প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা নিয়ে ‘লুকোচুরি’

সরকারি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ও বাক্‌–শ্রবণপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয়
ছবি: প্রণব বল

জন্ম থেকেই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী আরিফ হোসেন। চট্টগ্রাম নগরের মুরাদপুরের সরকারি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ত সে। থাকত ছাত্রাবাসেই। তিন মাস আগে তার চোখ ওঠা রোগ হলে বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আরিফের ভাই সাদ্দাম হোসেন বলেন, সুস্থ হওয়ার পর বারবার যোগযোগ করা হলেও তাকে আর বিদ্যালয়ে যেতে দেওয়া হয়নি।

একই বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণিতে পড়ত নাঈমা আকতার। পবিত্র রোজার ঈদের পর তাকে মিরসরাইয়ের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এর কারণ হিসেবে বলা হয়, মেয়েরা–মেয়েরা ঝগড়া করেছে। নাঈমার মা তহুরা আকতার বলেন, বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা বলেছে, আর নেওয়া হবে না।

একই ভবনে সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীন পরিচালিত বাক্‌ ও শ্রবণপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ের বিরুদ্ধেও রয়েছে একই ধরনের অভিযোগ। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের সংখ্যা নিয়েও একেক সময় একেক তথ্য দিচ্ছে। কর্তৃপক্ষ কখনো বলছে শিক্ষার্থী ৭৮, আবার কখনো বলছে ৮৮ জন। সঠিক সংখ্যার তালিকা চাইলে তা–ও দিতে অনীহা প্রকাশ করছে তারা।

অভিযোগ রয়েছে, মাথাপিছু ভাতা ভাগ–বাঁটোয়ারা করার জন্য শিক্ষার্থীশূন্য করা হচ্ছে বিদ্যালয়টিকে। শিক্ষার্থীর সংখ্যা নিয়েও লুকোচুরি চলছে। গত বছর ৬২ জন আবাসিক শিক্ষার্থী দেখিয়ে ভাতা নেওয়া হয়। কিন্তু তখন শিক্ষার্থী ছিল ৪৭ জন। প্রতিজন আবাসিক শিক্ষার্থীর জন্য মাসে ভাতা পাওয়া যায় ৩ হাজার ৫০০ টাকা। সে হিসাবে কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকা হাওয়া হয়ে গেছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, নগরের মুরাদপুরে একই ভবনে অবস্থিত বিদ্যালয় দুটিতে আদতে মোট শিক্ষার্থী ৪০ জন। এর মধ্যে আবাসিক শিক্ষার্থী রয়েছে সব মিলিয়ে ২৬ জন। কিন্তু আবাসিক কখনো দেখানো হয় ৫৮ জন, আবার কখনো ৪২ জন।

সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীন পরিচালিত বিদ্যালয় দুটিতে এখন কোনো প্রধান শিক্ষক নেই। সমাজসেবা অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম জেলার সহকারী পরিচালক কামরুল পাশা ভূঁইয়া তত্ত্বাবধায়ক ও প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁর অনুমতি ছাড়া বিদ্যালয়ে কেউ ঢুকতে পারে না। সারাক্ষণ ভেতর থেকে বিদ্যালয়টির ফটক লাগানো থাকে।

গত বৃহস্পতিবার সরেজমিন দেখা যায়, ১৬ জন বাক্‌–শ্রবণ ও ১০ জন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী পরীক্ষা দিচ্ছে। এর মধ্যে আবাসিক শিক্ষার্থী ১৪ জন। পরীক্ষার্থীর বাইরে আরও ১২ জন আবাসিক শিক্ষার্থীকে ছাত্রাবাসে পাওয়া যায়। সব মিলিয়ে সেদিন আবাসিক শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ২৬।

কামরুল পাশা বলেন, ‘মোট আবাসিক শিক্ষার্থী আছে ৪২ জন। আজ ৩১ জনের রান্না হচ্ছে। এ ছাড়া আবাসিক-অনাবাসিক মিলে আমাদের শিক্ষার্থী ৮৮ জন। সবাইকে সব সময় পাওয়া যায় না।’  

