৫ জুন রাত সাড়ে ১০টা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে হঠাৎ হইচই। জনা পঞ্চাশেক শিক্ষার্থী কোটা বাতিলের দাবিতে দাঁড়িয়ে যান ক্যাম্পাসের গোলচত্বরে। আলো-আঁধারি ক্যাম্পাসে নীরবতা ভেঙে শিক্ষার্থীরা স্লোগান দিতে থাকেন। সেই শুরু। এরপর শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগ পর্যন্ত মাঠে ছিলেন চট্টগ্রামের শিক্ষার্থীরা। বিক্ষোভের রেশ ক্যাম্পাস থেকে পৌঁছে গিয়েছিল শহরেও। ঐক্যবদ্ধভাবে শিক্ষার্থীরা প্রতিরোধ করেছিলেন।
৭ জুন ক্যাম্পাসের শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীবৃন্দ’ ব্যানারে মানববন্ধনে দাঁড়ান বিভিন্ন বিভাগের কয়েক শ শিক্ষার্থী। সেদিন শিক্ষার্থীরা কোটাপদ্ধতি পুরোপুরি বাতিল চেয়ে বক্তব্য দেন। স্লোগানে স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে সবুজ ক্যাম্পাস। তাঁদের হাতে ‘কোটাপ্রথা বাতিল করো/ মেধার মূল্যায়ন করো’, ‘আমার সোনার বাংলায়/ বৈষম্যের ঠাঁই নাই’ লেখাসংবলিত প্ল্যাকার্ড ছিল। এরপর ৯ ও ১১ জুন একই জায়গায় বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। একই দাবিতে তাঁরা উচ্চারণ করেন ‘ঐক্য-বাণী’। পাশাপাশি দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত বিক্ষোভ চালিয়ে যাওয়ার শপথ নেন। সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরাও ধাপে ধাপে যুক্ত হতে থাকেন।
আন্দোলনের দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু হয় ২ জুলাই। এবার ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের’ ব্যানারে শিক্ষার্থীরা মাঠে নামেন। তাঁরা শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করে আসছিলেন। সেই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে হামলা চালায় ছাত্রলীগ। ১৪ জুলাই প্রথমবারের মতো শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগের মারধরের মুখোমুখি হন। সেদিন রাত সাড়ে ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কাটা পাহাড়ে বিক্ষোভ করছিলেন শিক্ষার্থীরা। ছাত্রলীগের চার-পাঁচজন নেতা-কর্মী আচমকা সেখানে পৌঁছে বিশৃঙ্খলা শুরু করেন। বিক্ষোভকারীদের মাঝেই কয়েকটি বাজি ফোটান। ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েন শিক্ষার্থীরা। অন্তত চারজনকে সেদিন মারধর করা হয়েছিল। হামলার সেই শুরু। এরপর ৪ আগস্ট পর্যন্ত এক পক্ষের হামলা আর অন্য পক্ষের প্রতিরোধ চলতে থাকে।
সেদিন বেলা আড়াইটার দিকে চট্টগ্রামে কোটা আন্দোলনের সমন্বয়কারী খান তালাত মাহমুদকে ধরে নিয়ে মারধর করা হয়। মুহূর্তেই ঘটনাটি জানাজানি হয়ে যায়। প্রতিবাদে মিছিল বের করেন শিক্ষার্থীরা। মিছিল চলছিল। স্লোগানে স্লোগানে ঝরছিল ক্ষোভ। এরই মধ্যে দলবল বেঁধে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের এলোপাতাড়ি আঘাতে ঘটনাস্থলেই কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের এক শিক্ষার্থীর মাথা ফেটে যায়। সেদিনকার ওই ঘটনার ছবি প্রকাশিত হয় প্রথম আলোর অনলাইনে। এই হামলার ঘটনার পরই ঘুরে দাঁড়ান শিক্ষার্থীরা। তাঁরা প্রতিরোধের ডাক দেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আরও বড় পরিসরে যোগ দেন বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
