একটি আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত একজন নারী গবেষক ২০ ফেব্রুয়ারি ফেসবুকে একটি ছোট জরিপের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তিনি ফেসবুক বন্ধুদের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, আগের রাতে বন্ধুদের ঘুম কেমন ছিল। উত্তর দিয়েছিলেন ৫৩ জন। তাঁদের মধ্যে ২৬ জন অর্থাৎ ৪৯ শতাংশ বলেছিলেন, ঘুমে সমস্যা ছিল।
একই দিনে ওই নারী গবেষক তাঁর অফিসের ১১ জন সহকর্মীর কাছে ঘুমের বিষয়ে জানতে চেয়েছিলেন। উত্তরে ৯ জন বলেছিলেন, আগের রাতে ভালো ঘুম হয়নি। আগের রাতে নিজের ঘুম ঠিকভাবে না হওয়ার কারণ অনুসন্ধানে গবেষক এ অনুসন্ধান চালিয়েছিলেন।
ভালো ঘুম না হওয়া, ঘুমে সমস্যা হওয়া বা গভীর ঘুম না হওয়ার কথা আজকাল অফিস–আদালত, স্কুল–কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয় বা পারিবারিক আড্ডায় শুনতে পাওয়া যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, যে কারণেই হোক রাতে ঘুম ভালো না হলে পরের দিনটি হয় বিশৃঙ্খল। রাতে ঘুম না হলে কর্মকর্তা কাজের মধ্যে, শিক্ষার্থী স্কুলে অথবা চালক গাড়ি চালানোর সময় ঘুমিয়ে পড়তে পারে। ঘুম না হলে মানুষ ক্লান্ত বোধ করে, মনোযোগ ও সতর্কতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঘুম না হলে অনেক সময় মানুষ স্মৃতিভ্রষ্ট হয়। ঘুম না হওয়া মানুষ খিটখিটে মেজাজের হয়, কেউ কেউ হতাশায় ভোগে। ঘুমের সমস্যায় থাকা মানুষের দুর্ঘটনায় পড়া বা আহত হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
ঘুমের সমস্যা দিন দিন প্রকট হচ্ছে। সমস্যার বিষয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বিপজ্জনক মাত্রায় কম। মানুষ ওষুধনির্ভর হয়ে পড়ছে। স্বাস্থ্য বিভাগের উচিত জনসচেতনতামূলক কাজে হাত দেওয়া। ঘুম বিষয়ে পৃথক কর্মসূচি শুরু করা।অ্যাসোসিয়েশন অব সার্জনস ফর স্লিপ অ্যাপনিয়া বাংলাদেশের মহাসচিব অধ্যাপক মনিলাল আইচ
ঘুমের সমস্যাটি বেশি প্রকট হতে দেখা গেছে করোনা মহামারির সময়। গবেষণায়ও দেখা গেছে, মানুষের ঘুম কমেছে করোনাকালে। গত বছর বিশ্বখ্যাত নেচার সাময়িকীর সায়েন্টেফিক রিপোর্টে বাংলাদেশের মানুষের ঘুম নিয়ে একটি গবেষণা প্রবন্ধ ছাপা হয়েছিল। ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে ৯ হাজার ৭৩০ জনের ঘুমের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছিল। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাজ্যের ইউনিভর্সিটি কলেজ লন্ডনসহ চীন, সৌদি আরব, তাইওয়ান, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার মোট সাতটি বিশ্ববিদ্যালয় ওই গবেষণায় যুক্ত ছিল।
গবেষণায় দেখা যায়, ৬৪.৭ শতাংশ মানুষ রাতে ৭ থেকে ৯ ঘণ্টা ঘুমিয়েছে। রাতে ৭ ঘণ্টার কম ঘুমিয়েছে ২৯.৬ শতাংশ। আর ৯ ঘণ্টার বেশি ঘুমিয়েছে ৫.৭ শতাংশ মানুষ।
এই ফলাফলকে গবেষকেরা তুলনা করেছেন ২০২০ সালের আগে করা অন্য এক গবেষণা ফলাফলের সঙ্গে। আগের ওই গবেষণায় তথ্য নেওয়া হয়েছিল ৩ হাজার ৯৬৮ জনের। সেই গবেষণায় দেখা যায়, ৮৭.৪ শতাংশ মানুষ রাতে ৭ থেকে ৯ ঘণ্টা ঘুমাত। রাতে ৭ ঘণ্টার কম ঘুমাত ৮.৯ শতাংশ মানুষ। আর ৯ ঘণ্টার বেশি ঘুমাত ৩.৭ শতাংশ মানুষ। তুলনায় দেখা যাচ্ছে, কম সময় ঘুমানো মানুষের সংখ্যা বেড়েছে।
