সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কে এখন লাইফস্টাইল ও বুটিক রিসোর্ট

২৬ জানুয়ারি পার্কের ডরমিটরিকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘লাইফস্টাইল ও বুটিক রিসোর্ট’ হিসেবে উদ্বোধন করা হয়।

যশোর সফটওয়্যার পার্ক

তথ্য–প্রযুক্তিভিত্তিক শিল্প স্থাপন ও ব্যবসা পরিচালনার জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি এবং ডিজিটাল বাংলাদেশের জন্য জ্ঞানভিত্তিক শিল্প স্থাপনের উদ্দেশ্য নিয়ে তৈরি হয়েছিল যশোরের শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক। সেখানে বিনিয়োগকারী ও কর্মীদের জন্য তৈরি করা আবাসন সুবিধা বা ডরমিটরিতে চালু হয়েছে রিসোর্ট।

২৬ জানুয়ারি পার্কের ডরমিটরিকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘লাইফস্টাইল ও বুটিক রিসোর্ট’ হিসেবে উদ্বোধন করা হয়। রিসোর্টের পরামর্শক হিসেবে খান প্রপার্টিজ গ্রুপ নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে ১০ বছরের জন্য দায়িত্ব দিয়েছে টেকসিটি বাংলাদেশ লিমিটেড। উল্লেখ্য, টেকসিটি ১৫ বছর পার্কটির ব্যবস্থাপনার জন্য বাংলাদেশ হাই–টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান।

তথ্য–প্রযুক্তি খাতকে এগিয়ে নিতে সরকার যে শ খানেক হাই–টেক পার্ক প্রতিষ্ঠা করছে, তার একটি যশোরের শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক। এটি চালু হয় ২০১৭ সালের ১০ ডিসেম্বর। যশোর শহরের নাজির শঙ্করপুর এলাকায় ১২ একরের বেশি জমিতে প্রতিষ্ঠিত পার্কটিতে তিনটি ভবন রয়েছে। বিনিয়োগকারীদের জন্য ইজারাযোগ্য জায়গা রয়েছে ১ লাখ ৩৭ হাজার বর্গফুট। আরও রয়েছে আবাসন, সম্মেলন, মেলা আয়োজনসহ নানা সুবিধা। পার্কটি নির্মাণে সরকারের ব্যয় হয়েছে ৩০৫ কোটি টাকা।

অবশ্য পার্কটিতে লক্ষ্য অনুযায়ী কর্মসংস্থান হয়নি। বিনিয়োগের গুণগত মান নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। কারণ, বেশির ভাগ বিনিয়োগকারী ই-কমার্স, কল সেন্টার, ইন্টারনেট সেবা ও ডিজিটাল মার্কেটিং নিয়ে কাজ করে। সফটওয়্যার টেকনোলজি নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান নগণ্য।

এরই মধ্যে পার্কে দর্শনার্থী ও অতিথি আকর্ষণের জন্য ২০১৯ সালের নভেম্বরে ডরমিটরি ভবনের নাম পরিবর্তনের আবেদন জানায় টেকসিটি। তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে পার্ক কর্তৃপক্ষ ‘যশোর আইটি প্যালেস’ বা ‘যশোর আইটি প্যারাডাইস’ নাম নির্ধারণ করে।

অবশ্য এতেও কাজ হয়নি। গত ২১ ডিসেম্বর হাই–টেক পার্ক কর্তৃপক্ষকে আবার চিঠি দেয় টেকসিটি। তাতে তারা লিখেছে, শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কের ডরমিটরি ভবনে অতিথি আগমনের হার খুব কম। এ বিষয়ে টেকসিটি হোটেল ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানের পরামর্শ গ্রহণ করে। তারা ডরমিটরি ভবনের ব্যবহার বাড়ানো ও অতিথিদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দেয়। তারা ডরমিটরি ভবনের নাম পরিবর্তনেরও কথা বলে।

চিঠিতে টেকসিটি আরও লিখেছে, বর্তমান ভবনের নামের সঙ্গে হোটেল অথবা রিসোর্ট শব্দ না থাকার কারণে অতিথিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা সম্ভব হচ্ছে না। হোটেল অথবা রিসোর্ট শব্দ না থাকার কারণে অনলাইনে সার্চ ইঞ্জিনে যশোরকেন্দ্রিক হোটেল বা রিসোর্টের খোঁজ করা হলে যশোর আইটি প্যারাডাইস পাওয়া যায় না।

এসব যুক্তি তুলে ধরে টেকসিটির পক্ষ থেকে পার্কের ডরমিটরি ভবনের নাম ‘যশোর আইটি পার্ক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট’ নির্ধারণের প্রস্তাব দেওয়া হয়। টেকসিটির চিঠির পর ২৫ জানুয়ারি নতুন নামের অনুমোদন দেয় হাই–টেক পার্ক কর্তৃপক্ষ।

অনুমোদনের চিঠির পরদিনই হোটেল ও রিসোর্টের উদ্বোধন করা হয় পার্কটিতে। নাম অবশ্য দেওয়া হয়েছে ‘লাইফস্টাইল ও বুটিক রিসোর্ট’। খান প্রোপার্টিজ জানিয়েছে, রিসোর্টে ২৪ ঘণ্টা গ্রাহক সেবা (কাস্টমার সার্ভিস), রেস্তোরাঁ, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, উপহারের দোকান, কফি পানের দোকান, ছবি গ্যালারি, ব্যবসায়িক সম্মেলনকেন্দ্র, নামাজের জায়গা, খেলার জায়গা, শিশুদের খেলার ব্যবস্থা, সম্মেলন কক্ষ এবং পুরুষদের জন্য সেলুন ও ব্যায়ামাগারের মতো সেবা চালু করেছে।

