চট্টগ্রামের পটিয়ার নান্দনিক স্থাপত্যশৈলীর সেই বাড়ি
চট্টগ্রামের পটিয়ার নান্দনিক স্থাপত্যশৈলীর সেই বাড়ি

মায়ের স্বপ্ন ও একটি বাড়ি

মায়ের স্বপ্ন ছিল গ্রামে আমার পিতৃপুরুষের ভিটায় একটি সুন্দর বাড়ি বানাবেন। সেই ইচ্ছা পূরণ করতে পেরেছেন ছেলে। তবে মায়ের মৃত্যুর পর। আর সেই বাড়িই বিশ্বাঙ্গন থেকে বাংলাদেশের জন্য নিয়ে এল আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। চট্টগ্রাম শহর থেকে ২৭ কিলোমিটার দূরে পটিয়ার নিভৃত গ্রাম আলমদারপাড়ায় নান্দনিক স্থাপত্যশৈলীর বাড়িটির নাম ‘অনুক্রম’। বাড়ির স্থাপত্যশৈলী পেয়েছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। 

শহর থেকে দূরে নির্জন পল্লিতে একটি বাড়ির এই গৌরব অর্জনের পেছনে রয়েছেন একজন মা ও তাঁর ছেলে। মা ইসলাম খাতুন; ছেলে একটি বহুজাতিক কোম্পানির প্রধান নির্বাহী (সিইও) ইকবাল চৌধুরী। ইকবালের বাবা ব্যবসায়ী ইব্রাহিম চৌধুরী ১৯৫২ সালে বিয়ের পর পরিবার নিয়ে ঢাকায় চলে যান। ব্যস্ত ঢাকার কোলাহলে গিয়েও গৃহিণী ইসলাম খাতুন আলমদারপাড়াকে ভুলতে পারেননি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর তাঁরা ঢাকা থেকে আবার চট্টগ্রাম শহরে চলে আসেন। তখন প্রায় প্রতি সপ্তাহে গ্রামে যাওয়ার সুযোগ হতো। কিন্তু পরে পুরোনো বাড়িটি থাকার অনুপযোগী হয়ে পড়ে। মায়ের কাছে সব সময় গ্রামের গল্প শুনতেন ইকবাল। মা স্বপ্ন দেখতেন, মনের মতো একটি বাড়ি হবে গ্রামে। জীবনের শেষ দিনগুলো কাটাবেন সবুজের সৌন্দর্যের ভেতরে। কিন্তু সেই স্বপ্ন মায়ের জীবন থাকতে আর পূরণ হলো না। ২০০৯ সালে একদিন গ্রামের বাড়িতে গিয়ে স্ট্রোক করে তিনি চিরতরে হারিয়ে গেলেন। 

একটা স্বপ্ন নিয়ে মা চলে গেলেন, এ রকম একটা বোধ ইকবালকে যন্ত্রণা দিতে লাগল। এই গ্লানিবোধ তাঁকে তাড়িত করতে লাগল। তিনি গেলেন স্থপতি বন্ধু আসিফ মোহাম্মদ আহসানুল হকের কাছে। বাল্যবন্ধুকে খুলে বললেন নিজের মায়ের স্বপ্নের কথা। স্থপতি আসিফ বন্ধুর আবেগকে ধরতে পারলেন। তিনি বুঝতে পারলেন, এই বাড়ির মূল বিষয় হবেন তাঁর মা। যে জমিনের এক পাশে মা চিরনিদ্রায় শুয়ে আছেন, সেই জমির আয়তন দেড় বিঘা। এরপর মায়ের জন্য ছেলের আবেগ ও স্মৃতি মিলিয়ে তিনি এমন একটি নকশা তৈরি করলেন, যেখানে মায়ের স্মৃতি প্রতিদিনের আলো–হাওয়ার মতো ছুঁয়ে থাকবে বাড়ির আনাচকানাচে। ২০১৯ সালে বাড়িটির নির্মাণকাজ শুরু হয়; শেষ হয় ২০২১ সালে। বাড়িটির নাম দেওয়া হলো ‘অনুক্রম’। 

