মহা আনন্দ, প্রথম স্কুলে যাওয়ার। কিন্তু স্কুলে গিয়েই সব আনন্দ মাটি।
প্রথম শ্রেণির কক্ষের একটা আলাদা বেঞ্চে সঞ্জীবনী সুধাকে বসিয়ে দেওয়া হয়। কড়া করে বলে দেওয়া হয়, ছেলে বা মেয়ে কারও সঙ্গেই বসা চলবে না।
সঞ্জীবনীর ছোট মনে বড় আঘাতটা সেদিনই লাগে। সেদিনের কথা সঞ্জীবনীর মন থেকে কখনো মুছে যায়নি। সেই দুঃখ-গ্লানি সঞ্জীবনীকে আরও অনড়, আর জেদি করে তোলে। এই জেদই তাঁকে নিয়ে এসেছে বহু দূর।
হরদম তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য, লাঞ্ছনা-গঞ্জনা, অপমান-ভ্রুকুটি, হাজারো প্রতিবন্ধকতা—কোনো কিছুকে তোয়াক্কা করেননি সঞ্জীবনী। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ সাফল্যের সঙ্গে শেষ করেন তিনি। পরে প্রবেশ করেন চাকরিজীবনে।
সম্প্রতি সঞ্জীবনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমফিলে ভর্তির আবেদন করেন। এমফিলে ভর্তির সব শর্ত তিনি পূরণ করেছেন। এখন তাঁর এমফিলে ভর্তির বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। সঞ্জীবনী প্রথম ট্রান্সজেন্ডার নারী, যিনি দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে এমফিল করতে যাচ্ছেন।
সঞ্জীবনী বলেন, ‘তথাকথিত এই সমাজ ছোটবেলা থেকে আমাকে পদে পদে বুঝিয়ে দিয়েছে, আমি আর দশজন মানুষের মতো নই। আমার স্বাভাবিকভাবে বাঁচার অধিকার নেই। সম্মান পাওয়ার অধিকার নেই। শিক্ষার অধিকার নেই। এই কঠিন প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে নিরন্তর লড়াই করতে করতে আজ আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমফিল করার যোগ্যতা অর্জন করেছি। এটা আমার গর্ব, আমার সম্প্রদায়ের গর্ব, পুরো দেশের গর্ব। আমার মধ্য দিয়ে উচ্চতর গবেষণায় ডিগ্রি অর্জনের ক্ষেত্রে একটা দ্বার উন্মোচিত হতে যাচ্ছে। আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, শিক্ষায় কোনো জাতপাত-লিঙ্গগত বাধা থাকা উচিত নয়।’
সঞ্জীবনীর (২৯) বাড়ি টাঙ্গাইলের ধনবাড়ীতে। বাবা, মা ও ছোট এক বোন আছে তাঁর। ছোটবেলা থেকেই সমাজের চরম বিরূপ আচরণের শিকার হয়ে এসেছেন তিনি। তবে পরিবার সব সময় তাঁর পাশে থেকেছে। বিশেষ করে, তাঁর মা তাঁকে সাহস-সমর্থন দিয়েছেন। স্থানীয় স্কুল-কলেজ থেকে ভালো জিপিএ নিয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছেন। পরে জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেন। মেধার ভিত্তিতে তিন বিশ্ববিদ্যালয়েই ভর্তির সুযোগ পান তিনি। শেষ পর্যন্ত তিনি ভর্তি হন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগে।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও সঞ্জীবনীকে লিঙ্গগত নানা বৈষম্য-প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয়। ছেলেদের হলে তাঁর থাকার আসন নির্ধারিত হয়। তাঁকে বলে দেওয়া হয়, ছেলেদের মতো পোশাক পরতে হবে, চুল কাটতে হবে। শ্রেণিকক্ষের পরিবেশও তাঁর জন্য অনুকূলে ছিল না, কিন্তু সঞ্জীবনী দমে যাননি। তিনি তাঁর লক্ষ্যে সব সময়ই অটল ছিলেন। লক্ষ্যটা হলো—যত বাধা-বিঘ্নই আসুক, যত অপ্রীতিকর ঘটনাই ঘটুক, সামনে এগিয়ে যেতে হবে। অনার্স ও মাস্টার্স উভয় পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণি অর্জন করেন তিনি।
নাচের প্রতি সব সময় সঞ্জীবনীর প্রবল আগ্রহ ছিল। ছোটবেলাতেই তিনি নাচ শেখেন। নাচের ওপর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেন। ক্ল্যাসিক্যাল নাচে দক্ষতা অর্জন করেন তিনি। মাস্টার্স শেষ করে ২০১৯ সালে তিনি কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন কর্তৃক পরিচালিত বান্দরবানের লামায় ছিন্নমূল শিশুদের স্কুলে নাচের শিক্ষক হিসেবে কাজ শুরু করেন। দুই বছর এখানে কাজ করেন তিনি।
২০২০ সালের মার্চে দেশে করোনা মহামারি হানা দেয়। ভয়ংকর সেই সময় করোনায় মারা যাওয়া মানুষের দাফন-সৎকারের কাজে স্বেচ্ছায় যুক্ত হন সঞ্জীবনী। তিনি বলেন, ‘অনেক বলে-কয়ে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন কর্তৃপক্ষকে রাজি করাই। কর্তৃপক্ষকে বলি, আমি আজীবন হেয় হয়ে এসেছি। আমি মানুষের সেবায় জীবন উৎসর্গ করতে চাই।’
করোনাকালে চট্টগ্রামে আড়াই মাস এই কাজ করেন সঞ্জীবনী। ২০২০ সালের শেষ দিকে তিনি ঢাকায় এসে একই কাজে যুক্ত হন। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের হয়ে প্রায় এক বছরকালে ১ হাজার ২০০ জনের বেশি মানুষের লাশ দাফন বা সৎকারের কাজ করেছেন তিনি। এই কাজ করতে গিয়ে তিনি নিজে তিনবার করোনায় সংক্রমিত হন। এই সময়ও তিনি নানাভাবে বুলিংয়ের শিকার হন। করোনার প্রকোপ কমে এলে তিনি লামায় পুরোনো কর্মস্থলে ফিরে যান।
