ঠাকুরগাঁও সদরের কহরপাড়া গ্রাম। পাকা সড়কটির ডানে-বাঁয়ে ফসলি জমি, ঝোপঝাড়, পাড়া-মহল্লা, স্কুল, মসজিদ, চায়ের দোকান—এসব রেখে এঁকেবেঁকে এগিয়ে গেছে দূরদূরান্তে। সেই পথটির পাশেই মরিয়ম আক্তারদের বাড়ি। বারান্দায় বসে প্রখর দৃষ্টিতে কিছু একটা দেখছেন মরিয়মসহ দুই নারী। মরিয়মের হাতে একটি স্মার্টফোন। তাতেই মনোযোগী তিনজন। আমাদের উপস্থিতি টের পেয়ে এগিয়ে এলেন মরিয়ম। বললেন, ‘চাচি (মরিয়মের প্রতিবেশী) কয়েক দিন ধরে নিজেই চকলেট-কেক বানানোর চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু কিছুতেই ঠিকঠাক পারছিলেন না। কোথায় যেন ঘাটতি থেকে যাচ্ছিল। তাই এখন ইউটিউবে ভিডিও দেখে কেক বানানো শিখে নিচ্ছেন।’
মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ভিডিওটি দেখা শেষ হলো। এবার মরিয়ম কেক তৈরির পুরো প্রক্রিয়াটি আবারও তাঁকে বুঝিয়ে দিলেন। এরপর হাসিমুখে বিদায় নিলেন দুজন।
মরিয়মের বাবা ওসমান গনি পেশায় রাজমিস্ত্রি। ২০১৮ সালে এসএসসি পাস করেন মরিয়ম। ২০২০ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় পাসের পর বিয়ে হয় তাঁর। এরপরই পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায়। বিয়ের পরের বছরই কোলজুড়ে আসে সন্তান। সংসার সামলানোর পরও অবসর সময় থাকে মরিয়মের। সেই সময়টুকুতে গ্রামের মানুষকে নানাভাবে সহযোগিতা করেন তিনি।
কথা বলা ছাড়াও ইন্টারনেটের কল্যাণে স্মার্টফোন নানা কাজে ব্যবহার হয়। গ্রামীণ নারীদের ইন্টারনেটের বহুমুখী ব্যবহার শেখানোর জন্য গ্রামীণফোনের আয়োজনে চলছে ‘ইন্টারনেটের দুনিয়া সবার’ প্রচারাভিযান। যার আওতায় দেশের দুই হাজার ইউনিয়নে চলছে উঠান বৈঠক।
গত ২৯ সেপ্টেম্বর ঠাকুরগাঁওয়ের সদর উপজেলার নারগুন ইউনিয়নে অনুষ্ঠিত হয় এ বৈঠক। সেখানেই অংশ নিয়েছিলেন মরিয়ম আক্তার। উঠান বৈঠকে কুইজের সঠিক উত্তর দিয়ে তিনি জিতে নেন ঢাকা ব্যাংকের সৌজন্যে একটি স্মার্টফোন। এরপর খুশি আর ধরে না মরিয়মের। বলেন, ‘আমার স্মার্টফোন ছিল না। বাবার স্মার্টফোন দিয়ে মাঝেমধ্যে দরকারি তথ্য জানতাম। তবে সেটার স্ক্রিনটা ভাঙা ছিল। ঠিকমতো ছবি বা ভিডিও দেখা যায় না। উঠান বৈঠকে এসে জরুরি অনেক কিছু শেখার পাশাপাশি একটা স্মার্টফোনও পুরস্কার পেয়ে গেলাম। এ আনন্দ অতুলনীয়।’
মরিয়মের পরিকল্পনা ছিল স্মার্টফোনটি শুধু নিজের জন্য নয়, গ্রামবাসীরও কাজে লাগাবেন। এর পর থেকে স্মার্টফোন দিয়ে গ্রামবাসীর নানা টুকিটাকি সমস্যার সমাধান দিতে শুরু করেন তিনি। প্রমাণ পাওয়া গেল মরিয়মের প্রতিবেশী গৃহিণী লাইলি বেগমের কথায়, ‘ফোনখান পায়ে হামার খুব উপকার হছে।’
এরপর তিনি মরিয়মের হাতের স্মার্টফোনটি দেখিয়ে বলেন, ‘ওই ফোনখান দিয়া হামরা কত–কী শিখছু। তোমার মোবাইল পায়ে মরিয়ম অ্যালা তথ্য আপা হয়ে গেইছে।’
২.
ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার বড়বাড়ি ইউনিয়নের বেলহাড়া গ্রামের গৃহিণী নার্গিস আক্তার। ২০২২ সালে হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করেন। বিয়ের পর আর লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারেননি তিনি। ২০ অক্টোবর তাঁদের গ্রামে অনুষ্ঠিত হয় উঠান বৈঠক। সেখানে অংশ নিয়েছিলেন নার্গিস। এ আয়োজনে কুইজের সঠিক উত্তর দিয়ে তিনি জিতে নেন একটি স্মার্টফোন। নার্গিস আক্তার বলেন, ‘গ্রামের অনেকেই আমার কাছে কৃষি বিষয়ে নানা সমস্যা সম্পর্কে জানতে চাইতেন। ভালো মুঠোফোন না থাকায় মুখে মুখে তাঁদের বোঝানো আমার জন্য সহজ ছিল না। উঠান বৈঠকে স্মার্টফোনটি পেয়ে ইউটিউব থেকেই কৃষি বিষয়ের নানা সমস্যার সমাধান একেবারে লাইভ দেখাতে পারছি। এতে গ্রামবাসী সহজেই বুঝতে পারছেন।’
নার্গিসদের গ্রামের উত্তরপাড়ার জিন্নাতুন নাহার সংসারের প্রয়োজনে নকশিকাঁথা সেলাই করেন। এক ক্রেতা তাঁকে পাঁচটি কাঁথার ফরমাশ দেন। কিন্তু নকশা পছন্দ হচ্ছিল না তাঁর। অবশেষে সেই ক্রেতাকে নার্গিসের কাছে নিয়ে এলেন জিন্নাতুন। নার্গিস চটপট ইউটিউব থেকে কাঁথার অনেকগুলো নকশা বের করে দেখালেন। সেখান থেকেই গ্রাহক বেছে নেন নিজের পছন্দের নকশাটি। এভাবেই স্মার্টফোন হয়ে উঠছে তাঁদের নানা সমস্যা সমাধানের উপায়।
৩.
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার নয়াহাট গ্রামের পলি রানী সরকার। সংসার সামলানোর পাশাপাশি মেয়েদের জামাকাপড় সেলাইয়ের কাজও করেন। ৩০ সেপ্টেম্বর একই উপজেলার গড়েয়া ইউনিয়নের উঠান বৈঠকে কুইজে অংশ নিয়ে স্মার্টফোন জেতেন তিনি। পলি রানী বলেন, ‘স্মার্টফোন পাওয়ার পর ইউটিউবের ভিডিওর মাধ্যমে আমি ক্রেতাদের নতুন নতুন ডিজাইনের জামার নকশা দেখাতে পারছি। পাশাপাশি ইন্টারনেট ব্যবহার করে গ্রামবাসীকে নানা বিষয়ে তথ্য জানাতে পারছি। এতে আমার ব্যবসাও বেড়েছে। আমি এখন চেষ্টা করব অনলাইনে মেয়েদের পোশাক বিক্রির একটা ব্যবসা শুরু করতে।’
২৩ অক্টোবর ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ উপজেলার কোষারাণীগঞ্জ ইউনিয়নে অনুষ্ঠিত হয় উঠান বৈঠক। এ আয়োজনের শেষ ধাপে ছিল স্মার্টফোনে কথা বলে (ভয়েস কমান্ড) নির্দিষ্ট প্রশ্নের উত্তর খোঁজা। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে একজন ছিলেন একই গ্রামের গৃহিণী সাজেদা বেগম। তাঁর পরিকল্পনা ছিল, যদি পুরস্কার হিসেবে স্মার্টফোন পেয়েই যান, সেটি গ্রামের মানুষের উপকারে কাজে লাগাবেন, হলোও তা–ই। কুইজে পুরস্কার হিসেবে স্মার্টফোন পেয়ে সাজেদা দারুণ খুশি। পুরস্কারের প্যাকেট খুলে গ্রামবাসীকে স্মার্টফোনটি দেখিয়ে বলেন, ‘কোনো তথ্য লাগিলে মোরঠে আইসেন।’
মরিয়ম আক্তার, নার্গিস আক্তার, পলি রানী সরকার ও সাজেদা বেগমের মতো অসংখ্য গ্রামীণ নারীকে অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছে উঠান বৈঠক। ইন্টারনেটের মাধ্যমে জীবনের চলার পথের ছোটখাটো সমস্যার সমাধান যেন গ্রামীণ নারীরা নিজেরাই করতে পারেন, সেটাই এ আয়োজনের লক্ষ্য। ২০২৩ সালের মার্চে শুরু হওয়া কার্যক্রমের আওতায় গতকাল বুধবার (৩০ অক্টোবর) পর্যন্ত ১ হাজার ৫৫৫টি ইউনিয়নে উঠান বৈঠক সম্পন্ন হয়েছে।