শুধু জয় বাংলা বা জিন্দাবাদ বলা লোক যদি বিচারক হয়, তাহলে উচ্চ আদালতের কাছে কিছু আশা করা যায় না বলে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল। তিনি বলেন, ‘এখন উচ্চ আদালতই যদি হয় সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত, পলিটিক্যাল পার্টির প্রতি সবচেয়ে লয়াল (অনুগত), সবচেয়ে দলবাজ, তাহলে নিম্ন আদালতের স্বাধীনতা দিয়ে আপনি কী করবেন? প্রথমে আমাকে ফিক্স (ঠিক করা) করতে হবে উচ্চ আদালত।’
সোমবার সকালে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ‘গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের জন্য সংলাপ: বিচার বিভাগ প্রসঙ্গ’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগ প্রসঙ্গে এ কথা বলেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। এই আলোচনার আয়োজন করে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস)।
অনুষ্ঠানে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, উচ্চ আদালত ঠিক করতে হলে প্রথমে নিয়োগ ঠিক করতে হবে। উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের জন্য আইন মন্ত্রণালয় আইন প্রণয়নের চেষ্টা করছে বলেও জানান তিনি।
স্থায়ী প্রসিকিউশন সেবা, আইনে থাকা ভুল সংশোধনসহ বেশকিছু কাজ করতে চান জানিয়ে আসিফ নজরুল বলেন, তাঁর ইচ্ছা আছে, যদি বছরখানেক সময় পান, তাহলে এই কাজগুলো করে যাবেন। তারপরও অনেক কাজ বাকি থাকবে। পরবর্তী সরকার এসে অনেক কিছুই বাতিল করে দিতে পারে। ঐকমত্য যত শক্ত থাকবে, পরবর্তী সরকারের পক্ষে সেটি বাতিল করা তত কঠিন হবে। যত ভালো আইন করা হোক না কেন, প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা না গেলে এবং মানসিকতায় পরিবর্তন না এলে এগুলো টেকসই করা কঠিন।
উচ্চ আদালতই যদি হয় সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত, পলিটিক্যাল পার্টির প্রতি সবচেয়ে লয়াল (অনুগত), সবচেয়ে দলবাজ, তাহলে নিম্ন আদালতের স্বাধীনতা দিয়ে আপনি কী করবেন?অধ্যাপক আসিফ নজরুল, আইন উপদেষ্টা
সংস্কার ছাড়া গতি নেই উল্লেখ করে আসিফ নজরুল বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছায় রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেন প্রধান বিচারপতি। প্রধানমন্ত্রীও অত্যন্ত অনুগত ভৃত্যশ্রেণির লোকদের রাষ্ট্রপতি বানান, অথবা ওনারা রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর ভৃত্যে পরিণত হন।
বিচার বিভাগ নির্যাতন, নিপীড়ন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের একটি হাতিয়ার হয়ে গিয়েছিল উল্লেখ করে অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বিচার বিভাগ কখনো এত নির্মম নিপীড়কে পরিণত হতে পারত না। যখন নির্বাচন বলে কিছু না থাকলে কারও কাছে জবাব দিতে হয় না, ইচ্ছেমতো নির্যাতন শুরু হয় তখন। সে জন্য সব সংস্কারের মূলে যেন নির্বাচন ভাবনা থাকে।
সিলেট সীমান্তে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের কলাপাতায় শুয়ে থাকা ওই ছবি সব আদালতের পেছনে টানিয়ে রাখা উচিত বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, তাহলে সবাই বুঝতে পারবে, আসলে বিচারকদের কী ভূমিকা থাকা উচিত।
জামিনের মতো বিষয় সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত আসা উচিত নয় বলে মনে করেন তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় বিচারক নিয়োগ এবং রাজনৈতিক স্বার্থে বিচারব্যবস্থাকে যখন ব্যবহার করা হয়, তখন এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বিচারকেরাও দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ করতে থাকেন।
