‘সেদিনের ঘটনার প্রতিটি খুঁটিনাটি আমার মনে আছে। সেদিনের কথা ভাবলে এখনো আমার গা শিউরে ওঠে। গা ঘিন ঘিন করে।’ শিক্ষকের দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষার্থী। নিজের অভিজ্ঞতার কথাগুলো বলতে গিয়ে গা শিউরে ওঠে তাঁর। হাত দুটো সামনে এনে প্রতিবেদককে দেখালেন তাঁর লোমগুলো দাঁড়িয়ে আছে।
আজ মঙ্গলবার পুরান ঢাকায় অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়টির ক্যাম্পাসে বসে কথা হয় এই শিক্ষার্থীর সঙ্গে। তাঁর অভিযোগ, ২০১৯ সালে বিভাগের এক শিক্ষকের হাতে যৌন নিপীড়নের শিকার হন। এরপর বিষয়টির বিচার চেয়েও কোনো ফল পাননি। এই শিক্ষার্থীর দাবি, উল্টো তাঁকে দুই শিক্ষক পরীক্ষায় ফেল করিয়ে দিয়েছেন।
সম্প্রতি একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকার আত্মহত্যার ঘটনায় যৌন হয়রানি ও নানা নিপীড়নের বিরুদ্ধে এ শিক্ষার্থী সোচ্চার হন। সেখানেই অবন্তিকার ব্যাপারে কথা বলতে গিয়ে নিজের প্রসঙ্গও টানেন তিনি। নিজের সঙ্গে ঘটে যাওয়া এসব বিষয় নিয়ে গণমাধ্যমে তিনি কথা বলেন। তার পর থেকে আবার তাঁকে হত্যাসহ বহিষ্কারের হুমকি দেওয়া হচ্ছে বলে তিনি দাবি করেন। গতকাল সোমবার তিনি ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখায় (ডিবি) গিয়ে জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে আবেদনও করেন।
ছাত্রীর আনা যৌন নিপীড়নের অভিযোগকে অস্বীকার করে ওই শিক্ষক বলেছেন, ওই ছাত্রীর ‘কাল্পনিক’ অভিযোগের ভিত্তিতে পাঁচ দিন ধরে তিনি মিডিয়া ট্রায়ালের শিকার হচ্ছেন।
আজ বেলা পৌনে ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, প্রবেশদ্বারের কাছে দেয়ালে সাঁটানো যৌন নিপীড়নবিরোধী স্লোগান লেখা বেশ কয়েকটি পোস্টার। পাশাপাশি টানানো রয়েছে অবন্তিকার আত্মহত্যার পেছনে থাকা দোষীদের বিচার দাবি করে ব্যানার। বেলা পৌনে একটার দিকে ক্যাম্পাসে নিপীড়নের বিরুদ্ধে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ব্যানারে ‘রেড অ্যালার্ট’ পোস্টার নিয়ে সমবেত হতে শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। তাঁরা লাল কার্ড প্রদর্শন করেন। ওই ব্যানারের অন্যতম সংগঠক শিক্ষার্থী শাহ সাকিব সোবহান ও সুমাইয়া ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের ভাষ্য, আগের নিপীড়নের অভিযোগগুলোর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটনাগুলো বাড়ছে।
এরই ফাঁকে ক্যাম্পাসে বসে কথা হয় ওই শিক্ষার্থীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ওই শিক্ষক কাজের জন্য কয়েকজনকে নেবেন এমনটি বলেছিলেন। ঘটনার দিন বেলা তিনটায় সাক্ষাৎকার দেওয়ার জন্য তাঁকে নিকেতনের অফিসে ডাকেন। সেখানে গেলে শিক্ষক নিজেই দরজা খুলে একটি কক্ষে তাঁকে বসান। সাক্ষাৎকারের বিষয়ে জানতে চাইলে তাঁকে বলা হয় পরের কাজে তাঁকে নেবেন। একপর্যায়ে শিক্ষক তাঁকে আপত্তিকরভাবে স্পর্শ করেন। তিনি চিৎকার করে উঠলে শিক্ষক তাঁকে ছেড়ে দেন এবং এ ঘটনা কাউকে না বলতে অনুরোধ করেন।