কিন্তু আবাসিক ও অনাবাসিক শিক্ষার্থীর তালিকা চাইলে কামরুল পাশা তা দিতে পারেননি। এমনকি হাজিরা খাতা দেখাতেও রাজি হননি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। বিদ্যালয় দুটিতে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদানের অনুমতি আছে। তবে দশম শ্রেণি পর্যন্ত আবাসিক সুবিধা পেয়ে আসছে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা।

এর আগে গত ২ নভেম্বর বিদ্যালয়ে গেলে দেখা যায়, ১০ জন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী বারান্দায় ক্লাস করছে। ওই দিন বাক্‌প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী ছিল ২৫ জন। সেদিন কামরুল পাশা বলেছিলেন, বিদ্যালয়ে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ও বাক–শ্রবণপ্রতিবন্ধী মিলে শিক্ষার্থী সংখ্যা ৭৮। এর মধ্যে আবাসিক শিক্ষার্থী ৪৬ জন। বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ থেকে ঘুরে আসার এক ঘণ্টা পর তত্ত্বাবধায়ক নিজ থেকে ফোন করে প্রতিবেদককে বলেন, ৫৮ আবাসিকসহ মোট শিক্ষার্থী হবে ৮৮ জন।

তারও আগে গত ১৩ অক্টোবর বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, ৬ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীকে পড়াচ্ছেন এক শিক্ষক। ওই সময় তত্ত্বাবধায়ক দাবি করেছিলেন ৩৬ জন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী সেখানে রয়েছে। এ ছাড়া বাক্‌-শ্রবণপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫৭।

শিক্ষার্থীদের বের করে দেওয়ার অভিযোগ    

আরিফ ও নাঈমার মতো একইভাবে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির খায়রুল ইসলাম, মো. মিনহাজ ও মারুফুর রহমান, পঞ্চম শ্রেণির সাহেদুল ইসলাম, নবম শ্রেণির এস এম সিয়ামসহ ১০ শিক্ষার্থীকে বছরের মাঝপথে নানা অজুহাতে বের করে দেওয়া হয়েছে বলে অভিভাবকেরা অভিযোগ করেছেন। পঞ্চম শ্রেণির দুর্জয় ধর ও রায়হান, সপ্তম শ্রেণির বিপ্লব দাশ, চতুর্থ শ্রেণির রায়হানের পরিবারও অভিযোগ করেছে, তাদের স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। মাসখানেক আগে পরিচালককে অনুরোধ করে তারা বিদ্যালয়ে আবারও ফিরে আসে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক অভিভাবক বলেন, স্কুল দুটিতে ভবন নেই, শিক্ষক নেই। সেদিকে কারও মনোযোগ নেই। শুধু শিক্ষার্থীদের বের করে দেওয়া হচ্ছে। এ ব্যাপারে স্কুল পরিচালনা কমিটির সভাপতি চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসককে লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়েছিল।

কামরুল পাশা এ প্রসঙ্গে বলেন, কিছু শিক্ষার্থী দুষ্টুমি করেছে। তারা নিয়মকানুন মানতে চায় না। তাই বের করে দেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সমাজসেবা অধিদপ্তরের বিভাগীয় পরিচালক কাজী নাজিমুল ইসলাম বলেন, ‘বের করে দেওয়ার অভিযোগ আমিও পেয়েছিলাম। তখন আমি কয়েকজনকে ঢোকানোর উদ্যোগ নিয়েছিলাম। কিন্তু বেঁধে দেওয়া সময়ে তারা আসতে পারেনি। আবার অনেক সময় আবাসিক শিক্ষার্থী ছুটিতে বাড়ি যায়। তখন সংখ্যা কমে যায়। এখন যদি পঞ্চম শ্রেণির ওপরের শিক্ষার্থীদের ছাত্রাবাসে থাকতে না দেওয়া হয়, সেটা আমাকে বলুক। আমি ব্যবস্থা নেব।’