ক্ষমতাসীনেরা অনেক সময় গণমাধ্যমের সহায়ক শক্তির ভূমিকাকে মেনে নিতে চান না। তথ্য প্রকাশকে শত্রুতা হিসেবে দেখে থাকেন। এমন পরিবেশ তৈরি করে রাখা হয়েছে, যাতে এখনো সুষ্ঠু সাংবাদিকতা করা কঠিন। অবিলম্বে স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য ভয়ডরহীন পরিবেশ সৃষ্টির জন্য সুস্পষ্ট পদক্ষেপ নিতে হবে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা পুরস্কারের ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত অনুসন্ধানী সাংবাদিক সম্মেলনে বক্তারা এ কথাগুলো বলেন। আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
আয়োজনটি ছিল তিনটি পর্বে। দ্বিতীয় পর্বে ‘নতুন বাংলাদেশ: কেমন গণমাধ্যম চাই’ শীর্ষক প্যানেল আলোচনায় কথা বলেন গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ। একধরনের ‘তথ্যবন্যা’ চলছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের বড় ধরনের কৌশল ছিল, যেসব সংবাদমাধ্যম বস্তুনিষ্ঠভাবে সাংবাদিকতা করবে, অজস্র প্রচারমাধ্যমের প্রচারে তাদের সেসব তথ্য হারিয়ে যাবে। সে কারণে সক্ষমতা না থাকলেও টেলিভিশন চ্যানেল ও সংবাদপত্র প্রকাশের অনুমতি দিয়েছে। এমন আবেদনপত্রও দেখা গেছে, আবেদনকারী আওয়ামী লীগের কর্মী। তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের আদর্শ ও উন্নয়নের তথ্য প্রচারের জন্য টেলিভিশন চ্যানেল চান। আর কোনো যোগ্যতার কথা ছিল না। সেই আবেদন অনুমোদন হয়েছে, সেই টেলিভিশন সম্প্রচারে আছে।
এমন টেলিভিশন চ্যানেলকে গণমাধ্যম বলা যাবে কি না, সেই প্রশ্ন রেখে কামাল আহমেদ বলেন, গণমাধ্যম জনস্বার্থ রক্ষা করছে কি না, জনস্বার্থের পক্ষে কাজ করছে কি না, সেটা দেখা দরকার। রাজধানী থেকে ৫৪০টির বেশি পত্রিকা প্রকাশিত হয় জানিয়ে তিনি বলেন, ১০০, ২০০, ৫০০ কপি ছাপিয়ে অনেক পত্রিকা মূলধারার গণমাধ্যমের বিজ্ঞাপনে ভাগ বসায়। তাদের কর্মীও নেই।
নিউ এজ সম্পাদক নূরুল কবীর বলেন, ফোনে কথা বললে জাতীয় নিরাপত্তার নামে রেকর্ড করা হয়। অবাধ তথ্যপ্রবাহ বা সাংবাদিকের তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে এটি বাধা। সাংবাদিকতার সঙ্গে সম্পর্কিত আইনকানুন ও বিধির গণতন্ত্রায়ণ দরকার। এমন পরিবেশ তৈরি করে রাখা হয়েছে, যার কারণে সুষ্ঠু ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা করা কঠিন।
রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন না আসা পর্যন্ত গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে বাস্তব পরিবর্তন সম্ভব হবে নাইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক, টিআইবি।
দেশের কপিরাইট আইন খুব দুর্বল বলে উল্লেখ করেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব মোহাম্মদ শফিকুল আলম। বলেন, একটি প্রতিষ্ঠান কোটি টাকা বিনিয়োগ করে প্রতিবেদন তৈরি করল, আর অন্য একটি প্রতিষ্ঠান তা চুরি করে চালিয়ে দিচ্ছে। যারা প্রতিবেদন তৈরি করছে, তাদের সুরক্ষা দিতে হবে। কপিরাইট নিশ্চিত করতে পারলে আরও বিনিয়োগ আসবে। সাংবাদিকতা যেন নৈতিক জায়গায় থাকে, সেটাও নিশ্চিত করার কথা বলেন তিনি।
গণমাধ্যমকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলার বিষয়ে শফিকুল আলম বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার মামলা করছে না। এমনভাবে লেখা হচ্ছে যেন এর দায় সরকারের। তদন্ত করাটা সরকারের দায়িত্ব। এ জন্য আট সদস্যের তদন্ত কমিটি করে দেওয়া হয়েছে। ১৬৯ সাংবাদিকের অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বাতিলের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
