নাজিফা জান্নাত
নাজিফা জান্নাত

পাবলিক-প্রাইভেট ভেদাভেদ ভুলে আমরা এক হতে পারি

আওয়ামী লীগ সরকারের টানা প্রায় ১৬ বছরের শাসনের অবসান হয়েছে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে। যার শুরুটা হয়েছিল সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের আন্দোলনকে ঘিরে। এই আন্দোলনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিল। রাজধানীর রামপুরা এলাকায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি শাখার সমন্বয়ক নাজিফা জান্নাত। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আসিফ হাওলাদার

প্রশ্ন

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিসিএসের মতো সরকারি চাকরির পরীক্ষায় অংশগ্রহণের প্রবণতাটা তুলনামূলক কম বলে মনে করা হয়। তবু আপনারা কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনে ব্যাপকভাবে অংশ নিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে আপনাদের তাগিদটা আসলে কী ছিল?

নাজিফা জান্নাত: এটা একটা সামগ্রিক ব্যাপার ছিল। মনে করা হয় যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিদেশমুখী হন কিংবা বেসরকারি চাকরিতে বেশি আগ্রহী থাকেন। কিন্তু এবারের আন্দোলনে দেশের একটা রিফরমেশনের (সংস্কার) প্রশ্ন ছিল। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে শুধু নিজেদের স্বার্থের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ আন্দোলনেই থাকব, আপামর শিক্ষার্থীদের স্বার্থের পাশে থাকব না—তা ঠিক নয়। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে প্রমাণ হলো, যেকোনো বৈষম্যের বিরুদ্ধে আপামর শিক্ষার্থীদের চাওয়ার জায়গায় পাবলিক-প্রাইভেট ভেদাভেদ ভুলে আমরা এক হতে পারি। আমরা মূলত বৈষম্যের অবসান চেয়েছি। সেই জায়গা থেকেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিপুল সংখ্যায় এবারের আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন।

প্রশ্ন

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সংগঠিত বা উদ্বুদ্ধ হওয়ার প্রক্রিয়াটা কেমন ছিল?

নাজিফা জান্নাত: যখন বিভিন্ন জায়গায় নির্যাতন হচ্ছিল, রক্তাক্ত ছবিগুলো যখন আমাদের সামনে আসছিল, আবু সাঈদকে গুলি করে মেরে ফেলা হলো, তখন আমাদের সংগঠিত না হয়ে আসলে উপায় ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নিজেদের জায়গা থেকে আন্দোলনে নামেন। আমাদের মনে হয়, এটা তো বাংলাদেশের চিত্র হতে পারে না যে পুলিশ এসে শিক্ষার্থীদের গুলি করে মেরে ফেলছে, পেটাচ্ছে! এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই আন্দোলনে নামেন। সময়ের প্রয়োজনে শিক্ষার্থীদের ভেতর থেকেই নেতা বা সমন্বয়কও তৈরি হয়ে গেছে।

মূলত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে শিক্ষার্থীরা কর্মসূচি প্রচার করেন। ইন্টারনেট বন্ধ হওয়ার পর মুঠোফোনের খুদে বার্তার মাধ্যমে আমরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রেখেছি। একটা কমন বার্তা আমরা সবার কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেছি। ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট চালু হওয়ার পর আবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও বিভিন্ন ম্যাসেজিং অ্যাপ ব্যবহার করে আমরা যোগাযোগ স্থাপন করি।

প্রশ্ন

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুজন সমন্বয়ক উপদেষ্টা হলেন। এ ক্ষেত্রে আপনাদের পক্ষ থেকে কোনো পরামর্শ ছিল?

নাজিফা জান্নাত: প্রক্রিয়াটির সঙ্গে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি হিসেবে আমি ছিলাম। কিন্তু ঘটনাগুলো অনেক দ্রুত ঘটেছে। সরকার গঠিত হতে যখন সময় লাগছিল, ক্যু-পাল্টা ক্যুর সম্ভাবনা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি—সব মিলিয়ে আমরা শঙ্কার মধ্যে ছিলাম। ওই সময় আমাদের অগ্রাধিকার ছিল একটা সরকার গঠন। তখন সবার সঙ্গে আলোচনা করে সুসংহতভাবে কোনো সাজেশন (পরামর্শ) দেওয়ার মতো পরিস্থিতি ছিল না।

প্রশ্ন

আন্দোলন শেষ হওয়ার পর এখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ভাবনাটা কী?

নাজিফা জান্নাত: আমরাও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অংশ। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারী সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করেছে। ভবিষ্যতে অন্তর্ভুক্তিমূলক দেশ গঠনের যে প্রক্রিয়া চলছে, অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক মর্যাদার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে আমরা প্রবলভাবে থাকতে চাই। রাষ্ট্রের রূপান্তর প্রক্রিয়া যাতে সবার জন্য মঙ্গলজনক হয় এবং এই প্রক্রিয়ায় যাতে আমাদেরও (বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা) সমান অংশগ্রহণ থাকে, সেই আহ্বান জানাই।

প্রশ্ন

অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আপনাদের প্রত্যাশা কী?

নাজিফা জান্নাত: গত শাসনামলে আমরা যে রকম অপশাসন-দুর্নীতি দেখেছি, যেভাবে মানবাধিকার ক্ষুণ্ন করা হয়েছে, ওই বাংলাদেশে আমরা আর ফেরত যেতে চাই না। আমাদের প্রথম চাওয়া, সামনের বাংলাদেশ হবে ‘বেটার বাংলাদেশ’। একটা অন্তর্ভুক্তিমূলক দেশ চাই। কোনো কট্টরপন্থী শক্তি এসে যাতে গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে তৈরি হওয়া সর্বজনীন চাওয়া এবং স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যাহত করতে না পারে। সবার জন্য যেন শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায়।