রিসোর্টটিতে আন্তর্জাতিক মানের পাঁচ তারকা হোটেলের সেবা রয়েছে দাবি করে খান প্রোপার্টিজ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী মাসুদুর রহমান খান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা রিসোর্টের বিপণন ও পরিচালন–সংক্রান্ত বিষয়ে পরামর্শকের কাজ করবেন।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কে ডরমিটরি নির্মাণ করা হয়েছিল বিনিয়োগকারী, বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মী ও সম্মেলনে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের আবাসন সুবিধার জন্য। সেটাকে রিসোর্টে পরিণত করার বিষয়ে জানতে চাইলে টেকসিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওয়াহিদ শরীফ প্রথম আলোকে বলেন, এত দিন তাঁরা প্রাথমিক পর্যায়ে এমটিবি ভবনে বিনিয়োগকারীদের জায়গা বরাদ্দ দেওয়া নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। এখন হোটেল ব্যবস্থাপনায় নজর দিয়েছেন।

উল্লেখ্য, টেকসিটির সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী পার্ক থেকে যে আয় হয়, তার ৮২ শতাংশ টেকসিটি ও ১৮ শতাংশ হাই–টেক পার্ক কর্তৃপক্ষ পায়। মানে হলো, এখান থেকে সরকারের বিনিয়োগের বিপরীতে আয় খুবই নগণ্য। পার্কটি উদ্বোধনের পর পাঁচ বছরে আট কোটি টাকার মতো আয় হয়েছে। এর মধ্যে সরকার পেয়েছে ২ কোটি ১২ লাখ টাকা। বাকিটা পেয়েছে টেকসিটি।

ডরমিটরিকে রিসোর্টে পরিণত করার ঘটনাটি নিয়ে পার্কের বিনিয়োগকারীদের সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. শাহাজালাল প্রথম আলোকে বলেন, এটা ভালো কিছু হলো না। তথ্য–প্রযুক্তি খাতকে বিকশিত করার জন্য সরকার আইটি পার্ক গড়ে তোলে। কিন্তু এখন পার্কের ডরমিটরিকে বিনোদনকেন্দ্রে পরিণত করা হলো। এতে সরকারের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে।

লাইফস্টাইল ও বুটিক রিসোর্ট করলে সফটওয়্যার পার্কের পরিবেশ ও উদ্দেশ্য ব্যহত হবে না বলে মনে করেন হাই–টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকর্ণ কুমার ঘোষ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ডরমেটরি নাম শুনলে কেউ আসতে চাইবে না। এ ছাড়া এটা ঠিকমতো ব্যবস্থপনা হচ্ছিল না। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য ডরমিটরিকে আধুনিক করা হচ্ছে।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, যশোরের সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কটি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল ১. দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে তথ্য–প্রযুক্তি শিল্পের উন্নয়ন, ২. মৌলিক অবকাঠামো করা, ৩. বিনিয়োগকারীদের জন্য তথ্য–প্রযুক্তিভিত্তিক শিল্প স্থাপন ও ব্যবসা পরিচালনার জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা, ৪. কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা এবং ৫. ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে জ্ঞানভিত্তিক শিল্প স্থাপন।

পার্কটি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ যখন নেওয়া হয়, তখন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সচিব ছিলেন মো. নজরুল ইসলাম খান। পার্কের বর্তমান পরিস্থিতি প্রসঙ্গে মতামত জানতে চাইলে তিনি হতাশা প্রকাশ করে প্রথম আলোকে বলেন, পার্কটির উদ্দেশ্যে ছিল মানুষের জন্য সুযোগ তৈরি করা। ডরমিটরিটি তিন তারকা মানের হোটেল হবে, যেখানে পাশের দেশ ভারত থেকে বিনিয়োগকারীরা এসে থাকার সুবিধা পাবে। তিনি আরও বলেন, ‘টাকা তৈরি করা বড় কথা না, মানুষ তৈরি করাই বড়। এখনকার দায়িত্বপ্রাপ্তরা কীভাবে চিন্তা করছেন তা জানি না।’

টেকসিটির প্রতিবাদ ও প্রতিবেদকের বক্তব্য

১৮ জানুয়ারি প্রথম আলো ও প্রথম আলোর অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত ‘টিকে থাকতে যশোর সফটওয়্যার পার্কে বিয়ের অনুষ্ঠান’ শিরোনামের প্রতিবেদনের প্রতিবাদ জানিয়েছে টেকসিটি বাংলাদেশ লিমিটেড। তারা বলেছে, এ প্রতিবেদন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং এতে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার প্রয়াস রয়েছে।

টেকসিটি আরও বলেছে, তারা সফলতার সঙ্গে পার্কটি পরিচালনা করছে। সম্মেলনকেন্দ্র বাইরের কারও কাছে তখনই ভাড়া দেওয়া হয়, যখন বিনিয়োগকারীদের চাহিদা থাকে না। এতে নিয়মের কোনো ব্যত্যয় হয়নি। বাড়তি বিদ্যুৎ বিল আদায়ের অভিযোগ সত্য নয়। পার্কে দুই হাজার মানুষ কাজ পেয়েছে।

প্রথম আলোর প্রতিবেদনটিতে পার্কে বিয়ের অনুষ্ঠান আয়োজনের কথা বলা হয়েছে। সেটা প্রতিবাদপত্র অস্বীকার করা হয়নি। বিদ্যুৎ বিল ও অব্যবস্থাপনার বিষয়ে বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ যে টেকসিটি অস্বীকার করেছে, তা প্রতিবেদনেই আছে। পার্কে দুই হাজার লোকের কর্মসংস্থানের তথ্য এটাই তুলে ধরে যে পার্কটি এ ক্ষেত্রে লক্ষ্য পূরণ করতে পারেনি।