ইফতারির থালায় সমান সবাই

চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লা শাহি জামে মসজিদে গতকাল ইফতারে সর্বস্তরের মানুষ
প্রথম আলো

মসজিদের এক পাশে লম্বা টেবিলে থরে থরে সাজানো গামলা থেকে প্লেটে প্লেটে ছোলা, পেঁয়াজু, বেগুনি, মুড়ি আর জিলাপি বেড়ে দিচ্ছিলেন ১৫ জন স্বেচ্ছাসেবক। ছোট প্লেটের পাশাপাশি চারজন একসঙ্গে খেতে পারেন এমন থালাও সাজানো হচ্ছিল। প্লেট আর থালা সাজানো শেষ হতেই সাদা দস্তরখানা বিছানো হলো মসজিদজুড়ে। ইফতারের আর বেশি সময় নেই। হাতে ১৫ মিনিটমাত্র সময়। মাইক হাতে রোজাদারদের কাতারে বসতে অনুরোধ জানালেন একজন।

গতকাল শনিবার চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লা শাহি জামে মসজিদে গণ-ইফতারে শামিল হয়েছিলেন প্রায় দেড় হাজার মানুষ। গত ১৫ বছর ধরে চট্টগ্রামের এই ঐতিহ্যবাহী মসজিদে এমন আয়োজন হচ্ছে। ইফতারের এই মহা আয়োজন দেখতেই বিকেল চারটা নাগাদ আমরা হাজির হয়েছিলাম মোগল বিজয়ের স্মারক হিসেবে খ্যাত এই মসজিদে।

খোলা বড় চত্বর আর জাফরিকাটা খিলানের সাবেকি মসজিদে পা দিতেই মন শান্ত হয়ে আসে। বিকেল চারটায় আমরা যখন সেখানে যাই, তখন প্লেটে প্লেটে ইফতারি পরিবেশনের কাজে ব্যস্ত ছিলেন ১৫ স্বেচ্ছাসেবক। তবে ইফতারি তৈরি সেই সকাল আটটায় শুরু হয়েছে বলে জানালেন মসজিদের খাদেম মো. সৈয়দুল হক। ১০ জন বাবুর্চি ছোলা, পাকোড়া, শিঙাড়া, পেঁয়াজু, বেগুনি, জিলাপি, চপ আর চিড়া তৈরির কাজ শুরু করেন। বড় তিন ডেক আর তিনটি কড়াইয়ে রান্নার আয়োজন চলেছে দুপুর পর্যন্ত। এ ছাড়া বড় একটি প্লাস্টিকের ড্রামে তৈরি হয়েছে রুহ আফজার শরবত।

ছোটখাটো গড়নের আবুল কালামের কোমরে গামছা বাঁধা। দস্তরখানার দুই পাশে বসা রোজাদারদের সামনে ইফতারির প্লেট রেখে আসছিলেন তিনি। একটু থামিয়ে কথা বলতে চাইলে হেসে বলেন, সময় নেই। কিছুক্ষণ পর হাতের কাজ অন্য একজনকে বুঝিয়ে দিয়ে এসে আলাপ শুরু করেন তিনি। আবুল কালামকে গত বছরও দেখেছি এই মসজিদে। এ বছরও একই দায়িত্বে দেখা গেল তাঁকে। জানতে চাইলে বলেন, ‘ছুডু থেইক্কা এই মসজিদে আহি। রমজানের সময় আমারে কেই ডাকে না। নিজেই আইয়া পড়ি। এডি তো আমারই কাম। হুজুররাও আমার লাইগ্যা ওয়েট করে।’

মসজিদের মুসল্লি ও খাদেমরা জানান, মসজিদটি তৈরির পর থেকেই রোজায় ইফতারের আয়োজন চলছে। তবে বড় পরিসরে গণ-ইফতারের আয়োজন করা হচ্ছে ২০০৮ সাল থেকে।

নিবেদিতপ্রাণ আবুল কালামের মতো অনেকেই এই ইফতার আয়োজনে নিঃস্বার্থভাবে সহায়তা করেন। মসজিদের খতিবের একান্ত সচিব মো. হাসান মুরাদ এ আয়োজনের খুঁটিনাটি দেখভাল করেন। তিনি বলেন, ‘এই আয়োজনের পুরোটাই আসে দানের টাকা থেকে। বেশির ভাগ মানুষই নিজের নাম প্রকাশ করতে চান না। এই আয়োজনে মসজিদের এক টাকাও খরচ হয় না।’

ইফতার আয়োজনের পাশেই বড় ড্রামে শরবত তৈরি করছিলেন মো. শহীদ আলম। নগরের নালাপাড়া এলাকার একটি রেস্তোরাঁর মালিক প্রতিবছর নিজে থেকে রোজাদারদের শরবত খাওয়ানোর দায়িত্ব নেন। আলম তাঁরই কর্মচারী। তিনি জানালেন, শরবত তৈরিতে ১৪ বোতল রুহ আফজা, ২০ কেজি চিনি আর বরফ লাগে। এক গামলায় তৈরি শরবতে ১ হাজার ৬০০ মানুষের পিপাসা মিটবে।

বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে মসজিদ প্রায় পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। কেউ বসেছেন কাতারে আর কেউ গোল হয়ে। বইয়ের দোকানের কর্মচারী, সিকিউরিটি গার্ড, ব্যাংকার, গ্রাফিক ডিজাইনার থেকে শুরু করে রিকশাচালক—এমন হরেক পেশার লোকজনকে দেখা গেল গণ-ইফতারে।

আজান দেওয়ার কয়েক মিনিট আগে এক জায়গায় বসে পড়ি। একটা বড় থালায় ছোলা, মুড়ি, বেগুনি ও জিলাপি মাখানো হয়েছে। সেগুলো সবাই খাবেন। সেখানে বসা ব্যবসায়ী জয়নাল গতকালই প্রথম এসেছিলেন গণ–ইফতারে। সব দেখে তিনি অভিভূত। বললেন, এক থালায় সবাই সমান। সবাই সবার আত্মীয়ের মতো। এটাই খুব ভালো লাগছে।