২০০৮ সাল থেকে কত হাসপাতালে যে ঘুরেছেন, তার হিসাব নেই! বিভিন্ন হাসপাতালে নানা পরীক্ষায় টাকা খরচ হলেও সমস্যার সমাধান হয়নি। ভারতের চেন্নাইয়ে যাওয়ার কথাও ভেবেছিলেন, তবে সম্ভাব্য খরচের হিসাব কষে পিছিয়ে যান। অবশেষে মো. নাজমুল হক মোল্লার (৫২) মুখে হাসি ফুটেছে।
গতকাল সোমবার দুপুরে জাতীয় হৃদ্রোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের কেবিনে বসে কথা হলো সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ডেন্টাল টেকনোলজিস্ট নাজমুল হক মোল্লার সঙ্গে। গত শনিবার ৯ সেপ্টেম্বর তাঁর জটিল একটি অস্ত্রোপচার হয়েছে। চিকিৎসকেরা জানালেন, দু-এক দিনের মধ্যেই বাড়ি ফিরতে পারবেন তিনি।
নাজমুল হক মোল্লার অসুখটির নাম হাইপারট্রপিক অবসট্রাকটিভ কার্ডিওমায়োপ্যাথি (এইচওসিএম)। এটি হার্ট বা হৃৎপিণ্ডের একটি বংশগত ও জন্মগত রোগ। এটি হৃৎপিণ্ডের মাংসপেশির অসুখ।
এক ছেলে ও এক মেয়ের বাবা নাজমুল হক মোল্লা জানান, তাঁর বাবা, চাচা ও বড় ভাইয়ের একই সমস্যা ছিল। তাঁরা কোনো চিকিৎসা না পেয়েই মারা গেছেন। নাজমুল হক মোল্লার আফসোস, এই রোগের চিকিৎসা আছে—এ কথা আগে জানা থাকলে আপনজনদের বাঁচানোর জন্য অন্তত চেষ্টা করতে পারতেন।
হাইপারট্রপিক অবসট্রাকটিভ কার্ডিওমায়োপ্যাথি হলে রোগী হাঁটতে গেলে হাঁপিয়ে যান, শ্বাসকষ্ট হয়ে বুকে ব্যথা ও ধড়ফড় শুরু হয়। কিছু রোগী হাঁটতে গেলে অথবা দৌড়াতে গেলে অজ্ঞান হয়েও যেতে পারেন।
নাজমুল হক মোল্লা জানান, তাঁর কর্মক্ষেত্র একটি টিলার ওপরে। বাসা থেকে একদম কাছে, কিন্তু তিনি টিলা বেয়ে উঠতে পারতেন না। অনেককে এ কথা বিশ্বাস করানোও কঠিন ছিল যে এতটুকু পথ যেতে তাঁর আসলেই কষ্ট হয়। কর্মক্ষেত্রে যেতে না পারায় নাজমুল হক মোল্লার ৯ মাস ধরে বেতন বন্ধ রয়েছে।
নাজমুল হক মোল্লা জাতীয় হৃদ্রোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ১১তম হাইপারট্রপিক অবসট্রাকটিভ কার্ডিওমায়োপ্যাথি রোগী, যিনি রোগমুক্ত হয়ে হাসিমুখে বাড়িতে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এখন কেমন আছেন, জানতে চাইলে নাজমুল হক মোল্লা বললেন, ‘অস্ত্রোপচারের পর তেমন একটা হাঁটাহাঁটি শুরু করিনি। তবে এখন মনে হচ্ছে, আমি দৌড়াতেও পারব।’
নাজমুল হক মোল্লা যখন কথা বলছিলেন, তাঁর পাশেই হাসিমুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন জাতীয় হৃদ্রোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক (কার্ডিওলজি) প্রদীপ কুমার কর্মকার ও তাঁর দলের অন্য সদস্যরা। নাজমুল হক মোল্লার কথায় সায় দিলেন প্রদীপ কুমার কর্মকার। তবে নাজমুল হক মোল্লাকে ফলোআপে থাকতে হবে, সে কথাও মনে করিয়ে দিলেন তিনি। আর নাজমুল হক মোল্লা এই চিকিৎসক ও তাঁর দলের সদস্যদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন।
ক্লিনিক্যাল ও ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজিস্ট প্রদীপ কুমার কর্মকার প্রথম আলোকে বলেন, হাইপারট্রপিক অবসট্রাকটিভ কার্ডিওমায়োপ্যাথি রোগীর জন্য দুই ধরনের চিকিৎসাপদ্ধতি আছে। একটি বুক কেটে, আরেকটি বুক না কেটে ইন্টারভেনশনাল পদ্ধতিতে। বুক কেটে বা ওপেন হার্ট পদ্ধতিতে বুকের হাড় কাটতে হয়। হার্ট কেটে ওই মাংসপেশিকে কেটে নেওয়া হয়। বুক কেটে এ ধরনের চিকিৎসা ঝুঁকিপূর্ণ ও ব্যয়বহুল। বাংলাদেশে এ রোগের চিকিৎসা খুবই অপ্রতুল।
গত প্রায় দুই বছরে নাজমুল হক মোল্লাসহ মোট ১১ রোগী এ হাসপাতালে বুক না কেটে অত্যাধুনিক চিকিৎসা পেয়েছেন বলে জানালেন প্রদীপ কুমার কর্মকার।
