মুরগির বাজার
মুরগির বাজার

পশুপাখির রোগ মানুষে

রোগ সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি মুরগির বাজারে

সারা বিশ্বে মানুষের মধ্যে যেসব সংক্রামক রোগ এখন দেখা যাচ্ছে, তার ৬০ শতাংশ এসেছে জীবজন্তু–পশুপাখি থেকে।

জীবজন্তু–পশুপাখির রোগে মানুষের আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা বৈশ্বিকভাবেই এখন সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, সারা বিশ্বে মানুষের মধ্যে যেসব সংক্রামক রোগ এখন দেখা যাচ্ছে, তার ৬০ শতাংশ এসেছে জীবজন্তু বা পশুপাখি থেকে। বাংলাদেশে সংক্রমণ ছড়ানোর সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ স্থান হাঁস-মুরগির বাজার।

জীবজন্তুর রোগ কীভাবে মানুষের মধ্যে আসে এবং কীভাবে তা প্রতিহত করা যায়—এ বিষয়ে স্বাস্থ্য খাত নিয়ে কাজ করা সাংবাদিকদের জন্য আয়োজিত কর্মশালায় এই তথ্য তুলে ধরা হয়। গতকাল সোমবার রাজধানীর আদাবরের একটি মিলনায়তনে যৌথভাবে এই কর্মশালার আয়োজন করে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি), আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা ইন্টারনিউজ ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ভয়েস। কর্মশালায় আর্থিক সহায়তা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের দাতা সংস্থা ইউএসএআইডি।

আইসিডিডিআরবির ‘স্টপ স্পিলওভার’ (জীবজন্তু থেকে রোগ যাতে ছড়িয়ে না পড়ে) কর্মসূচির প্রধান নাদিয়া রিমি বলেন, দেশের বিজ্ঞানী ও গবেষকেরা প্রাথমিকভাবে ২০টা স্থান চিহ্নিত করেছেন, যেসব স্থানে মানুষ ও জীবজন্তু–পশুপাখিকে একে অন্যের সংস্পর্শে তুলনামূলকভাবে বেশি আসতে দেখা যায়। এর মধ্যে নয়টি স্থানকে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ মনে হয়। এর মধ্যে আছে বাদুড়ের প্রতিবেশ, মানুষের আবাসস্থলে স্তন্যপায়ী পশু পালন, হাঁস–মুরগি শিল্প, মানুষ ও পশুপাখির এক সঙ্গে চলাচল, পরিযায়ী পাখির স্থান, উন্মুক্ত সাফারি পার্ক ও জাতীয় উদ্যান, গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ও পরীক্ষাগার, পশু হাসপাতাল এবং জাতীয় উদ্যানের পার্শ্ববর্তী এলাকা। বিজ্ঞানীরা অনুমান করছেন, এর মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ মুরগির বাজার, বিশেষ করে রাজধানীর মুরগির বাজারগুলো। কারণ, এখানে মানুষের যাতায়াত অনেক বেশি।

নাদিয়া রিমি বলেন, হাঁস–মুরগির বাজারের অবকাঠামো দুর্বল। সেখানে বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও অপ্রতুল। ক্রেতা–বিক্রেতা ছাড়াও আরও অনেক ধরনের মানুষ এই বাজারের সঙ্গে যুক্ত। একটি গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, ২৫ শতাংশ হাঁস–মুরগি মেঝেতে রাখা হয়। বাঁশের বা লোহার খাঁচা বা মেঝে নিয়মিত পরিষ্কার করা হয় না।

বাংলাদেশে বার্ড ফ্লু মুক্ত হতে পারেনি—এই তথ্য উল্লেখ করে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুল মান্নান বলেন, ২০০৭–০৮ সালে ৪৭টি জেলার ১২৮ উপজেলায় এবং বিভিন্ন মহানগরের ১৪টি থানা এলাকায় বার্ড ফ্লুর প্রকোপ দেখা দিয়েছিল। তখন ১৬ লাখ মুরগি ও ২২ লাখ ডিম ধ্বংস করা হয়েছিল। প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ বেকার হয়ে পড়েছিলেন। ৪ হাজার ১৬৫ কোটির টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছিল। দেশে এখনো বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্নভাবে বার্ড ফ্লু দেখা দেয়।

কর্মশালায় জানানো হয়, ২০০৭ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে সারা দেশে মোট ৫৫৬ বার বার্ড

ফ্লুর প্রকোপ দেখা দেয়। দেশে এ পর্যন্ত ১১ জন বার্ড ফ্লুতে আক্রান্ত হয়েছেন, এর মধ্যে ৩ জন ছিলেন বাজারের মুরগি বিক্রেতা। বার্ড ফ্লুতে দেশে মারা গেছেন একজন।

আলোচকদের বক্তব্যে উঠে এসেছে, জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও নগরায়ণের কারণে বন ধ্বংস হচ্ছে। বনের জীবজন্তু–পশুপাখির আবাসস্থল সংকুচিত হয়ে পড়ছে। এর ফলে জীবজন্তু–পশুপাখির বেশি সুযোগ তৈরি হচ্ছে মানুষের সংস্পর্শে আসার। এতে পশুপাখির রোগ মানুষের মধ্যে আসার ঝুঁকিও বাড়ছে। এইচআইভি, ইবোলা, নিপাহ ও হালের কোভিড–১৯—সবই এই ধরনের রোগ।

জীবজন্তুর কোন রোগ সরাসরি, কোন রোগ পরোক্ষভাবে, কোন রোগ কীটপতঙ্গের মাধ্যমে বা কোনটি খাবার বা পানির মাধ্যমে মানুষের শরীরে আসে—কর্মশালায় তার বিস্তারিত বর্ণনা দেন সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. সেলিম উজ্জামান। তিনি বলেন, জীবজন্তু–পশুপাখি থেকে আসা ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, পরজীবী (প্যারাসাইট) ও ছত্রাক মানুষের রোগের কারণ হতে দেখা গেছে।

অনুষ্ঠানের শুরুতে ইউএসএআইডির জনসংখ্যা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি কর্মসূচির উপপরিচালক বেলে মেঙ্গেস্টু বলেন, যুক্তরাষ্ট্র সরকার জীবজন্তু–পশুপাখি থেকে মানুষের মধ্যে রোগ ছড়িয়ে পড়াকে নিরাপত্তার বিষয় হিসেবে বিবেচনা করে। বিষয়টি শুধু জনস্বাস্থ্যের সংকটের বিষয় নয়, এর সঙ্গে সঠিক তথ্য আদান–প্রদানের বিষয়ও জড়িত। মানুষকে সঠিক তথ্য বা বার্তা জানানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন সাংবাদিকেরা।