লামায় ফিরে পেশা বদলের কথা ভাবতে থাকেন সঞ্জীবনী। তিনি বলেন, ‘আমি খুব করে অনুভব করছিলাম, লিঙ্গগত কারণে আমার পেশাগত অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হতে পারে না। আমি আমার মেধা, শ্রম ও সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর জন্য মনস্থির করে ফেলি।’
সঞ্জীবনী চাকরির জন্য আবেদন করতে থাকেন। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে একটি বেসরকারি ব্যাংকে তাঁর চাকরি হয়। ২০২১ সালের অক্টোবরে তিনি ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ে ‘কমিউনিকেশন অ্যান্ড সিএসআর অফিসার’ হিসেবে যোগ দেন। সেখানে কাজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘ব্যাংকটির কর্মপরিবেশ এককথায় অসাধারণ। আমার জেন্ডার এখানে মুখ্য নয়। কাজেই আমার পরিচয়।’
অনেক আগে থেকেই সঞ্জীবনীর স্বপ্ন, তিনি উচ্চতর ডিগ্রি নেবেন। তিনি বলেন, ‘মানুষের আচরণে নিজেকে মানুষ বলে মনে হতো না। তাই আমি মনে মনে ঠিক করেছিলাম, আমাকে পড়ালেখা দিয়ে এই অবহেলা-অবজ্ঞার জবাব দিতে হবে। পড়াশোনার সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত আমাকে যেতে হবে।’
২০১৯ সাল থেকে এমফিল করার কথা ভাবছিলেন সঞ্জীবনী। এ জন্য তিনি নিজেকে ধীরে ধীরে প্রস্তুত করছিলেন। ২০২১ সালে জোর চেষ্টা শুরু করেন। প্রথমে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে চেষ্টা করেন। কিন্তু সেখানে হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক জোবাইদা নাসরীনের সঙ্গে কিছুটা পরিচয় ছিল সঞ্জীবনীর। একপর্যায়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেন। তাঁকে তিনি জানান, ‘জেন্ডার’ বিষয়ে এমফিল করতে চান। জোবাইদা নাসরীনের পরামর্শে তিনি এমফিলের প্রস্তুতি নেন। সঞ্জীবনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামানের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি উৎসাহ দেন। যেকোনো প্রয়োজনে সহায়তার আশ্বাস দেন।
সঞ্জীবনী জানান, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধীন অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীনের তত্ত্বাবধানে এমফিল করতে যাচ্ছেন। তাঁর এমফিলের প্রস্তাবনার বিষয় ‘রিফ্রেমিং জেন্ডার ইন পলিটিকস অব বাংলাদেশ’। ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে তিনি এমফিল প্রোগ্রামে যুক্ত হবেন।
অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি অত্যন্ত আনন্দিত যে সঞ্জীবনী আমার তত্ত্বাবধানে এমফিল করতে যাচ্ছেন। এটা দেশের জন্য একটা ইতিহাস হতে যাচ্ছে। কারণ, দেশে তিনিই প্রথম ট্রান্সজেন্ডার নারী, যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষায়িত এই উচ্চতর ডিগ্রিতে ভর্তির সব শর্ত পূরণ করেছেন। সে ভর্তির জন্য বিবেচনাধীন। তাঁর ভর্তির বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। আমি মনে করি, এটা যেমন তাঁর ব্যক্তিগত অর্জন, তেমনি তাঁর সম্প্রদায়েরও অর্জন। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও একটা দ্বার উন্মোচন করল।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আখতারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সঞ্জীবনীর সংগ্রাম, সাহসিকতা ও উচ্চতর শিক্ষার জন্য তাঁর অদম্য আগ্রহ আমাকে মুগ্ধ করেছে। নিঃসন্দেহ তিনি মেধাবী। তাঁর মতো মানুষদের চলার পথ মসৃণ করতে সহায়তা দেওয়াটা আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৌলিক মূল্যবোধের অংশ। তাঁর এমফিল শুরু করতে যাওয়াটা হয়তো একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা, তবে তা সমাজের জন্য বড় অগ্রগতি, বড় রূপান্তর। তাঁর অর্জন অন্যদের অনুপ্রেরণা জোগাবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর পাশে আছে। তাঁর মতো অন্যদের পাশেও থাকবে।’
এমফিলের পর পিএইচডি ও পোস্ট ডক্টরেট করতে চান সঞ্জীবনী। তিনি বলেন, ‘আমি আমার সম্প্রদায়ের জন্য সমাজের রুদ্ধ দ্বারগুলো খুলে দিতে সহায়তা করতে চাই। আমি আমার যোগ্যতা দিয়ে এই সমাজকে বলতে চাই, জেন্ডার দিয়ে মানুষকে বিচার করো না। মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখো, তাঁকে তাঁর প্রাপ্য সম্মানটুকু দাও।’