সম্প্রতি আলমদারপাড়ায় গিয়ে দেখতে পেলাম, সবুজের বেষ্টনীতে ঘেরা সেই স্থাপত্যশৈলী। দেড় বিঘা জমি থেকে বাড়ি করার জন্য বেছে নেওয়া হলো ২ হাজার ৬০০ বর্গফুট এলাকা। দক্ষিণমুখী বাড়িটির দুই পাশে দুটি উঠান। বাড়িটির অবস্থান দেওয়া হয়েছে এমনভাবে— সূর্যের আলো সরাসরি এসে না পড়ে; কিন্তু আলোকিত থাকে সারা দিন। দক্ষিণ থেকে উত্তরে প্রবাহিত বাতাস বাড়িটিকে ছুঁয়ে যায়। দিনে কোনো কক্ষে আলো জ্বালাতে হয় না। গরমের দিনে বাড়িটি ঠান্ডা থাকে আর শীতের দিনে থাকে উষ্ণ। বাড়িতে ঢুকতেই প্রথমে চোখে পড়ে কাছারিঘর। একটু সামনে এগোলেই টানা সিঁড়ি দোতলায় উঠে গেছে। নিচের তলায় খোলা রসুইঘর, বৈঠকখানা আর খাওয়ার টেবিল। সিঁড়ি আর করিডরে ছাদ থেকে আসা কোমল আলো খেলা করে। ওপরে রয়েছে দুটি বেডরুম, ফ্যামিলি লিভিং এবং একটি টেরেস। সঙ্গে রয়েছে একটি নামাজের জায়গা, যা দক্ষিণ দিকে মায়ের কবরের দিকে প্রসারিত। প্রতিবার নামাজ শেষে সালাম ফেরালে দেখা যায় ইসলাম খাতুনের কবর। বাড়ির ভেতরের সবুজ প্রাঙ্গণে রয়েছে কিছু বাছাই করা গাছ ও একটি সরু বাঁশের ঝাড়—এমন নকশার নান্দনিক বাড়ি চট্টগ্রামে আর দ্বিতীয়টি নেই।

নিবিড় প্রকৃতির ভেতরে বাড়িটিকে দেখলে মনে হয় একটি নিপুণ শিল্পকর্ম। হয়তো এ জন্যই এটি পেয়েছে আন্তর্জাতিক সম্মাননা ‘ষষ্ঠ বাকু আন্তর্জাতিক আর্কিটেকচার অ্যাওয়ার্ড ২০২৩’। এই প্রতিযোগিতায় বিভিন্ন দেশের দুই শতাধিক প্রকল্পের মধ্য থেকে ‘অনুক্রম’ আবাসিক ভবন ক্যাটাগরিতে প্রথম স্থান অর্জন করেছে। বাড়িটির স্থপতি আসিফ মোহাম্মদ আহসানুল হক ২০১৩ সালে সিঙ্গেল ফ্যামিলি রেসিডেন্স ক্যাটাগরিতে বার্জার অ্যাওয়ার্ড ফর এক্সিলেন্স ইন আর্কিটেকচার পুরস্কার পান। ২০১৭ সালে মাল্টি ফ্যামিলি রেসিডেন্স ক্যাটাগরিতে বার্জার অ্যাওয়ার্ড ফর এক্সিলেন্স ইন আর্কিটেকচার পুরস্কারসহ জাপান ও ভারত থেকে আন্তর্জাতিক পুরস্কারের ভূষিত হন। আসিফ বলেন, ‘এই বাড়ি নির্মাণের পেছনে একটি আবেগ আছে। সেটি তুলে ধরতে চেয়েছি বাড়ির নকশায়। বাড়িটিতে যাতে প্রকৃতি-সান্নিধ্য থাকে, সে চেষ্টাও ছিল।’ 

বাড়ির মালিক ইকবাল চৌধুরী বলেন, ‘আগে বাড়িতে এলে থাকতে পারতাম না। আমার মায়ের মৃত্যুর দিনেও তাঁকে দাফন শেষে আমাদের চলে যেতে হয়েছিল। এখন এই বাড়ির সবখানে মায়ের স্মৃতি জড়িয়ে আছে।’ 

ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন চট্টগ্রামের সাবেক চেয়ারম্যান দেলোয়ার মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ষষ্ঠ বাকু আন্তর্জাতিক আর্কিটেকচার অ্যাওয়ার্ড স্থপতিদের জন্য অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার। স্থপতি আসিফ মোহাম্মদ আহসানুল হক দেশের জন্য সম্মান বয়ে এনেছেন।