফজাল রহমান যেভাবে নারী উদ্যোক্তাদের উৎসাহ দিতেন, তাতে সামনে এগোনোর রসদ পাওয়া যেত বলে উল্লেখ করেন মাইডাসের পরিচালক সাবিনা আলম।
নারী উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে রোকিয়া আফজাল রহমানের দেখানো পথ পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে এ ধরনের আয়োজন নিয়মিত করার প্রস্তাব করেন উইমেন এন্ট্রাপ্রেনিউরস অ্যাসোসিয়েশনের (ডব্লিউইএ) সভাপতি আকলিমা সুলতানা।
রোকিয়া আফজাল রহমানের সঙ্গে দীর্ঘদিন কাজ করার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন প্রবীণ উদ্যোক্তা মঞ্জুলিকা চাকমা ও ফেইথ বাংলাদেশ নামে একটি সংস্থার নির্বাহী পরিচালক নিলুফার আহমেদ করিম।
অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খান, প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ। সভাটি সঞ্চালনা করেন এমএফএলের কোম্পানি সচিব তানভীর হাসান।