বেইলি রোডে আগুন থেকে বেঁচে ফিরেছেন তাঁরা, জানালেন ভয়াবহ অভিজ্ঞতা

ফিরোজ আল মামুন
ছবি: প্রথম আলো

বাবার জন্য পাঞ্জাবি কিনতে গত বৃহস্পতিবার রাতে বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ ভবনে যান ব্যবসায়ী ফিরোজ আল মামুন ফয়সাল। দুটি পাঞ্জাবি পছন্দ করে টাকা পরিশোধ করছিলেন । ঠিক তখনই শুনতে পান ভবনটিতে আগুন লেগেছে।

তাড়াহুড়া করে ভবনের তৃতীয় তলা থেকে সিঁড়ি দিয়ে হেঁটে নিচে নেমে যান ফিরোজ আল মামুন। কিন্তু বের হতে পারেননি। তাঁর অভিযোগ, আগুন লাগার পর ভবনের গেট তালা দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়।

আবার সিঁড়ি বেয়ে তিনতলার পাঞ্জাবির ওই দোকানে ঢুকে পড়েন ফিরোজ আল মামুন। ততক্ষণে ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে পুরো কক্ষ। বিদ্যুৎও চলে গেছে। পুরো ভবনেই আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। প্রায় দেড় ঘণ্টা ওই কক্ষে অনেকের সঙ্গে আটকে ছিলেন ফিরোজ আল মামুন। আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর তাঁকে উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা। পরে তাঁকে ভর্তি করা হয় শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে।

আজ শনিবার দুপুরে হাসপাতালে গিয়ে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়লে শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। তখন মেঝেতে  শুয়ে শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। পাঞ্জাবি ও রুমাল ভিজিয়ে মুখে পানি দিচ্ছিলেন। বেঁচে ফেরার  আশাও ছেড়ে দিয়েছিলেন।

ফিরোজ আল মামুন আরও বলেন, 'তখন প্রতি সেকেন্ডকে ১ ঘণ্টার মতো মনে হচ্ছিল। আমার ১০ মাসের একটি মেয়ে রয়েছে। শুধু বাবা ডাকতে পারে। ওই ভয়াল সময়টাতে শুধু মেয়ের ছবি চোখের সামনে ভাসছিল। ওর জন্য কান্নায় বুক ফেটে যাচ্ছিল।’

আগুন লাগার খবর পেয়ে  বাবা বারবার ফোন করছিলেন ফিরোজ আল মামুনকে। কয়েকবার বাবার ফোন কেটে দেন তিনি। বেঁচে ফিরবেন কি না আর দেখা হবে কি না, সেটা ভেবে পরে বাবার ফোন ধরে দোয়া করতে বলেন।

ফিরোজ আল মামুনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাঁর গ্রামের বাড়ি মানিকগঞ্জ জেলার হরিরামপুর উপজেলায়। পরিবার নিয়ে ঢাকার কেরানীগঞ্জে থাকেন। সেখানে স্টার প্যাকেজিং নামে  তাঁর একটি কারখানা রয়েছে।

রাজধানীর বেইলি রোডে বহুতল ভবনে বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ১০টার দিকে আগুন লাগে
মেহেদী হাসান

ফিরোজ আল মামুনের মতো আগুনে দগ্ধ মেহেদী হাসানের চিকিৎসা চলছে বার্ন ইনস্টিটিউটে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, চীন থেকে তাঁদের এক বন্ধু এসেছেন। স্ত্রী উম্মে হাবিবাকে সঙ্গে নিয়ে ওই বন্ধুর সঙ্গে বেইলি রোডে খেতে গিয়েছিলেন তাঁরা। খাবারের মেনু যখন হাতে নেন, ঠিক তখনই আগুন লেগে যায়। মেহেদী হাসান বলেন, ‘ওই দিনের আগুনের বিমর্ষ ছবি আর মনে করতে চাই না।’

চার বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে খেতে এসেছিলেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সাদ মাহমুদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কয়েকবার সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামার চেষ্টা করেছি। আগুন লাগার কিছুক্ষণের মধ্যে পুরো ভবন ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। পরে সিঁড়ি দিয়ে নামতে পারিনি।’ যখন পুরো ভবনে আগুন ছড়িয়ে পড়ে, তখন সবাই ছোটাছুটি করছিলেন। তখন বন্ধুদের হারিয়ে ফেলেন সাদ মাহমুদ।

সাদ আরও বলেন, ভবনের ছয় তলার একটি খাবারের দোকানের রান্নাঘরে ৬০/৭০ জন গিয়ে আশ্রয় নেন। অনেকেই বের হয়ে গেলে শেষ পর্যন্ত ১০ থেকে ১৫ জন সেখানে ছিলেন। অনেকে ভয় পেয়ে ছয়তলার জানালা ভেঙে তাঁর সামনেই লাফিয়ে নিচে পড়ছিলেন ‌। আগুনে  দুই বন্ধু মারা গেছেন বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।

সাদ মাহমুদ

বেইলি রোডের ওই ভবনের আগুনে এ পর্যন্ত  ৪৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। ১১ জন আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তাঁরা কেউ ‘শঙ্কামুক্ত’ নন। জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে ৭৫ জনকে।

আগুনের ভয়াবহতা ও মৃত্যুর পর ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন গতকাল বেইলি রোডে গিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ভবনটিতে কোনো অগ্নিনিরাপত্তার ব্যবস্থা ছিল না। ঝুঁকিপূর্ণ জানিয়ে তিনবার চিঠি দেওয়া হয়েছিল; কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অন্যদিকে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) জানিয়েছে, ভবনটিতে রেস্তোরাঁ বা পণ্য বিক্রয়কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার কোনো অনুমোদন ছিল না।

আগুনের ঝুঁকি ও অনুমোদন না থাকার পরও ভবনটিতে আটটি রেস্তোরাঁ চলছিল বছরের পর বছর ধরে। সপ্তাহের শেষ কর্মদিবসে সেখানে খেতে ভিড় করেছিলেন নগরের বাসিন্দারা। কেউ গিয়েছিলেন শিশুসন্তানদের নিয়ে, কেউ গিয়েছিলেন স্বজনদের নিয়ে, কেউ গিয়েছিলেন বন্ধুদের সঙ্গে। কারও কারও জীবন চলত ওই ভবনে থাকা প্রতিষ্ঠানে কাজ করে।