বছর কয়েক আগের কথা! ময়লা-আবর্জনা ও মেডিকেল বর্জ্যের দুর্গন্ধে হাসপাতালটিতে টেকা যেত না। দিনে গরু-ছাগল চড়ে বেড়াত হাসপাতালের চৌহদ্দিতে। রাতে বসত মাদকসেবীদের আড্ডা। চিকিৎসক-নার্সরা বেশি দিন থাকতে চাইতেন না সরকারি এই হাসপাতালে।
গত চার বছরে বদলে গেছে সেই পরিবেশ। ঝকঝকে হয়ে উঠেছে হাসপাতালের ভেতর-বাহির। সবুজে ছেয়ে গেছে চারপাশ। বাড়ানো হয়েছে নিরাপত্তাব্যবস্থা। বসেছে সিসিটিভি ক্যামেরা। রোগীর সঙ্গে আসা স্বজনদের সময় কাটাতে গড়ে তোলা হয়েছে পাঠাগার। সেবা ভালো পাওয়া যায় বলে দূরদূরান্ত থেকে রোগী আসা বেড়েছে। স্বাভাবিক প্রসবেও সুনাম কুড়িয়েছে হাসপাতালটি। চিকিৎসক-নার্সরা এখন আর সহজে এই হাসপাতাল ছাড়তে চান না। কারণ, তাঁদের থাকার জন্য আবাসিক ভবনগুলোও ঢেলে সাজানো হয়েছে।
মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিত্র এটি। মাত্র চার বছরে একটি হাসপাতালের চিত্র এমন পাল্টে দেওয়ার পেছনের কারিগর চিকিৎসক মকছেদুল মোমিন। তিনি মহম্মদপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা।
যেসব পরিবর্তন এসেছে
গত বুধবার সরেজমিনে দেখা যায়, হাসপাতালের ভেতরে-বাইরে ঝকঝকে-তকতকে পরিবেশ। ৭ দশমিক ৫৭ একর জমির ওপর স্থাপিত হাসপাতালটির চারপাশ সীমানাদেয়ালে ঘেরা। ভেতরে লাগানো হয়েছে ফলদ-বনজ, ঔষধিসহ নানা রকম ফুলের গাছ।
গাইনি কনসালট্যান্ট নেই। স্বাভাবিক প্রসব বাড়াতে গর্ভবতী নারীদের নিয়ে সমাবেশের আয়োজন করা হচ্ছে নিয়মিত। যার ফল হিসেবে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মাসে এখন ৬০ থেকে ৭০টি স্বাভাবিক প্রসব হচ্ছে। হাসপাতাল পরিচ্ছন্ন রাখতে বিভিন্ন স্থানে ডাস্টবিন স্থাপন করা হয়েছে। সপ্তাহে এক দিন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মিলে ‘ক্লিন ডে’ পালন করেন।
মাকে হাসপাতালে ভর্তি করেছিলেন মহম্মদপুর সদরের বাসিন্দা আবদুল্লাহ আল মামুন। হাসপাতালের সেবা সম্পর্কে জানতে চাইলে গত বুধবার তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘তিন দিন আগে মাকে ভর্তি করেছিলাম। এখানকার ডাক্তার ও নার্সরা অনেক আন্তরিক। হাসপাতাল থেকে ওষুধ দিয়েছে। নিয়মিত খোঁজখবর নিয়েছে। হাসপাতালের পরিবেশটাও অনেক সুন্দর।’
গোটা হাসপাতালে প্রচুর গাছ লাগানো হয়েছে। হাসপাতাল চত্বর ঘুরে দেখলে ছোটখাটো একটা পার্কের মতো মনে হবে। যেখানে কয়েক শ ফুল ও ফলের গাছ রয়েছে। হাসপাতালজুড়ে বসানো হয়েছে সাউন্ড সিস্টেম, যা দিয়ে রোগীদের বিভিন্ন বার্তা দেওয়া হয়।
২০২০ সালের দিকে হাসপাতালের অন্তর্বিভাগে একটি পাঠাগার স্থাপন করা হয়। সেখানে দুটি আলমারিতে রয়েছে প্রায় ৪০০ বই। স্থানীয় লোকজন বলছেন, হাসপাতালে পাঠাগার স্থাপনের উদ্যোগটি দারুণ। কারণ, রোগী বা স্বজনদের কেউ চাইলে বই পড়ে সময় কাটাতে পারছেন।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বহির্বিভাগে ৯০ হাজার ৬৯৭ জন রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। একই সময়ে অন্তর্বিভাগে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন ৯ হাজার ৯০০ জন। ২০১৮ সালে বহির্বিভাগে সেবা নিয়েছিলেন ৪৯ হাজার ৩৯৫ জন। একই সময়ে অন্তর্বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছিলেন ৬ হাজার ৩০০ জন। চার বছরের ব্যবধানে হাসপাতালে বেড়েছে স্বাভাবিক প্রসবের সংখ্যাও। ২০১৮ সালে এই হাসপাতালে স্বাভাবিক প্রসব হয়েছিল ৪৯০ জনের। ২০২২ সালে স্বাভাবিক প্রসব হয়েছে ৬২৬ জন গর্ভবতীর।