নানা কারণ ও বিষয় ঘুমের শত্রু। এর মধ্যে আছে: শিশু, পোষা প্রাণী, শব্দ, আলো, তাপ, শয্যার ধরন, ব্যথা, শয্যাসঙ্গী, কাজের ধরন, অভ্যাস, মাদক, ওষুধ, টেলিভিশন, রেডিও, কম্পিউটার, মুঠোফোন ও আরও অনেক কিছু।
ঘুমের সঙ্গে মানুষের স্বাস্থ্যের সম্পর্ক আছে। সুস্বাস্থ্যের জন্য পর্যাপ্ত ঘুম প্রয়োজন। ঘুম কম হওয়ার সঙ্গে হৃদ্রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও কয়েক ধরনের ক্যানসার বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি আছে। ঝুঁকি কমাতে চিকিৎসকেরা মানুষকে পর্যাপ্ত ঘুমের পরামর্শ দেন, ঘুমানোর জন্য ওষুধ সেবন করতে বলেন। তবে কী পরিমাণ ঘুম পর্যাপ্ত, তা নিয়ে জাতীয় বা বৈশ্বিক পর্যায়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেই।
২০১৫ সালে আমেরিকান একাডেমি অব স্লিপ মেডিসিন এবং স্লিপ রিসার্চ সোসাইটি অতীতের কয়েক হাজার গবেষণা প্রবন্ধ পর্যালোচনা করে বিভিন্ন বয়সী মানুষের ঘুমানোর সময়সীমার প্রস্তাব করে। তাতে ১ থেকে ২ বছর বয়সী শিশুদের ১১ থেকে ১৪ ঘণ্টা ঘুমানোর কথা বলা হয়েছে। ১৪–১৭ বছর বয়সীদের ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা এবং ২৬ থেকে ৬৪ বছর বয়সীদের ৭ –৯ ঘণ্টা ঘুমাতে বলা হয়েছে। ৬৫ বছর বা তার বেশি বয়সীদের ৭–৮ ঘণ্টা ঘুমানো দরকার।
নানা কারণ ও বিষয় ঘুমের শত্রু। এর মধ্যে আছে: শিশু, পোষা প্রাণী, শব্দ, আলো, তাপ, শয্যার ধরন, ব্যথা, শয্যাসঙ্গী, কাজের ধরন, অভ্যাস, মাদক, ওষুধ, টেলিভিশন, রেডিও, কম্পিউটার, মুঠোফোন ও আরও অনেক কিছু।
অক্সফোর্ড প্রকাশনার স্লিপ: আ ভেরি সর্ট ইন্ট্রোডাকশন পুস্তিকায় বলা হয়েছে, ঘুমানোর ঘরে টেলিভিশন ও কম্পিউটার রাখা যাবে না, ঘুমানোর আগে তর্কবিতর্ক বা কঠোর শরীরচর্চা করা যাবে না, শেষ বিকেলে বা সন্ধ্যায় ক্যাফেইনজাতীয় খাবার খাওয়া যাবে না, খুব ক্ষুধা নিয়ে বা ভরা পেটে ঘুমাতে যাওয়া যাবে না, অন্যের ব্যবস্থাপত্রে দেওয়া ঘুমের ওষুধ খাওয়া যাবে না, নিজ উদ্যোগে ঘুমের ওষুধ কেনা যাবে না, ঘুমের জন্য উদ্বিগ্ন হওয়া চলবে না।
ওই পুস্তিকায় আরও বলা হয়েছে ঘুমের জন্য প্রতিদিন একই সময়ে ঘুমাতে ও ঘুম থেকে উঠতে হবে, ঘুমানোর ঘর হবে শুধু ঘুমের জন্য, সকালে ও বিকেলে শরীরচর্চা করতে হবে, নিয়মিত বাইরের আলোর সংস্পর্শে আসতে হবে, শোবার ঘরের তাপমাত্রা সহনীয় শীতল রাখতে হবে, ঘরের পরিবেশ শান্ত রাখতে হবে, ঘুমানোর সময় ঘর পুরোপুরি অন্ধকার রাখতে হবে, ঘুমানোর সময় হাত ও পা যেন গরম থাকে এবং বিছানায় যাওয়ার এক বা দুই ঘণ্টা আগে যত দূর সম্ভব ঘরে কম আলো রাখতে হবে।
বাংলাদেশে ঘুমের সমস্যা নিয়ে স্বাস্থ্য বিভাগের কোনো কাজ বা কর্মসূচি নেই। ঘুমের সমস্যা নিয়ে নাগরিক সমাজে, গণমাধ্যমে আলোচনা নেই বললেই চলে।
এ পরিস্থিতিতে আজ শুক্রবার ১৫ মার্চ বিশ্ব ঘুম দিবস পালিত হচ্ছে। ঢাকায় এ নিয়ে আগামী সোমবার অফিসার্স ক্লাবে সেমিনারের আয়োজন করেছে অ্যাসোসিয়েশন অব সার্জনস ফর স্লিপ অ্যাপনিয়া বাংলাদেশ। সংগঠনটির মহাসচিব অধ্যাপক মনিলাল আইচ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘুমের সমস্যা দিন দিন প্রকট হচ্ছে। সমস্যার বিষয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বিপজ্জনক মাত্রায় কম। মানুষ ওষুধনির্ভর হয়ে পড়ছে। স্বাস্থ্য বিভাগের উচিত জনসচেতনতামূলক কাজে হাত দেওয়া। ঘুম বিষয়ে পৃথক কর্মসূচি শুরু করা।’