এদিন পূর্বঘোষণা অনুযায়ী, নগরের ষোলশহর স্টেশনে বিক্ষোভ কর্মসূচি করার কথা ছিল কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের। বেলা সাড়ে তিনটায় কর্মসূচি শুরু হওয়ার আগেই বাধে বিপত্তি। স্টেশনে আগেই অবস্থান নেন যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। লাঠিসোঁটা, রামদা ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে তাঁরা শিক্ষার্থীদের আগমনের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন।
ওই ঘটনা অনুসরণ করতে আমি সেদিন বেলা তিনটার কিছু আগেই ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়েছিলাম। ওই দিনের পরিস্থিতি ছিল অনেকটাই থমথমে। গন্ডগোলের আঁচ পড়েছিল শহরজুড়ে। স্টেশনের সামনে সিডিএ অ্যাভিনিউ সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। দেখলাম, বেলা তিনটায় শিক্ষার্থীরা খণ্ড খণ্ড জমায়েতে স্টেশনের দিকে আসতে শুরু করেছেন। তাঁদের দেখেই তেড়ে যান তৎকালীন সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। শুরু হয় হামলা। চলে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও পাথর নিক্ষেপ। খুব কাছ থেকেই দেখলাম, তিন অস্ত্রধারী শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গুলি ছুড়ছিল। আমাদের আলোকচিত্রী সে দৃশ্য বন্দী করেছিলেন ক্যামেরায়।
সংঘর্ষ সেদিন বিস্তৃতভাবেই ছড়িয়ে পড়েছিল। ষোলশহরের ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে শুলকবহর, মুরাদপুর, মির্জারপুলসহ বিভিন্ন সড়কে। বিক্ষোভকারীরা সবাই মুরাদপুর মোড়ে গিয়ে জড়ো হন। আর তাঁদের চারপাশ থেকে ঘিরে রাখে ছাত্রলীগ-যুবলীগ। একপর্যায়ে হামলায় শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ দিগ্বিদিক ছুটে গিয়ে বিভিন্ন অলিগলিতে আশ্রয় নেন। সেখান থেকে খুঁজে বের করে মারধর করা হয়। বিপরীতে ছাত্রলীগের কয়েকজনকেও প্রতিহত করা হয়।
সেদিন বিকেলে মুরাদপুর মোড় কার্যত রণক্ষেত্র হয়ে গিয়েছিল। মুহুর্মুহু ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও গুলি ছুড়ে প্রতিবাদী শিক্ষার্থীদের দমিয়ে রাখা যায়নি। এক বিকেলেই ঝরে গিয়েছিল তিন প্রাণ। তাঁরা হলেন মো. ফারুক (৩২), মো. ওয়াসিম আকরাম (২২) ও ফয়সাল আহমেদ (২০)। ফারুক ছিলেন আসবাব দোকানের কর্মচারী। ওয়াসিম চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র ও কলেজ শাখা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক। ফয়সাল ওমর গণি এমইএস কলেজের স্নাতকের শিক্ষার্থী। তিনি কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী। আহত হয়েছিলেন অর্ধশতাধিক। আহত ব্যক্তিদের তালিকায় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের নামও ছিল।
আগের দিনগুলোয় শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা, মারধর ও হয়রানির কারণে আন্দোলন চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়। এর মধ্যে ১৮ জুলাই ছিল ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ (সর্বাত্মক অবরোধ) কর্মসূচি। সেদিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত থেমে থেমে বিভিন্ন এলাকায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ ও যুবলীগ-ছাত্রলীগের সংঘর্ষ হয়েছিল। সংঘর্ষ চলাকালে পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল, রাবার বুলেট ও সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ে। দিনভর সংঘর্ষে অন্তত ৪০ জন আহত হয়েছিলেন। মৃত্যু হয়েছিল দুজনের।
