জামিল চৌধুরী বহুমাত্রিক গুণে গুণান্বিত এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। তিনি পদার্থবিজ্ঞানী, ভাষা ও অভিধানবিদ, সাহিত্যিক, সরকারি পদস্থ কর্মকর্তা। বাংলাদেশ টেলিভিশনের যাত্রা তাঁর হাত ধরেই। তিনি ছিলেন প্রথম মহাপরিচালক। ২০১৪ সালে তিনি একুশে পদকে ভূষিত হন। ২ জুলাই ছিল তাঁর ৯০তম জন্মবার্ষিকী। কানাডাপ্রবাসী জামিল চৌধুরী বাংলাদেশ টেলিভিশনের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন। এ উপলক্ষেই প্রকাশিত নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার সম্পাদিত ‘সুবর্ণ স্মারক’ নামের স্মরণিকায় তাঁর একটি দীর্ঘ স্মৃতিচারণামূলক লেখা প্রকাশিত হয় ‘সেইসব দিনগুলি’ শিরোনামে। সেই লেখার বিশেষ অংশ নিয়ে ও অন্যান্য সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য নিয়ে এই প্রতিবেদন তৈরি করেছেন প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি আশীষ-উর-রহমান।
রাজধানীর শাহবাগ থেকে তেজগাঁও বিমানবন্দর পর্যন্ত নতুন সড়কটি তখন সবে তৈরি হয়েছে। মাঝখানে সারি করে লাগানো কৃষ্ণচূড়া। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সামনে সড়কদ্বীপে এক বিশাল মহিরুহকে আশ্রয় করে বিচিত্র বর্ণের বাগানবিলাস, মিন্টো রোড আর হেয়ার রোডের সংযোগদ্বীপে কিউ গার্ডেনের উদ্যানবিদ প্রাউডলকের লাগানো দক্ষিণ আমেরিকার দুর্লভ প্রজাতির একটি নাগলিঙ্গমগাছ। ১৯৬৩ সালের এই ঢাকা ছিল শিরীষ, বকুল, চাঁপা, মেহগনি, সেগুনের পুষ্প-পর্ণ-আভরণে ঢাকা।
জামিল চৌধুরী নিসর্গে শ্যামল-শোভন ঢাকার বর্ণনা যখন দিচ্ছিলেন, তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের তরুণ শিক্ষক। পাশাপাশি একটি বেসরকারি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানেও যুক্ত ছিলেন। সেই সূত্রেই একটি জরিপ করার কাজ পেলেন বাণিজ্যিকভাবে ঢাকায় একটি টেলিভিশন কেন্দ্র স্থাপিত হলে তা আদৌ লাভজনক হবে কি না, এ বিষয়ে।
পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের বসবাস ও অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা সত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তানের সবকিছু নিয়ন্ত্রিত হতো পশ্চিমের রাওয়ালপিন্ডি-করাচি থেকে। তিনি লিখেছেন, ‘হঠাৎ করে একদিন—তারিখটা মনে আছে, ২৬ মার্চ ১৯৬৪, করাচি থেকে টেলিফোনে অনুরোধ এল, পরদিন সন্ধ্যায় করাচিতে এনইসির (নিপ্পন ইলেকট্রিক কোম্পানি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুজিমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার। করাচিতে এনইসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুজিমার সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পর কোনো ভূমিকা না করেই তিনি জানতে চাইলেন, ঢাকায় একটি অস্থায়ী পরীক্ষামূলক টেলিভিশন কেন্দ্র স্থাপন এবং ৯০ দিনের জন্য পরিচালনের দায়িত্ব নিতে সম্মত আছি কি না। ঠিক এ ধরনের কোনো আকস্মিক প্রশ্নের জন্য তৈরি ছিলাম না। না ভেবেই উত্তর দিলাম—হ্যাঁ।’
ঢাকা থেকে পরীক্ষামূলকভাবে টেলিভিশনসেবা দেওয়ার জন্য প্রথমে একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। পাকিস্তানের ওয়াজির আলী ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের সঙ্গে জাপানের নিপ্পন ইলেকট্রিক কোম্পানি ও কানেমাতসু গোশো কোম্পানির যৌথ উদ্যোগে গঠন করা এই প্রতিষ্ঠানের নাম রাখা হয়েছিল ‘এনইসি টেলিভিশন গ্রুপ’। জামিল চৌধুরী এনইসি টেলিভিশন গ্রুপের কেন্দ্রাধ্যক্ষের পদ গ্রহণ করে ১৯৬৪ সালের ১ এপ্রিল ঢাকায় ফিরে আসেন।
ঢাকায় এনইসি টেলিভিশনের কাজের সূচনা হয়েছিল জামিল চৌধুরীর সিদ্ধেশ্বরীর বাসায়। ঢাকায় তখন টেলিভিশনের কাজ করার অভিজ্ঞতা কারোরই ছিল না। অফিস থাকার তো কথাই নেই। কাজেই তাঁর বাসার একটি অংশ খালি করে সেখানে টেবিল-চেয়ার পেতে তৈরি হলো অফিস। এখন শুরু হলো কর্মী আর স্টুডিও করার মতো বাড়ি খোঁজার পালা। তিনি লিখেছেন, ‘এমন একটি ভবন, যেখানে স্টুডিও করার মতো অন্তত ১৩-১৪ ফুট উঁচু ছাদসহ একটা বড় হলঘর থাকবে। সবদিক বিবেচনা করে ডিআইটি ভবনের একতলাটাই সবচেয়ে উপযোগী মনে হলো। ডিআইটি ভবন তখন ঢাকার সবচেয়ে উঁচু ভবন। মূল চূড়ার উচ্চতা ১৪২ ফুট। অ্যানটেনা লাগানোর জন্য এটি একটি বিরাট সুবিধা। ডিআইটি (এখন রাজউক) ভবনের ছাদে বসানো হলো অ্যানটেনা আর নিচতলায় করা হলো স্টুডিও।’
এরপর লোকবল। প্রায় তিন মাস পর দ্বিতীয় যে ব্যক্তি এনইসি টেলিভিশনে অনুষ্ঠান পরিচালক হিসেবে যোগ দিলেন, তিনি স্বনামখ্যাত রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী কলিম শরাফী। পরে আরও যাঁরা যুক্ত হলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন খালেদ সালাহউদ্দিন, এম মনিরুল আলম, সৈয়দ ইবনে ইমাম, হেনেসি ফ্রান্সিস, এ কে এম ফজলুল হক, জামান আলী খান, মোহাম্মদ আকমল খান, মুস্তাফা মনোয়ারসহ অনেকে। জামিল চৌধুরী জানাচ্ছেন, ‘টেলিভিশন সম্পর্কে এঁদের কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকা তো দূরের কথা, টেলিভিশন গ্রাহক-যন্ত্রের সঙ্গে তখনো কারুর চাক্ষুষ পরিচয় ঘটেনি। একমাত্র আমিই হয়তো দাবি করতে পারতাম, ছাত্রজীবনে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকালে আমাদের অ্যাপার্টমেন্টে একটি সাদাকালো টেলিভিশন গ্রাহক-যন্ত্র ছিল।’
টেলিভিশনের প্রথম পরীক্ষামূলক সম্প্রচার শুরু হয়েছিল একটি গান দিয়ে। যন্ত্রপাতি বসানোর কাজ শেষ। গানটি ছিল দেবব্রত বিশ্বাসের গাওয়া, ‘এসো গো, জ্বেলে দিয়ে যাও প্রদীপখানি/ বিজন ঘরের কোণে, এসো গো’। জামিল চৌধুরী লিখেছেন, ‘টেলিভিশন গ্রাহক-যন্ত্রে (আমরা যাকে টিভি সেট বলে অভ্যস্ত) গানটি বেজে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আমার সমস্ত শরীরে যেন একটা শিহরণ বয়ে গেল। প্রথমবারের মতো মনে হলো, ঢাকা টেলিভিশন কেন্দ্রটি বোধ হয় সত্যি সত্যিই চালু হতে যাচ্ছে।’
পশ্চিম পাকিস্তানিরাই শুধু নয়, পাকিস্তানপ্রেমীরাও বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য হলেও মনে নেননি। পদে পদে তাঁরা মন থেকেই বাংলাকে বাধাগ্রস্ত করেছেন। টেলিভিশনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেও তেমন ঘটনা ঘটেছিল।
স্বাভাবিকভাবেই আনুষ্ঠানিকভাবে প্রধান অতিথি হিসেবে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের উদ্বোধন করার কথা। তাঁকে কী উপহার দেওয়া হবে, তা নিয়ে এনইসি টেলিভিশন গ্রুপ এবং সরকারের তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়ের মধ্যে আলোচনা হচ্ছিল। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের পরামর্শ নিয়ে জামিল চৌধুরী প্রস্তাব দিয়েছিলেন, ঢাকার ঐতিহ্যবাহী লোকশিল্পের প্রতীক হিসেবে কিছু একটা দেওয়ার। প্রস্তাব গৃহীত হলো। জামিল চৌধুরী শান্তিনগরে শিল্পাচার্যর বাড়িতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক হলো, একটি রুপার থালায় আলপনা খোদাই করা হবে। নকশা করবেন শিল্পাচার্য স্বয়ং। আমি প্রস্তাব করলাম, থালার মাঝখানে ৪ ইঞ্চি চওড়া এবং ৩ ইঞ্চি উঁচু পরিমাপের টেলিভিশন পর্দা আকৃতির একটু জায়গা খালি রেখে সে জায়গায় পুঁথির অক্ষরে ‘আজ শুভ উদ্বোধনে আমাদের আন্তরিক শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন, পাইলট টেলিভিশন, ঢাকা, ১০ পৌষ ১৩৭১’ কথাগুলো লিখে দিলে ভালো হয়। প্রস্তাবটিতে তিনি সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলেন। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন এবং হিসাবরক্ষক আকমল খান ছাড়া ব্যাপারটা কাউকে জানতে দেওয়া হলো না।
টেলিভিশনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হবে ১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যায়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের উপহারের নকশাখচিত থালা তৈরি। এরপরই ঘটল মজার ঘটনা। জামিল চৌধুরী লিখছেন, ‘২৫ তারিখ সকালে (উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের দিন সকালে) ডিআইটি ভবনে কেন্দ্রীয় তথ্য ও বেতার সচিব আলতাফ গওহর, তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়ের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবদুল কাইয়ুম ও পাকিস্তান বেতারের পরিচালক কলিমউল্লাহ ফাহমী ডিআইটি ভবনে আসার পর থালাটি সিন্দুক থেকে বের করে ওঁদের দেখানো হলো। জিনিসটি দেখেই ওঁরা তেলেবেগুনে চটে উঠলেন; বাংলায় লেখা উপহার কী করে আইয়ুব খানকে দেওয়া যায়! আমি খুব শান্ত কণ্ঠে বললাম, বাংলা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা এবং রাষ্ট্রপ্রধানকে রাষ্ট্রভাষায় লেখা কোনো উপহার দেওয়াতে আমি অন্যায়ের কিছু দেখি না। বাধ্য হয়ে সবকিছু মেনে নিতে হলো। কেননা কয়েক ঘণ্টার মধ্যে নতুন করে বিকল্প কিছু তৈরি করা সম্ভব নয়। তদানীন্তন পাকিস্তানে এহেন আচরণ ছিল অভাবনীয় এবং প্রায় রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল।’
ঢাকা টেলিভিশনের অনুষ্ঠানের প্রথম ঘোষণা দিয়েছিলেন মারডেকাই কোহেন (বংশপরম্পরায় তাঁদের বাড়ি ছিল রাজশাহীতে। সুদর্শন কোহেন পরে কয়েকটি চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছেন। একপর্যায়ে ইহুদি বংশোদ্ভূত কোহেনরা সপরিবার ভারতে চলে যান। তিনি বিটিভির সুবর্ণজয়ন্তী উৎসবে অংশ নিতে সস্ত্রীক শেষবার ঢাকায় আসেন)।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল সন্ধ্যায় নির্ধারিত সময়েই। জামিল চৌধুরী লিখেছেন, ‘ঠিক সন্ধ্যা ছটায় নিরাপত্তারক্ষী পরিবেষ্টিত হয়ে আইয়ুব খান আর গভর্নর মোনেম খান পঞ্চতারকা খচিত শুভ্র ধবল ক্যাডিলাক গাড়িতে করে ডিআইটি ভবন প্রাঙ্গণে প্রবেশ করলেন। টেলিভিশনের পর্দায় ভেসে উঠল সে দৃশ্য। নেপথ্যে টেলিভিশন কেন্দ্রের অনুষ্ঠান ঘোষক মরডেকাই কোহেনের কণ্ঠে শোনা গেল “শুভ সন্ধ্যা, পাইলট টেলিভিশন ঢাকা কেন্দ্রের শুভ উদ্বোধন অনুষ্ঠানে দর্শকদের স্বাগত জানাচ্ছি।”
ডিআইটি ভবনের গাড়িবারান্দার নিচে মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে। বাগানে চেয়ার পেতে অতিথিদের বসার আয়োজন করা হয়েছে। আনুষ্ঠানিক পরিচিতি পর্বের পর মঞ্চে উপবেশন করলেন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান, গভর্নর মোনেম খান, এনইসির প্রেসিডেন্ট ওয়াতানাবে এবং কেন্দ্রীয় তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়ের সচিব আলতাফ গওহর।…ঢাকা টেলিভিশন কেন্দ্রের উদ্বোধন ঘোষণা করার পর এনইসি টেলিভিশন গ্রুপের পক্ষ থেকে ওয়াতানাবে রুপার থালাটি প্রধান অতিথি আইয়ুব খানের হাতে তুলে দিলেন আর সঙ্গে সঙ্গে টেলিভিশনের পর্দায় কালো পটভূমির ওপর সাদা পুঁথির অক্ষরে “আজ শুভ উদ্বোধনে আমাদের আন্তরিক শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন, পাইলট টেলিভিশন, ঢাকা, ১০ পৌষ ১৩৭১” লেখা ফুটে উঠল। নেপথ্যে শোনা গেল অনুষ্ঠান ঘোষক মরডেকাই কোহেনের কণ্ঠে পাঠ।’
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর প্রচারিত সংবাদ নিয়েই প্রশ্ন উঠল। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আগে থেকেই ডিআইটি ভবনের বিপরীতে বিখ্যাত পল্টন ময়দানে চলছিল ফাতেমা জিন্নাহর বিশাল জনসভা। তিনি প্রেসিডেন্ট পদে আইয়ুব খানের বিপরীতে ভোটে লড়ছিলেন। সভার বক্তাদের মধ্যে ফাতেমা জিন্নাহ নিজেই ছিলেন। তখন ময়দানের চারপাশে কোনো প্রাচীর-জাতীয় কিছু ছিল না। ময়দান প্রকৃতই ছিল ময়দানের মতোই খোলামেলা।
জনসভার একাংশ এসে বাধা দিয়েছিল উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। পরে তাদের শান্ত করা হয়েছিল। তবে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর টেলিভিশনে যে সংবাদ প্রচার করা হয়েছিল, সেখানে ফাতেমা জিন্নাহর সেই বিশাল জনসভার সংবাদের নামগন্ধও ছিল না। জামিল চৌধুরী আক্ষেপ করে লিখেছেন, ‘রাত আটটায় প্রচারিত হলো বাংলা খবর। ডিআইটি ভবনের ঠিক উল্টো দিকের মাঠে মিস জিন্নাহর সভার কোনো উল্লেখ ছিল না খবরে। আর তখনই আরম্ভ হলো গণমানুষের কাছে টেলিভিশনের বিশ্বাসযোগ্যতা হারানোর প্রক্রিয়া।’
সমালোচকেরা প্রায়ই বলেন, বর্তমান টেলিভিশন প্রশাসন দর্শকদের বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। আমি তাঁদের সঙ্গে একমত নই। ২৫ ডিসেম্বরে জন্মলগ্নে আঁতুড়ঘরেই টেলিভিশন দর্শকদের বিশ্বাসযোগ্যতা হারায়।
ঢাকা টেলিভিশন কেন্দ্রের ৯০ দিন পরীক্ষামূলক অনুষ্ঠান প্রচারের মেয়াদ শেষ হয় ১৯৬৫ সালের ২৫ মার্চে। পরীক্ষা পর্ব সফল হওয়ায় সরকার ৫ কোটি টাকার মূলধন বরাদ্দ করে। ১৯১৩ সালের কোম্পানি আইনের অধীনে ‘টেলিভিশন প্রোমোটার্স কোম্পানি লিমিটেড’ নামে একটি প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি গঠন করা হয়। তখন থেকে কেন্দ্রপরিচিতি প্রতীক (Station identification) ‘পাইলট টেলিভিশন ঢাকা’ থেকে পরিবর্তন করে ‘পাকিস্তান টেলিভিশন সার্ভিস, ঢাকা’ করা হয়েছিল।
টেলিভিশনের স্থায়ী ভবন নির্মাণের জন্য শুরু হলো জায়গা খোঁজা। পরিকল্পনা ছিল ৪ থেকে ১২ একর খোলা জায়গা বাছাই করা হবে। জামিল চৌধুরীর ভাষায়, নগর-পরিকল্পক কে আর চৌধুরী বৃহত্তর ঢাকা মহানগরীর একটি মানচিত্র খুলে গুলশানের দক্ষিণ দিকে খালের ধারে দ্বীপের মতো একটি জায়গা দেখিয়ে বললেন, সব দিক বিবেচনা করলে এই জায়গা সবচেয়ে সুবিধাজনক হবে। জায়গাটির নাম রামপুরা। জায়গাটির মালিক মনসুর আহমেদ। কেবল একটি অসুবিধা ছিল, ওখানে যাওয়ার কোনো রাস্তা নেই। কে আর চৌধুরীকে সঙ্গে নিয়ে গেলাম জায়গা দেখতে; যাওয়া তো নয়, রীতিমতো অভিযান। মৌচাক বাজারে গাড়ি রেখে নরম কাদামাটির ওপর দিয়ে হেঁটে দুই ঘণ্টায় রামপুরা পৌঁছলাম। ওই জায়গাই স্থায়ী টেলিভিশন ভবন নির্মাণের জন্য চূড়ান্তভাবে নির্বাচন করা হলো।
একাত্তরের উত্তপ্ত দিনগুলোতে টেলিভিশনের অনুষ্ঠানেও পরিবর্তন আসে। তিনি লিখেছেন, ‘ডিআইটি ভবনের স্টুডিও থেকে প্রচারিত অনুষ্ঠানে দেশের সার্বিক অবস্থার প্রতিফলন ঘটতে আরম্ভ করল। ৩ মার্চ থেকে কেন্দ্রপরিচিতি প্রতীক “পাকিস্তান টেলিভিশন সার্ভিস ঢাকা” বদলে হয়ে গেল “ঢাকা টেলিভিশন”। মুস্তাফা মনোয়ারের নেতৃত্বে প্রচারিত টেলিভিশনের তাবৎ অনুষ্ঠান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য প্রয়োজনীয় প্রেরণা ও সাহস জোগানোর কাজে ঐতিহাসিক অবদান রেখেছিল বাঙালির জীবনে। ওই অনুষ্ঠানের জন্য ড. নাওয়াজেশ আহমদ ওঁর নিজের তোলা স্থিরচিত্র সরবরাহ করে বাংলাদেশ টেলিভিশনের সঙ্গে সর্বাত্মকভাবে সহযোগিতা করেন।’
তিনি লিখেছেন, ‘১৯৭১ সালের ২৩ মার্চে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। সেদিন পাকিস্তান দিবসে সেনানিবাস ছাড়া বাংলাদেশের কোথাও পাকিস্তানের পতাকা ওড়েনি। ঢাকা টেলিভিশনের কর্মীরাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঠিক করলেন, ২৩ মার্চে টেলিভিশনের পর্দায় পাকিস্তানের পতাকা দেখানো হবে না বা পাকিস্তানের জাতীয় সংগীত প্রচার করা হবে না। অপর দিকে সেদিন অনুষ্ঠানের শেষে টেলিভিশনে পাকিস্তানের পতাকা না দেখানো হলে পাকিস্তান সেনাবেষ্টিত ডিআইটি ভবন থেকে কাউকে বেরিয়ে আসতে দেওয়া হবে না বলে সামরিক কর্তৃপক্ষ হুমকি দিলেন। রাত সাড়ে ৯টায় অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণার সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরও ফাহমিদা খাতুনের কণ্ঠে “আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি/তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী” গানটি প্রচারিত হতে থাকল। মধ্যরাত পর্যন্ত গানটি প্রচারের পর রাত ১২টা ১ মিনিটে অনুষ্ঠান ঘোষিকা মাসুমা খাতুন ঘোষণা করলেন, “এখন সময় রাত ১২টা বেজে ১ মিনিট । আজ ২৪ মার্চ, ১৯৭১। আজকের অনুষ্ঠানের এখানেই সমাপ্তি।” ’
পাকিস্তানের জাতীয় দিবসে ঢাকা টেলিভিশন থেকে পাকিস্তানি পতাকা ও জাতীয় সংগীত বর্জনের এই দৃপ্ত পদক্ষেপ সমগ্র নগরবাসীকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপের প্রতিবাদে ২৪ মার্চ ঢাকা টেলিভিশন কেন্দ্র থেকে আর কোনো অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়নি। ১২ চৈত্র, ১৩৭৭ (২৬ মার্চ, ১৯৭১) তারিখ শুক্রবার থেকে ঢাকা টেলিভিশন কেন্দ্র চলে গেল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে।’
মুক্তিযুদ্ধের সময় জামিল চৌধুরী কলকাতায় বাংলাদেশ তথ্য ব্যাংক পরিচালনের দায়িত্ব পালন করেছেন। মহান বিজয়ের পর তিনি দেশে ফিরে টেলিভিশন পরিচালনা শুরুর দায়িত্ব নেন। সম্প্রচার শুরু হয় ১৯৭১ সালের ২১ ডিসেম্বর থেকে। নাম রাখা হয় ‘বাংলাদেশ টেলিভিশন করপোরেশন ঢাকা’। ‘ধন ধান্য পুষ্পভরা’ গানের স্বরলিপির ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ টেলিভিশনের জন্য রচিত হলো অভিজ্ঞানবাদ্য (signature tune)।
১৯৭২ সালের ১৫ সেপ্টেম্বরের বাংলাদেশ গেজেটে প্রকাশিত রাষ্ট্রপতির ১১৫ নম্বর আদেশবলে বাংলাদেশে অবস্থিত সাবেক পাকিস্তান টেলিভিশন করপোরেশনের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ করে বাংলাদেশে কর্মরত টেলিভিশন করপোরেশনের সব কর্মচারী ও কর্মকর্তাকে সরকারি কর্মচারী ও কর্মকর্তারূপে ঘোষণা করা হয়। তখন থেকে টেলিভিশনের কেন্দ্রপরিচিতি প্রতীক করা হলো ‘বাংলাদেশ টেলিভিশন, ঢাকা’। যা বাংলাদেশ টেলিভিশন বা বিটিভি নামে পরিচিত।
দীর্ঘ এই স্মৃতিচারণায় জামিল চৌধুরী উপসংহার টেনেছেন এভাবে, ‘টেলিভিশনকর্মীরা প্রায়ই বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন নানা ধরনের লিখিত ও অলিখিত বিধিনিষেধ নিয়ে। টেলিভিশন অনুষ্ঠান প্রচারের জন্য সুস্পষ্ট লিখিত বিধিনিষেধ এখন যেমন খুব একটা নেই, তখনো ছিল না। অধিকাংশ বিধিনিষেধই স্ব-আরোপিত বা স্বকল্পিত। আমি মনে করি, যেকোনো বিধিনিষেধ অবাঞ্ছিত এবং বর্তমান প্রেক্ষাপটে সম্পূর্ণ অর্থহীন। কারণ, আমরা বর্তমানে এমন একটি যুগে বাস করি, যখন ভূ-উপগ্রহ, আইএসডি, ই-মেইল ও প্লেইন পেপার কপিয়ারের কল্যাণে যোগাযোগের ক্ষেত্রে এমন একটি বিপ্লব ঘটে গিয়েছে যে যেকোনো ব্যক্তি তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী তথ্য যেকোনো উৎস থেকে যেকোনো সময়ে সংগ্রহ করতে পারেন। কাজেই স্ব-আরোপিতই হোক বা কর্তৃপক্ষ নির্দেশিতই হোক, যেকোনো বিধিনিষেধ সম্পূর্ণভাবে অর্থহীন। বিধিনিষেধ যে কেবল দর্শকদের অনাস্থা অর্জন করে তা-ই নয়, ওই মাধ্যমে কর্মীদেরও সমাজের সচেতন ও বিদগ্ধ নাগরিকদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। আমি মনে করি, সরকারের দায়িত্ব হলো টেলিভিশনকে সুস্পষ্ট নীতিনির্দেশনা দেওয়া আর টেলিভিশনের দায়িত্ব হলো পেশাগত অভিজ্ঞতার আলোকে সরকারকে পরামর্শ দেওয়া।’
* প্রয়োজনীয় তথ্য ও বিটিভির সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানের ছবিগুলো দিয়েছেন নাট্যব্যক্তিত্ব ও বিটিভির সাবেক মহাপরিচালক খ ম হারূন।