সরবরাহ বাড়ানোর আশ্বাসে সরকার ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বাড়তি দাম নিতে চায়। পরিবহন ও আবাসিকে আপাতত না–ও বাড়তে পারে।
সরকার আবারও গ্যাসের দাম বাড়াবে। মূল্যবৃদ্ধির প্রক্রিয়া ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে, প্রজ্ঞাপন জারি হতে পারে চলতি সপ্তাহে।
জ্বালানি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এ দফায় দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে আমদানি বৃদ্ধির বিষয়টি সামনে আনা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, বিদেশ থেকে বাড়তি দাম দিয়ে কিনে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি বাড়ানো হবে। এ জন্য বেশি টাকা লাগবে। ভর্তুকি কমাতে সেই টাকার একটা অংশ ওঠানো হবে গ্যাসের দাম বাড়িয়ে। ব্যবসায়ীরা বাড়তি দাম দিতে রাজি।
যদিও এর আগে দুই দফা সরবরাহ বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি করা হয়েছিল। কিন্তু পরে গ্যাস আমদানি বাড়ানো হয়নি।
এবার আবার একই প্রতিশ্রুতি দিয়ে দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে এমন একটা সময়ে, যখন শিল্প খাত গ্যাস–সংকটে ভুগছে। অনেক এলাকার বাসাবাড়িতেও দিনের বেশির ভাগ সময় চুলা বন্ধ রাখতে হচ্ছে গ্যাসের অভাবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জ্বালানি বিভাগের দায়িত্বশীল দুজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, এ দফায় শিল্প, বিদ্যুৎ ও বাণিজ্যিক খাতের গ্রাহকদের ক্ষেত্রে দাম বাড়ানো হবে। পরিবহন খাত ও আবাসিক গ্রাহকদের ক্ষেত্রে গ্যাসের দাম আপাতত বাড়বে না।
দেশে দিনে এখন গ্যাসের মোট চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। গড়ে সরবরাহ করা হয় ২৬৬ কোটি ঘনফুট। প্রতিদিন ৩১০ কোটি ঘনফুট পর্যন্ত সরবরাহ নিশ্চিত করা গেলে শিল্প খাতের সংকট মোটামুটি কাটবে। গত জুলাই থেকে দেশে গ্যাসের সংকট তীব্র আকার ধারণ করে। তখন চড়া দামের কারণে বৈশ্বিক খোলাবাজার (স্পট মার্কেট) থেকে গ্যাস কেনা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এখনো সরকার খোলাবাজার থেকে গ্যাস কিনছে না। দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় গ্যাস আসছে। মোট সরবরাহ আগের চেয়ে কম।
সরকার গ্যাস আমদানির পথে হেঁটেছিল সংকট দেখিয়ে। ২০১৮ সালের শেষ দিকে এলএনজি আমদানি শুরু হয়। বর্তমানে দিনে ১০০ কোটি ঘনফুট এলএনজি আমদানির অবকাঠামোগত সক্ষমতা আছে। এটি আরও বাড়ানোর পরিকল্পনাও রয়েছে।
২০১৯ সালে দৈনিক ৮৫ কোটি ঘনফুট এলএনজি আমদানির কথা বলে গ্যাসের দাম ৩২ শতাংশের কিছু বেশি বাড়ানো হয়। কিন্তু পরে সরকার আমদানি ততটা করেনি। এ কারণে বাড়তি আদায় করা ৯ হাজার কোটি টাকা গ্রাহকদের ফেরত দিতে পেট্রোবাংলাকে নির্দেশ দেয় জ্বালানি খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। তবে পেট্রোবাংলা সেই টাকা ফেরত দেয়নি।
২০২২ সালে আবারও দিনে ৮৫ কোটি ঘনফুট এলএনজি আমদানির কথা বলে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেয় পেট্রোবাংলা। বিইআরসি গত জুনে ওই প্রস্তাবের ভিত্তিতে গ্যাসের দাম প্রায় ২৩ শতাংশ বাড়িয়ে দেয়। তখন আমদানি ধরা হয়েছিল দিনে ৬৮ কোটি ঘনফুট। কিন্তু সরকার পরের মাস জুলাইয়ে খোলাবাজার থেকে এলএনজি কেনা বন্ধ করে দেয়। এতে এলএনজি সরবরাহ কমে যায়। সেটা একসময় দৈনিক ৩৮ কোটি ঘনফুটে নেমে যায়। এখন দিনে এলএনজি সরবরাহ করা হচ্ছে গড়ে ৪২ কোটি ঘনফুট।
গ্যাসের অভাবে বিপাকে পড়া ব্যবসায়ীদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেছে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। ব্যবসায়ীদের আবার বলা হয়, গ্যাসের বাড়তি দাম দিলে আমদানি করা যাবে। ব্যবসায়ীরা এ প্রস্তাবে রাজি হয়েছেন। কারণ, জাতীয় গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ নিলে তাদের প্রতি ইউনিটে খরচ পড়ে ৯ টাকার বেশি। আর গ্যাস থেকে কারখানার ক্যাপটিভ বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন করলে ব্যয় দাঁড়ায় ৪ টাকার কম। এ অবস্থায় বাড়তি দামে গ্যাস পাওয়া তাদের জন্য মন্দের ভালো।
ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহ করা গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির দাবি করা হয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রে কম দামে গ্যাস দিয়ে ভর্তুকির দায় অন্যদের ওপর চাপানোর বিপক্ষে তাঁরা।
