মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপাদানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেছে রেয়ন।
প্রতিদিন ৩০০ কোটি প্লাস্টিকের কণা বঙ্গোপসাগরে পড়ছে।
বাংলাদেশ ও ভারতের গঙ্গা অববাহিকা অঞ্চলের পানি, পলি এবং বাতাসে মাইক্রোপ্লাস্টিকের আশঙ্কাজনক উপস্থিতি দেখা গেছে। দুই দেশের বিজ্ঞানীদের সম্মিলিত এক গবেষণায় এ চিত্র উঠে এসেছে। এই প্রথমবারের মতো গঙ্গা অববাহিকার মতো এত বড় একটি নদীব্যবস্থার পানি, পলি এবং বাতাসে মাইক্রোপ্লাস্টিকের কণার হিসাব করা হলো।
জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব সামলাতে ব্যস্ত বাংলাদেশ। এখানকার জলবায়ু পরিবর্তন ত্বরান্বিত করছে এই মাইক্রোপ্লাস্টিক, পৃথক আরেক গবেষণায় এমন চিত্রও পাওয়া গেছে।
এ অবস্থায় আজ ২২ এপ্রিল বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে বিশ্ব ধরিত্রী দিবস। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য হলো ‘এই গ্রহ বনাম মাইক্রোপ্লাস্টিক।’
পানি, পলি ও বায়ুতে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি নিয়ে গবেষণাটি গত বছরের আগস্ট মাসে নেদারল্যান্ডসের সায়েন্স অব দ্য টোটাল এনভায়রনমেন্ট সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে।
বাংলাদেশ ও ভারতের গঙ্গা অববাহিকা অঞ্চলে মাইক্রোপ্লাস্টিকের আশঙ্কাজনক উপস্থিতি দেখেছেন গবেষকেরা।
কীভাবে হলো গবেষণা, কারণ কী
বাংলাদেশ ও ভারতের ১০টি স্থান গবেষণার জন্য নির্ধারিত হয়। পুরো নদী অববাহিকা অঞ্চলের সঠিক প্রতিনিধিত্ব যাতে থাকে, সেই বিবেচনাতেই এলাকাগুলো নির্ধারণ করা হয়। বাংলাদেশের তিন স্থান হলো ভোলা, চাঁদপুর ও রাজবাড়ী।
গবেষণায় বাতাসে ও পানিতে মাইক্রোপ্লাস্টিকের কণার মিশ্রণের নগরায়ণ ও নাগরিক জীবনের প্রভাব দেখা হয়েছে। গবেষণার জন্য গঙ্গা নদী এবং এর আশপাশের এলাকার পানি, পলি এবং বায়ু থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়। ২০১৯ সালের মে থেকে জুন মাস পর্যন্ত সময়ে নমুনাগুলো সংগ্রহ করা হয়। সংগৃহীত নমুনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ওয়াইল্ডলাইফ ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া এবং যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব প্লাইমাউথের পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়।
এ গবেষণায় বাংলাদেশের গবেষকদের নেতৃত্ব দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক গাউসিয়া ওয়াহেদুন্নেসা চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই গঙ্গা অববাহিকার বিশাল অঞ্চলের পানি, বায়ু ও পলিতে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি কেমন, তা নিয়ে আগে কোনো গবেষণা ছিল না। আমরা সেটাই প্রথমবারের মতো দেখেছি। কোন উৎস থেকে মাইক্রোপ্লাস্টিক বায়ু ও পানির মাধ্যমে নদীর তলদেশে গিয়ে মিশছে, আমরা সেই দিকে নজর দিতে চেয়েছি। প্রতিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের ওপর মাইক্রোপ্লাস্টিকের এই প্রভাব দুই দেশের নীতিনির্ধারকদের নীতি নির্ধারণে সহায়তা করবে বলে আমাদের ধারণা।’
গবেষণায় যা পাওয়া গেল