‘কেমন গণমাধ্যম চাই’ শীর্ষক আলোচনা সঞ্চালনা করেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। দেশের রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন না আসা পর্যন্ত গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে বাস্তব পরিবর্তন সম্ভব হবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, তাই বলে আশা ছাড়লে হবে না।
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, পৃথিবীর সব দেশেই গণমাধ্যমের কাজটা কঠিন। ক্ষমতাসীনদের সমালোচনা করে তাদের সহায়ক শক্তি হিসেবে গণমাধ্যম ভূমিকা পালন করে থাকে। কিন্তু সহায়ক শক্তির ভূমিকাটা ক্ষমতাসীনেরা অনেক সময় মেনে নিতে চান না। তথ্য প্রকাশকে অনেক সময় শত্রুতা হিসেবে দেখা হয়।
এ পর্বে আরও বক্তব্য দেন পিআইবির মহাপরিচালক ফারুক ওয়াসিফ।
এ অধিবেশনে ‘নতুন বাংলাদেশ: কেমন গণমাধ্যম চাই’ শীর্ষক একটি প্রস্তাব তুলে ধরে টিআইবি। প্রস্তাবে বলা হয়, অবিলম্বে স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য ভয়ডরহীন উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টিতে সুস্পষ্ট ও কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। পতিত সরকারের দোসর অভিযোগে সাংবাদিক হয়রানির চলমান চর্চা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। গণমাধ্যমের ওপর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আক্রমণ ও হুমকি–হামলায় জড়িত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
প্রথম পর্বে আলোচনা হয় অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা বিষয়ে। সেখানে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ মিশনের প্রেস মিনিস্টার গোলাম মোর্তোজা বলেন, এখন দেশে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার পরিবেশ আছে। তবে দুর্বল প্রতিষ্ঠান কখনো সবল সাংবাদিকতা করতে পারে না। গণ–অভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে সেনানিবাসে ৬২৬ জন আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাঁরা কারা, কারা তাঁদের আশ্রয় দিয়েছিল, কীভাবে তাঁরা চলে গেলেন—এসব নিয়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু কেউ তা করেনি।
এখন পরিস্থিতি খুব অস্থির বলে মনে করেন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক কুর্রাতুল-আইন-তাহ্মিনা। তিনি বলেন, এখন জানা যায় না কোন দিক থেকে বাধা আসবে। সে জন্য গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো সতর্কভাবে পা ফেলছে বা ফেলতে হচ্ছে।
এ অধিবেশনে আরও বক্তব্য দেন সাংবাদিক মোহা. বদরুদ্দোজা ও দৈনিক গ্রামের কাগজ সম্পাদক মবিনুল ইসলাম। প্রথম অধিবেশন সঞ্চালনা করেন টিআইবির পরিচালক তৌহিদুল ইসলাম।
পুরস্কার পেলেন যাঁরা
তৃতীয় পর্বে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা পুরস্কার, ২০২৪ দেওয়া হয়। জাতীয় সংবাদপত্র বিভাগে বিজয়ী হয়েছেন দ্য ডেইলি স্টার–এর জায়মা ইসলাম, টেলিভিশন বিভাগে (প্রতিবেদন) যমুনা টেলিভিশনের আল-আমিন হক, টেলিভিশন (প্রামাণ্য অনুষ্ঠান) বিভাগে ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের ‘তালাশ’ এবং আঞ্চলিক সংবাদপত্র বিভাগে চট্টগ্রামের ‘একুশে পত্রিকা ডটকম’–এর শরীফুল ইসলাম।