গ্যাসের বড় গ্রাহক বস্ত্র কারখানার মালিকেরা। বস্ত্রশিল্পমালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, আগেও এলএনজি আমদানি বাড়ানোর কথা বলে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছিল, কিন্তু আমদানি বাড়েনি। নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করলে বাড়তি দাম দিতে রাজি আছে শিল্প খাত। তিনি বলেন, বিদ্যুৎকেন্দ্রের গ্যাসের দাম বাড়াতে হবে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকেরা হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হবেন, আর শিল্প খাত ধ্বংস হয়ে যাবে, এটা হতে পারে না।
গ্যাসের দাম কতটা বাড়বে, তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। তবে জ্বালানি মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, খাতভেদে বাড়ানোর হার ৫০ থেকে ১০০ শতাংশ হতে পারে।
শিল্পে ব্যবহৃত প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ২৫ টাকা পর্যন্ত দিতে রাজি শিল্পমালিকেরা। এখন কারখানার নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্রের (ক্যাপটিভ) জন্য ইউনিটপ্রতি গ্যাসের দাম ১৬ টাকা। এটা ২৫ টাকা করা হলে মূল্যবৃদ্ধির হার দাঁড়ায় ৫৬ শতাংশ। বৃহৎ শিল্পে প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম এখন ১১ টাকা ৯৮ পয়সা। এটি বাড়িয়ে দ্বিগুণের কাছাকাছি করা হতে পারে। বাণিজ্যিক খাতেও বাড়ানো হবে গ্যাসের দাম।
তৈরি পোশাক খাতের ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম প্রথম আলোকে বলেন, সংকটকালে বাড়তি দাম দিতে রাজি শিল্পমালিকেরা। তবে অবশ্যই গ্যাসের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। বিশ্ববাজারে কমলে দাম আবার সমন্বয় করতে হবে।
সরকারি-বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রতি ইউনিট গ্যাসের বর্তমান দাম ৫ টাকা ২ পয়সা। সেটা দ্বিগুণ করার চিন্তা আছে সরকারের। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। ফলে বিদ্যুতের দামও বাড়ানোর প্রয়োজন হতে পারে। এর আগে গত নভেম্বরে পাইকারিতে বিদ্যুতের দাম প্রায় ২০ শতাংশ বাড়ানো হয়। ১২ জানুয়ারি নির্বাহী আদেশে খুচরায় বিদ্যুতের দাম ৫ শতাংশ বাড়িয়েছে সরকার।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, পাইকারিতে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পরও লোকসান দিচ্ছে পিডিবি। সরকার এ বছর বিদ্যুৎ খাতে ১৭ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি বরাদ্দ রেখেছে। বর্তমান দামে কয়লা, তেলসহ জ্বালানি কিনতে হলে ঘাটতি দাঁড়াতে পারে ৪০ হাজার কোটি টাকা। নতুন করে গ্যাসের দাম বাড়লে ঘাটতি আরও বেড়ে যাবে। তাই আবার বাড়তে পারে বিদ্যুতের দাম।
এদিকে টাকার অভাবে গ্যাসের আমদানি বিল মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশন—পেট্রোবাংলা। ডলার–সংকটে গত জুলাই থেকে খোলাবাজারের এলএনজি কেনা বন্ধ। নতুন করে কেনার সিদ্ধান্ত হয়নি এখনো। দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকেও উৎপাদন কমে গেছে।
পেট্রোবাংলার দুজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, এলএনজি আমদানি বাড়ানোর বিষয়ে চাপ আছে। কিন্তু টাকার অভাবে আমদানি করা যাচ্ছে না। জানুয়ারি মাসে এখন পর্যন্ত যে পরিমাণ বিল জমা হয়েছে, তার অর্ধেক পরিশোধের মতো টাকা আছে পেট্রোবাংলার ব্যাংক হিসাবে। এর বাইরে নতুন করে ১০টি এলএনজি কার্গো আমদানি করতে হলে ২৫ হাজার কোটি টাকা লাগবে। টাকা না পেলে আমদানি করার সুযোগ নেই।
বিইআরসি সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সাল থেকে গ্যাসের দাম পাঁচ দফায় বাড়ানো হয়েছে ১৭৪ শতাংশের বেশি। পরিবহন খাতের সিএনজির দাম বেড়েছে ছয় দফা।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে নজর না দিয়ে সরকার আমদানিতে গেছে। এর মাশুল এখন দিতে হচ্ছে।
গ্যাস খাতের অনিয়ম ও অপচয় কমিয়ে এবং সরকারি ভর্তুকি সমন্বয় করে দাম না বাড়ানোর দাবি জানিয়ে আসছে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। সংগঠনটির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি এম শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, শিল্পসহ সব গ্রাহক গ্যাসের খরায় ভুগছে। এর মধ্যে নতুন করে দাম বাড়ানোর কোনো নৈতিক অবস্থান নেই সরকারের। এটা গ্রাহকের কাছ থেকে লুণ্ঠনের শামিল, চরমতম প্রতারণা।