এ শিক্ষার্থী এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘ওই সময়ের মানসিক অবস্থা আপনাকে বোঝাতে পারব না। আমি থরথর করে কাঁপছিলাম।’ তিনি বলেন, ২০২০ সাল থেকে ওই ঘটনার বিচার চেয়ে ঘুরছেন। ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে বিভাগীয় প্রধানকে ঘটনাটি জানান। তিনি ঘটনাটি দেখবেন বলে আশ্বাস দেন। এরপর কোভিড চলে আসায় তিনি বাড়িতে মা–বাবার কাছে চলে যান। ২০২১ সালে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার পর তিনি ক্লাস-পরীক্ষায় অংশ নেন। একটি পরীক্ষায় তিনি ৪০–এ শূন্য পান। তাঁর দাবি, ‘যে ম্যাডাম পরীক্ষায় শূন্য দিয়েছেন, তিনি ওই স্যারের বন্ধু ছিলেন।’ বিচার চাওয়ার কারণে ওই ম্যাডামের একটি ও বিভাগীয় প্রধানের দুটি বিষয়ে তাঁকে ইচ্ছাকৃতভাবে ফেল করানো হয়েছে।
শিক্ষার্থীর অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে বিভাগে গিয়ে চেয়ারম্যানকে পাওয়া যায়নি। পরে ফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওই শিক্ষার্থী ওই বিষয়ের ক্লাসে অনুপস্থিতি ও প্রকল্প আংশিক জমা দেওয়ায় অকৃতকার্য হয়েছেন। বারবার নোটিশ দেওয়ার পরও তিনি প্রকল্প জমা দেননি। আরেক ছেলেও অকৃতকার্য হয়েছে। এটা নিয়ে গণমাধ্যম যেভাবে ইচ্ছেমতো প্রতিবেদন করছে তা দুঃখজনক।’
প্রক্টর অধ্যাপক জাহাঙ্গীর হোসেন তাঁর কার্যালয়ে প্রথম আলোকে বলেন, যৌন নিপীড়নের অভিযোগের বিষয়ে এখনো তদন্ত চলছে। এ নিয়ে এখন মন্তব্য করতে চান না। আর পরীক্ষায় ফেল করার বিষয়ে উপাচার্য সাপ্লিমেন্টারি পরীক্ষা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
আবার পরীক্ষা দিতে চান না বলে প্রথম আলোকে জানিয়েছেন অভিযোগকারী ওই শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, ‘পুরোনো পড়া এখন নতুন করে পড়া কঠিন। আমি ফল পুনর্মূল্যায়ন চেয়েছিলাম।’
অভিযুক্ত শিক্ষক প্রথম আলোকে বলেন, ‘সেদিন মেয়েটি আমার অফিসে কাজ চেয়ে নিজেই এসেছিল। অফিসে অনেক লোক ছিল। কোনো ধরনের যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটেনি।’
ওই ছাত্রীর অভিযোগকে ‘কাল্পনিক’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ২০১৯ সালের একটি কাল্পনিক ঘটনার বর্ণনা করে মেয়েটি ২০২১ সালে এসে যৌন হয়রানির অভিযোগ করেন। সাম্প্রতিককালে যৌন হয়রানির যতগুলো ঘটনা ঘটেছে, প্রতিটির ক্ষেত্রে কোনো না কোনো দালিলিক প্রমাণ ছিল। এটাতে একটি প্রমাণও পায়নি তদন্ত কমিটি। অবন্তিকা যে নিপীড়নের মধ্যে যাওয়ার কারণে মারা গেছেন, এটার সঙ্গে জনরোষ পুঁজি করে ২০২৪ সালে ওই ঘটনা তুলে আনা হয়েছে।
এ ঘটনায় দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদনকে মিথ্যা দাবি করে এই শিক্ষক বলেন, তিনি ‘শিক্ষক রাজনীতির’ শিকার। তিনি বলেন, ওই তদন্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে তিনি গত বছর উচ্চ আদালতে যান। সেটা এখনো বিচারাধীন। বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ তদন্তে আরেকটি কমিটি গঠন করেছে।
ওই শিক্ষার্থী কেন অভিযোগ করেছেন জানতে চাইলে তিনি দাবি করেন, ‘মেয়েটি ক্লাসে নিয়মিত অনুপস্থিত থাকত। একদিন প্রচণ্ড ধমক দিয়েছিলাম। সেই ক্ষোভ থেকে অভিযোগ করছে।’
এই শিক্ষার্থী বিচার চেয়ে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ‘যৌন নিপীড়নের বিচার চাই’ প্ল্যাকার্ড নিয়ে শহীদ মিনার ও ক্যাম্পাসে একাই দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁর দাবি, বারবার তৎকালীন উপাচার্য, বিভাগীয় প্রধান ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে ঘুরেও বিচার পাননি।