সেদিন সকাল থেকে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ ছিল শহরজুড়ে। সড়কে যানবাহন ছিল কম। অনেক এলাকায় দোকানপাট ও বিপণিবিতানও বন্ধ ছিল। স্কুল-কলেজ বন্ধ ছিল। এসব কারণে সড়কে মানুষের উপস্থিতি ছিল তুলনামূলক কম। আতঙ্ক ভর করেছিল সবার মনে। অবশ্য সেদিন বড় জমায়েত হয়েছিল বহদ্দারহাট মোড়ে। দুপুর ১২টা থেকে শিক্ষার্থীরা বহদ্দারহাট মোড়ে জড়ো হতে থাকেন। এ সময় তাঁরা কোটা সংস্কার করা ও আন্দোলনে হামলার প্রতিবাদে নানা স্লোগান দিতে থাকেন। ‘বউত দিন হাইয়ু/ আর ন হাইয়ু (অনেক দিন খেয়েছ, আর খেয়ো না)’ স্লোগানটি ছড়িয়ে পড়ে সবার মুখে মুখে। বিগত সরকারের সমালোচনা করে ওই স্লোগান উচ্চারণ করেছিলেন শিক্ষার্থীরা।
আমরা দেখলাম, একটা সময়ে গিয়ে আন্দোলনটি আর শিক্ষার্থীদের মধ্যে থাকল না। যোগ দিল নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। চট্টগ্রামে ৩ ও ৪ আগস্টের বিক্ষোভ সমাবেশ যেন ‘ছাত্র-জনতার’ সেই ঐক্যের সাক্ষ্য দেয়। মূলত গুলিতে নিহত ব্যক্তিদের হত্যার বিচার এবং সরকারের পদত্যাগের দাবি নিয়ে হাজির হয় ছাত্র-জনতা।
৩ আগস্ট বিকেলে খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে নিউমার্কেট মোড়ে জড়ো হন নানা পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা। স্লোগানে স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে ওই এলাকা। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগ দেন নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। মিছিলে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে হেঁটেছিলেন অভিভাবকেরাও। তাঁদের কারও কারও হাতে ছিল জাতীয় পতাকা। দেখা গেছে, বেলা তিনটায় কর্মসূচি শুরু হওয়ার কথা থাকলেও ওই দিন ১৫ মিনিট আগেই নিউমার্কেট চত্বর মানুষের পদচারণে মুখর হয়ে ওঠে। স্রোতের মতো এসে সবাই জড়ো হন মোড়ে। প্রায় পৌনে তিন ঘণ্টা অবস্থানের পর বিকেল সাড়ে পাঁচটায় বিক্ষোভ মিছিল হয়। মিছিলটি নগরের টাইগারপাস, লালখান বাজার, ওয়াসা মোড়, জিইসি মোড়, ২ নম্বর গেট ও বহদ্দারহাট পর্যন্ত প্রায় আট কিলোমিটার প্রদক্ষিণ করে। মিছিলে হাজারো মানুষ অংশ নেন। পাশাপাশি ৪ আগস্ট বিক্ষোভ সমাবেশের ঘোষণা দেন শিক্ষার্থীরা।
ঘোষণা অনুযায়ী, ৪ আগস্ট সকাল আটটার দিকে সংবাদ সংগ্রহের জন্য আমি নিউমার্কেট মোড়ে পৌঁছাই। তখন মোড়টি সুনসান। গাড়ি চলাচল বন্ধ। দোকানপাটের দরজায়ও তালা ঝুলছিল। পরিস্থিতি বুঝে মোড়ের এক পাশে দাঁড়াই। সকাল নয়টার পরপর হইহই শব্দ। দেখলাম, একদল শিক্ষার্থী মিছিল নিয়ে নিউমার্কেট মোড়ের দিকে ধাবমান। তাঁদের মাথায় শক্ত করে বাঁধা জাতীয় পতাকা। মুখে স্লোগান, ‘আমার ভাই মরল কেন/ জবাব চাই, জবাব চাই’; ‘বুকের ভেতর অনেক ঝড়/ বুক পেতেছি গুলি কর’; ‘আমার খায়, আমার পরে,/ আমার বুকেই গুলি করে’।
পাঁচ মিনিটের মধ্যে তরুণেরা এসে নিউমার্কেট মোড়ে গিয়ে দাঁড়ান। এর পরের দুই ঘণ্টায় মোড়ে আর ঠাঁই নেই দশা হয়েছিল। তবে বেলা ১১টার পরপর শুরু হয় ছাত্রলীগ-যুবলীগ ও পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ, যা চলে প্রায় বেলা ১টা পর্যন্ত। এতে সেদিন আহত হয়েছিলেন অন্তত ১৮০ জন। তবে গুলি, কাঁদানে গ্যাস, রাবার বুলেট—কোনো কিছুতেই আন্দোলনকারীরা ভয় পাননি। তাঁরা অধিকার আদায়ে লড়ে গেছেন।
৫ জুন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের মাধ্যমে তার অন্তিম পরিণতি ঘটে ৫ আগস্ট। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন—সেদিন দুপুরে এ খবর রটে যাওয়ার পর রাস্তায় বেরিয়ে উল্লাস করেন আন্দোলনকারীরা। দলে দলে মিছিল নিয়ে আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতা পৌঁছে যান নিউমার্কেট মোড়ে। সেদিনও চলতে থাকে স্লোগান, হাততালি।