চিকিৎসাপদ্ধতি সম্পর্কে সহজ ভাষায় তিনি বললেন, হার্টের চারটি চেম্বার রয়েছে। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ চেম্বার হলো বাম নিলয়। এ রোগে বাম নিলয়ের মাংসপেশি মোটা হয়ে যায়। মূলত বাম ও ডান—এই দুই নিলয়ের মাঝে অবস্থিত পার্টিশন বা দেয়াল এবং এই মোটা মাংসপেশি শরীরে রক্ত চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে। মারাত্মক অনিয়মিত হৃৎস্পন্দন তৈরি করে। বুক না কেটে ইন্টারভেনশনাল চিকিৎসা পদ্ধতিতে (Alcohol Septal Ablation) ক্যাথেটার সিস্টেমের মাধ্যমে হার্টে ১০০ শতাংশ অ্যালকোহল দিয়ে ওই মোটা মাংসপেশিতে ‘নিয়ন্ত্রিত হার্ট অ্যাটাক’ ঘটানো হয়। এই হার্ট অ্যাটাক ঘটিয়ে ওই মোটা মাংসপেশিকে পাতলা করা হয়। মাংসপেশি পাতলা হয়ে গেলে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক হয় এবং রোগীর সমস্যা কমে যায়।
ইসিজি এবং ইকোকার্ডিওগ্রাফিতে সহজেই এই মাংসপেশি মোটা হওয়ার আলামত পাওয়া যায় উল্লেখ করে প্রদীপ কুমার কর্মকার প্রথম আলোকে বলেন, এখন পর্যন্ত এ হাসপাতালেই সরকারিভাবে কম খরচে সুনির্দিষ্ট জায়গায় নিয়ন্ত্রিত হার্ট অ্যাটাক ঘটিয়ে হার্টের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এ পর্যন্ত সফলতা শতভাগ। ১২ বছর বয়সী এক শিশুও ভর্তি হয়েছে হাসপাতালটিতে। এ রোগ সাধারণত প্রতি ৫০০ জনে ১ জনের হয়। তাই বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠী এ ধরনের রোগে ভুগছেন। তবে এখনো অনেকেই জানেন না, এ রোগের চিকিৎসা কোথায় পাওয়া যাবে।
রোগটি বংশগত। তাই এ রোগে যিনি আক্রান্ত হন, তাঁর ছেলেমেয়ে, ভাইবোনেরাও এই রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। প্রদীপ কুমার কর্মকার জানান, ইকোকার্ডিওগ্রাফি পরীক্ষার মাধ্যমে রোগীর পরিবারের সদস্যদেরও শনাক্তকরণের আওতায় আনা হচ্ছে। এতে স্ক্রিনিংটা হয়ে যাচ্ছে।
প্রদীপ কুমার কর্মকার বলেন, বুক কেটে অস্ত্রোপচারে পাঁচ থেকে সাত লাখ টাকা লেগে যায়। আর বুক না কেটে অস্ত্রোপচারে এ হাসপাতালে রোগীর সবকিছু মিলে খরচ হচ্ছে ৫০ হাজার বা তার চেয়ে একটু বেশি। ২০ থেকে ৩০ মিনিটের মধ্যে অস্ত্রোপচার শেষ হয়। রোগীকে ২৪ ঘণ্টা নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রাখা হয়।
আসলেই বুক না কেটে অস্ত্রোপচার করা হয়েছে কি না, জানতে চাইলে একগাল হেসে শার্টের বোতাম খুলে নিজের বুকের অংশ দেখালেন নাজমুল হক মোল্লা। খরচ প্রসঙ্গে জানালেন, তাঁর এ পর্যন্ত ৪৬ হাজার টাকা খরচ হয়েছে।
তবে নাজমুল হক মোল্লার হাইপারট্রপিক অবসট্রাকটিভ কার্ডিওমায়োপ্যাথি চিকিৎসার পাশাপাশি পেসমেকার বসাতে হয়েছে বলে বুকের একটি অংশে একটু জায়গা কাটা হয়েছে এবং সেই চিকিৎসায় খরচ একটু বেশি।
প্রদীপ কুমার কর্মকার জানান, তিনি ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসে তাঁর দলের চিকিৎসক ফারহানা আহমেদ, পিনাকী রঞ্জন দাস, মো. আরিফ হোসেন, মো. হোসনি আমিন, মো. সাইদুর রহমান, বাদল চন্দ্র বর্মণ ও মো. নাজমুল হক ভূঁইয়াকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।
চিকিৎসকেরা জানান, আপাতত এ চিকিৎসায় যা প্রয়োজন, তা জাতীয় হৃদ্রোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে আছে। রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার মতো সক্ষমতাও তৈরি হয়েছে।