স্থানীয় বাসিন্দা ও মাগুরা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিতে পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে ২০১৮ সালের মার্চ থেকে। তখন হাসপাতালটিতে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার দায়িত্ব পান চিকিৎসক মকছেদুল মোমিন। ২৭তম বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে ২০০৮ সালের নভেম্বরে এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেই চিকিৎসা কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন মকছেদুল মোমিন। ২০১৭-এর নভেম্বরে ভোলার তজুমদ্দিন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হিসেবে পদোন্নতি পাওয়ার আগপর্যন্ত মহম্মদপুরেই কর্মরত ছিলেন মোমিন।
উপজেলাবাসীর মন জয় করেছিলেন। ২০১৮ সালের মার্চে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হিসেবে আবারও মহম্মদপুরে ফিরে আসেন মোমিন। ১৪ বছরের চাকরিজীবনে পাঁচ মাস বাদে বাকি সময় কাজ করেছেন এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বিভিন্ন পদে।
গত বুধবার কথা হয় এই চিকিৎসকের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘চিকিৎসা কর্মকর্তা থেকে শুরু করে বিভিন্ন পদে এই হাসপাতালে চাকরি করেছি, তখন দেখেছি কোথায় কোথায় সমস্যা আছে। কিন্তু ইচ্ছা থাকলেও তখন কিছু করার ছিল না। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হিসেবে যখন এখানে এলাম, তখন একটা একটা করে পরিকল্পনা করে সেগুলো বাস্তবায়ন করেছি। আর এই কাজে সহকর্মীদের পাশাপাশি স্থানীয় জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে সরকারি কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষ সবাই সহযোগিতা করেছেন।’
চিকিৎসকেরা বলছেন, হাসপাতালে সেবার মান বাড়লেও এখনো কিছু সংকট রয়ে গেছে। যে কারণে মানুষ এখনো অনেক সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে—গাইনি, সার্জারি ও অ্যানেসথেসিয়া কনসালট্যান্টের পদগুলো শূন্য থাকায় জরুরি অস্ত্রোপচার ব্যাহত হচ্ছে। হাসপাতালে পুরোনো মডেলের একটি এক্স-রে মেশিন আছে। যন্ত্রটি প্রায়ই বিকল থাকে। হাসপাতালে একটি ডিজিটাল এক্স-রে মেশিন প্রয়োজন।
তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে লোকবলের। ৩১ শয্যার এই হাসপাতাল ২০১৫ সালে ৫০ শয্যায় উন্নীত হয়। প্রশাসনিক অনুমোদন মিললেও ৫০ শয্যার আর্থিক সহায়তা ও জনবল পাওয়া যায়নি।
৩১ শয্যার জনবল দিয়েই চলছে হাসপাতালটি। সে অনুযায়ী চিকিৎসক থাকার কথা ১০ জন, কর্মরত আছেন ৬ জন। নার্স ২৬ জনের মধ্যে আছেন ২৫ জন। তৃতীয় শ্রেণির পদ ৭২টি থাকলেও সেখানে কর্মরত আছেন ৪০ জন। আর চতুর্থ শ্রেণির ১৯টি পদের মধ্যে ১৫টিই শূন্য।
জেলা সদরের অনেক হাসপাতাল থেকে উপজেলার এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ঢের ভালো—এমন মন্তব্য মাগুরার সিভিল সার্জন শহীদুল্লাহ্ দেওয়ানের। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সেখানে নিয়মিত রোগীদের স্বাস্থ্যশিক্ষা দেওয়া হয়। চিকিৎসকেরা সাধারণত রোগনির্ণয় করে ওষুধ দিয়েই ছেড়ে দেন। আর সেখানে এর পাশাপাশি রোগীদের খাবারদাবারসহ অন্যান্য বিষয়েও পরামর্শ দেওয়া হয়। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশ একজন রোগীকে মানসিকভাবে সুস্থ হতে সাহায্য করে।
মহম্মদপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প্রশংসা করে সিভিল সার্জন আরও বলেন, ‘উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে অনেক চিকিৎসকই কাজ করতে চান না। উল্টো পরিবেশ মহম্মদপুরে। সেখান থেকে যদি কোনো চিকিৎসককে আমি সদর হাসপাতালে বদলি করতে চাই, তাঁরা আসতে চান না। কারণ, চিকিৎসকদের ওখানে আবাসিক কোয়ার্টারে থাকার ভালো পরিবেশ রয়েছে। আর ওখানে যিনি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা রয়েছেন, প্রশাসনিক কাজের পাশাপাশি তিনি নিয়মিত রোগী দেখেন। যে কারণে অন্য চিকিৎসকেরাও তাঁদের কাজ ঠিকঠাকভাবে করেন।’