অনুষ্ঠানে সিপিবির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, দলীয় রাজনীতির প্রভাব ও অর্থবিত্তের প্রভাব থেকে বিচার বিভাগকে মুক্ত করতে হবে। লুটপাটতন্ত্র থাকলে আইনি কাঠামো বা আইনি ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে না। তিনি বলেন, ‘যাহা আইনসংগত, তাহাই যে ন্যায়সংগত হবে; এটা মনে করার কোনো কারণ নেই।’
কাউকে গ্রেপ্তারের আগে ন্যূনতম কিছু তথ্য-প্রমাণ থাকতে হবে বলে উল্লেখ করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সারা হোসেন। তিনি বলেন, একের পর এক মামলায় জড়ানোর প্রবণতা এখনো আছে। এটা বন্ধ করার উপায় হচ্ছে, গ্রেপ্তারের আগে ন্যূনতম কিছু তথ্য–প্রমাণ থাকতে হবে। এখনো দেখা যাচ্ছে, হাইকোর্টে আগাম জামিনের প্রক্রিয়া প্রায় একেবারেই বন্ধ। এটা কেন হবে? কারও বিরুদ্ধে অন্যায় বা মিথ্যা মামলা হলে সেটি ঠিক করার উপায় হচ্ছে আগাম জামিন দেওয়া।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক বোরহান উদ্দিন খান বলেন, যত সময় গেছে, তত রাজনৈতিক সরকার বিচার বিভাগের ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে। বর্তমান সরকার অরাজনৈতিক। তারপরও প্রভাব এখনো বিদ্যমান। দেখবেন, কারও জামিন হচ্ছে না। একজন বিচারক যদি আজকে জামিন দেন কাউকে, তাহলে তাঁর ভয় আছে পদোন্নতি, পদায়ন নিয়ে বা তৎক্ষণাৎ তিনি বদলি হতে পারেন।
জামিন দেওয়া নিয়ে দাসত্বমূলক মনোভাব তৈরি আছে উল্লেখ করে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান নিতাই রায় চৌধুরী বলেন, জজকোর্ট জামিন দিলে হাইকোর্ট স্থগিত করে দেয়, আবার হাইকোর্ট দিলে সুপ্রিম কোর্ট স্থগিত করে দেয়—এটা ছিল। এগুলোর পরিবর্তন আনতে হবে।
এখনো বিচার বিভাগ পরাধীন বলে মনে করেন জাতীয় পার্টির সাবেক সংসদ সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী। তিনি বলেন, এই পরাধীন বিচার বিভাগ দিয়ে কখনো স্বাধীন দেশ গড়া যাবে না। বিচারপতিদের ছুটিতে পাঠানো হয়েছে, এগুলো কোনো সমাধান না। এতে রোগের চিকিৎসা হচ্ছে না, রোগীর চিকিৎসা হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘অর্থের অভাবে যে জুডিশিয়ারি তাদের ওয়াশরুম ঠিক রাখতে পারে না, তারা ন্যায়বিচার করবে কোথা থেকে?’
এখন পর্যন্ত বিচারক নিয়োগের নীতিমালা হয়নি উল্লেখ করে জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য মোল্লা মোহাম্মদ ফারুক এহছান বলেন, এমনকি গত ৫ আগস্টের পর যে বিচারপতি নিয়োগ হয়েছে, সেটিও কোন নীতিমালায় হয়েছে, তা–ও এখন পর্যন্ত নিশ্চিত না। তিনি বলেন, যেসব বিচারক ঢাকা জজকোর্টকে চূড়ান্ত মাত্রায় দলীয়করণ করেছিলেন, গত ৫ আগস্টের পর তাঁরাই ‘এ’ দলের জায়গায় ‘বি’ দলের কাছে গিয়ে নিজেদের বিক্রি করার জন্য ঘুরছেন।
অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন সিজিএসের চেয়ার মুনিরা খান। সঞ্চালক ছিলেন সিজিএসের নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান। বক্তব্য দেন সাবেক জেলা জজ ইকতেদার আহমেদ ও এস এম বদরুল ইসলাম, আইনজীবী এম সরোয়ার হোসেইন ও শিহাব উদ্দিন খান, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আতাউর রহমান (ঢালী), অধিকারকর্মী দিদারুল আলম প্রমুখ।