পাঁচ মিলিমিটারের চেয়ে ছোট প্লাস্টিকের কণাকে মাইক্রোপ্লাস্টিক বলা হয়। গবেষণায় দেখা যায়, পানি ও পলির সঙ্গে মিলে মাইক্রোপ্লাস্টিকের কণা মিশছে বঙ্গোপসাগরে। গবেষণায় ধারণা করা হয়েছে, বিপুল পরিমাণ মাইক্রোপ্লাস্টিক পলিতে জমে যাচ্ছে। মাইক্রোপ্লাস্টিকের ক্ষেত্রে রেয়নই সবচেয়ে বড় উপাদান আর রঙের মধ্যে নীলই প্রধান।
গবেষণায় দেখা গেছে, গঙ্গা অববাহিকার নদীর প্রতি ২০ লিটার পানিতে অন্তত একটি মাইক্রোপ্লাস্টিকের কণা পাওয়া গেছে। প্রতি কিলোগ্রাম পলিতে পাওয়া গেছে ৫৭টি কণা। আর বাতাসে প্রতি বর্গমিটারে মাইক্রোপ্লাস্টিকের কণার সংখ্যা ছিল ৪১।
গবেষণায় অনুমান করা হয়েছে, গঙ্গা নদী এবং এর উপনদীগুলোর মাধ্যমে প্রতিদিন ১০০ থেকে ৩০০ কোটি মাইক্রোপ্লাস্টিকের কণা বঙ্গোপসাগরে পড়ছে।
মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপাদানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেছে রেয়ন। এর পরিমাণ ছিল ৫৪ থেকে ৮২ শতাংশ। এরপর আছে আক্রেলিক (৬ থেকে ২৩ শতাংশ) এবং পলিস্টার (৯ থেকে ১৭ শতাংশ)। বিভিন্ন ধরনের রঙের মধ্যে সর্বোচ্চ ৪৮ থেকে ৭৯ শতাংশ আছে নীল রং।
গবেষকেরা দেখেছেন, পোশাকের তন্তু মাইক্রোপ্লাস্টিকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিল। নমুনার ৯৫ থেকে ৯৯ শতাংশই পোশাক থেকে পাওয়া।
পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনে প্রভাব
গবেষণার উল্লেখযোগ্য দিক হলো, এখানে জনসংখ্যার সঙ্গে মাইক্রোপ্লাস্টিকের সম্পর্ক দেখানো হয়েছে। দেখা গেছে, যেখানে জনঘনত্ব বেশি, সেখানে পানি ও বায়ুতে, বিশেষ করে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি বেশি। যেমন ভারতের বারানসিতে ঘনত্ব বেশি হওয়ায় সেখানে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতিও বেশি। তবে বাংলাদেশের রাজবাড়ীতে ঘনত্ব কম হওয়ায় সেখানে এর উপস্থিতি কম। তবে রাজবাড়ীর কাছের নদীতে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি অনেক বেশি। এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, রাজবাড়ীতে পয়োবর্জ্য এবং কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রায় নেই বললেই চলে। তাই এসব বর্জ্য নদীতে গিয়ে মেশে।
এই গবেষণার পাশাপাশি ‘দ্য ইকোলজিক্যাল ইমপ্যাক্ট অব প্লাস্টিক পলুশন ইন এ চেঞ্জিং ক্লাইমেট’ শীর্ষক গবেষণায় দেখানো হয়েছে, দেশের মোট দূষণের ১০ শতাংশ মাইক্রোপ্লাস্টিকের কারণে ঘটছে। অপরিশোধিত এই উপাদানের জন্য কার্বন ডাই–অক্সাইডসহ নানা ধরনের গ্যাস ছড়াচ্ছে। আর তাতে জলবায়ু পরিবর্তনে ভূমিকা রাখছে মাইক্রোপ্লাস্টিক। অব্যবস্থাপনার কারণে সাগরে মাইক্রোপ্লাস্টিক চলে যাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বৈশ্বিক অবস্থান ৩১তম।
এই গবেষণা এবং মাইক্রোপ্লাস্টিকের ঝুঁকি নিয়ে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ফিরোজ খান প্রথম আলোকে বলেন, দেখা গেছে, ভারতের উজানের এলাকা থেকে বাংলাদেশের ভাটির দিকে মাইক্রোপ্লাস্টিকের আকার আরও ছোট হয়ে আসছে। এর ফলে সামুদ্রিক খাদ্যে এর উপস্থিতির ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। তবে মাইক্রোপ্লাস্টিক প্রক্রিয়াজাত করার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেই।