ছাত্রীদের নিরাপত্তা দিতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ব্যর্থ: সুবর্ণা মজুমদার

সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক ছাত্রী যৌন নিপীড়ন ও হেনস্তার শিকার হয়েছেন। বেশির ভাগ ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিরা শাস্তি পাননি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এসব ঘটনায় নানা কর্মসূচিও পালন করেছেন, কিন্তু কর্তৃপক্ষ শক্ত কোনো ভূমিকা নিতে পারেনি। এসব বিষয় নিয়ে কথা বলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সুবর্ণা মজুমদার। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক সুজয় চৌধুরী

অধ্যাপক সুবর্ণা মজুমদার
প্রশ্ন

প্রথম আলো: সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক ছাত্রী শাটলে ও বাসে ধর্ষণচেষ্টার শিকার হয়েছেন। কিন্তু এবার একেবারে ক্যাম্পাসের ভেতরেই এক ছাত্রীকে যৌন নিপীড়ন করা হলো। পাঁচ দিন পার হলেও জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্ত করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?

সুবর্ণা মজুমদার: অনেক দিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের সঙ্গে যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটছে। এসব ঘটনার মধ্যে ক্যাম্পাসে অতি সম্প্রতি দুটি ঘটনা ঘটেছে। সবশেষ এক ছাত্রীকে প্রীতিলতা হলের কাছ থেকে বোটানিক্যাল গার্ডেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেখানে বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ করা হয়েছে। এটা অকল্পনীয়। এর আগে গত সেপ্টেম্বরে দুই ছাত্রীকে ক্যাম্পাসের ভেতর শ্লীলতাহানির চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু কোনো ঘটনারই বিচার হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে পারেনি। এর কারণ হচ্ছে এসব ঘটনায় একটি সুনির্দিষ্ট ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীরা জড়িত। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিপীড়নের শিকার হওয়া ছাত্রীদের দায়িত্ব নিচ্ছে না।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: দায়িত্ব না নেওয়ার কারণ কী বলে মনে হয়?

সুবর্ণা মজুমদার: প্রশাসনের বিভিন্ন পদে যাঁরা বসে আছেন, তাঁদের সততা ও সাহসের বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ। তাঁরা ক্ষমতা কাঠামোর কাছাকাছি থাকতে চান। পদ–পদবির সঙ্গে আর্থিক সুবিধা, অনুদান, ব্যক্তিগত পদোন্নতিসহ নানা কিছু জড়িত। অন্যদিকে নিপীড়নকারী ব্যক্তিরা রাজনৈতিক আশ্রয়–প্রশ্রয়ে এ ঘটনা ঘটান। ফলে তাঁদের বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার মতো মেরুদণ্ড প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিদের নেই।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: ছাত্রীদের নিরাপত্তায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা কী?

সুবর্ণা মজুমদার: ছাত্রীদের নিরাপত্তা দিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ব্যর্থ। একটা ঘটনারও বিচার হয়নি। নিপীড়নবিরোধী একটা সেল রয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়নের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত ওই সেল তৈরির নির্দেশনা দিয়েছিলেন। ওই সেলকে পুরোপুরি অকার্যকর করে রাখা হয়েছে। ছাত্রীরা সেলে অভিযোগ নিয়ে গেলে, অভিযোগ কমিটির কর্তাব্যক্তিরা পরিকল্পিতভাবে অভিযোগটি গুরুত্ব দেন না। অভিযোগ আমলে নিলেও দিনের পর দিন প্রতিবেদন ফেলে রাখা হয়। সেলে যাঁরা আছেন, তাঁরা সুনির্দিষ্ট ওই ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীদের চটিয়ে ক্ষমতাসীন দলের বিরাগভাজন হতে চান না। এ কারণে প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখে না। কারণ, ক্যাম্পাসের ভেতর ছাত্রীদের সঙ্গে ঘটা বেশির ভাগ ঘটনায় ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীরাই জড়িত থাকার খবর আমরা সবাই জানি।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: ছাত্রলীগের সঙ্গে স্থানীয় যুবলীগ নামধারী নেতার অনুসারীদের মধ্যে সম্প্রতি সংঘর্ষ হয়েছে। এ ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু ছাত্রীকে যৌন নিপীড়নের দুই দিন পর লিখিত অভিযোগ নেওয়া হয়েছে। এ ঘটনায় এখনো কাউকে শনাক্ত করা যায়নি। বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?

সুবর্ণা মজুমদার: প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিরা ক্ষমতাসীন দলের আস্থাভাজন। এ কর্তাব্যক্তিরা লাভের স্বার্থটাই বেশি খোঁজেন। স্বাভাবিকভাবেই তাঁরা ক্ষমতাসীন দল ও ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের কাছে নতজানু হয়ে থাকেন। তাই ওই ছাত্রসংগঠনের কেউ আক্রান্ত হলে তাঁদের রক্ষা করার জন্য প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিরা ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। এ কারণে নেতা-কর্মীদের বেলায় এক ধরনের সক্রিয়তা, অন্য শিক্ষার্থীদের বেলায় অনেকটাই নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করে কর্তৃপক্ষ।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: ঘটনার পর তড়িঘড়ি করে একটা কমিটি করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এটিকে কীভাবে দেখছেন?

সুবর্ণা মজুমদার: প্রথমত এমন কোনো কমিটি করার এখতিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নেই। কারণ, যৌন নিপীড়নের বিচার কীভাবে হবে, সে বিষয়ে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা রয়েছে। যৌন নিপীড়নবিরোধী একটা সেল রয়েছে। ছাত্রীরা যৌন নিপীড়নের শিকার হলে অভিযোগ সে কমিটিতে দিতে পারেন। কর্তৃপক্ষ নিপীড়নবিরোধী সেলকে কার্যকর না করে আরেকটা কমিটি গঠন করেছে। এটি পুরোপুরি অপ্রয়োজনীয়। আবার কমিটিতে যাঁদের রাখা হয়েছে, বিভিন্ন সময়ে তাঁদের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ। লক্ষ করার বিষয় ওই কমিটিতে চারজনই পুরুষ। মূলত ঘটনা চাপা দিতে লোকদেখানো একটা কমিটি হয়েছে। ফলে কমিটি দিয়ে বিচার করা যাবে না। উচ্চ আদালতের নির্দেশনাই মানতে হবে। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ওই সেল সম্বন্ধে শিক্ষার্থীদের পরিকল্পিতভাবে জানতে দেয় না। অনেক ছাত্রীই সেলের বিষয়ে জানেন না। আর সেলকেও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। নতুন করে কমিটির প্রয়োজন ছিল না।