নিরঙ্কুশ ক্ষমতা নিরঙ্কুশভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়েছে ১৫ বছরে

গণমাধ্যম, বিশেষ করে নাগরিকের কণ্ঠস্বর যাতে কখনোই রুদ্ধ না হয়, তা নিশ্চিত করার বিষয়টি আলোচনায় এসেছে।

(ওপরে বাঁ থেকে) সিপিডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রওনক জাহান। (নিচে বাঁ থেকে) নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার ও অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ

আওয়ামী লীগ সরকারের বিগত ১৫ বছরের শাসনব্যবস্থা নিয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, নিরঙ্কুশ ক্ষমতা নিরঙ্কুশভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়েছে। যখন কেউ এত বছর ক্ষমতায় থাকেন, তখন তা নিরঙ্কুশ ক্ষমতার প্রদর্শন। ক্ষমতা এক ব্যক্তির ওপর কেন্দ্রীভূত ছিল।

‘রাষ্ট্র সংস্কার ও সংবিধান সংশোধনী’ বিষয়ে ভার্চ্যুয়াল এক আলোচনা অনুষ্ঠানে গত ১৫ বছরের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকাঠোমো সম্পর্কে নিজের মূল্যায়ন তুলে ধরেন অধ্যাপক রেহমান সোবহান। গত শনিবার রাতে ভার্চ্যুয়াল ওই আলোচনার আয়োজন করে সমাজ গবেষণা কেন্দ্র।

যখন কেউ এত বছর ক্ষমতায় থাকেন, তখন তা নিরঙ্কুশ ক্ষমতার প্রদর্শন। ক্ষমতা এক ব্যক্তির ওপর কেন্দ্রীভূত ছিল।
অধ্যাপক রেহমান সোবহান চেয়ারম্যান, সিপিডি

২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট পর্যন্ত দেশে নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী ছিল আওয়ামী লীগ। ২০০৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ের (৩০০ আসনের মধ্যে দুই–তৃতীয়াংশের বেশি) পর গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় আরও তিনটি জাতীয় নির্বাচন হয়। এর মধ্যে একটি নির্বাচন হয়েছে বিনা ভোটে (২০১৪ সালের জানুয়ারিতে), একটি রাতের ভোটে (২০১৮ সালের ডিসেম্বরে) এবং সর্বশেষ ২০২৪ সালের জানুয়ারির নির্বাচন ‘ডামি নির্বাচন’ হিসেবে পরিচিতি পায়। প্রতিবারই নিরঙ্কুশ বিজয় পায় আওয়ামী লীগ।

অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, বাস্তবতা হচ্ছে সরকারপ্রধান নিরঙ্কুশ ক্ষমতার চর্চা করেন, তা প্রধানমন্ত্রী হোন বা রাষ্ট্রপতি হোন। দেশে সবচেয়ে ক্ষমতাশালী প্রতিষ্ঠান হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় (কার্যালয়)। সব মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রীদের প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের অধীন হওয়ার প্রবণতা দেখা গেছে। কেউ সচেতনভাবে এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দায়িত্ববোধের ঘাটতির কারণে মন্ত্রী ও তাঁদের আশপাশে থাকা লোকেরা স্বেচ্ছায় কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের (প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়) কাছে আত্মসমর্পণ করেন। এ প্রক্রিয়া ৫৩ বছর ধরে চলছে।

দেশকে গণতান্ত্রিক করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতন্ত্র আনতে হবে। তা না হলে কখনোই গণতান্ত্রিক হওয়া যাবে না।
রওনক জাহান, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী

আদালত থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার যে আশা নাগরিকেরা করে থাকেন, তা সেভাবে ছিল না বলে মনে করেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান। তাঁর মতে, রাজনৈতিক কর্তৃত্ব বহাল রাখার জন্য আদালত হয়ে উঠেছিল প্রাথমিক হাতিয়ার। এমন প্রেক্ষাপটে স্বাধীন বিচার বিভাগ নিশ্চিত করা চ্যালেঞ্জিং।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সংস্কারের উদ্যোগ প্রসঙ্গে অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, যে সংস্কারই করা হোক না কেন, তার ফলাফল নির্ভর করবে বাস্তবায়নের ওপর। শেষ পর্যন্ত সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করবে রাজনৈতিক দল, যারা পরবর্তী নির্বাচনে ক্ষমতায় আসবে।

অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রওনক জাহান বলেন, কাঠামো ও নতুন আইনের দিকে এখন যতটা মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি মনোযোগ দেওয়া দরকার গত ৫০ বছরে যেসব অগণতান্ত্রিক চর্চা হয়েছে, প্রথা চালু করা হয়েছে, সেগুলোকে কী করে পরিবর্তন করা যায়। দেশকে গণতান্ত্রিক করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতন্ত্র আনতে হবে। তা না হলে কখনোই গণতান্ত্রিক হওয়া যাবে না। তিনি বলেন, শুধু কিছু বিধান দিয়ে, বাধ্যবাধকতা দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে গণতান্ত্রিক করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে প্রধান যে দায়িত্ব, সেটা রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের নিতে হবে।

যদি রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন না ঘটে এবং রাজনীতিবিদদের মধ্যে ঐকমত্য সৃষ্টি না হয়, তাহলে সংস্কার টেকসই হবে না।
বদিউল আলম মজুমদার, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান

রওনক জাহানের মতে, স্বৈরশাসনকে ঠেকাতে সবচেয়ে বেশি কার্যকর পন্থা হবে আনুপাতিক নির্বাচন। এই পদ্ধতিতে কী সুবিধা এবং এই পদ্ধতি চালু করার জন্য জনমত গড়ে তোলার কাজটি করতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোকে। এই পদ্ধতি প্রবর্তনের পাশাপাশি স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করতে হবে।

সংস্কার শুধু একটা রিপোর্ট লিখে বা আইন করেই হবে তা নয়, বরং এর বাস্তবায়ন এবং টেকসই করতে যে অঙ্গীকার দরকার তার ওপর বেশি গুরুত্ব দিতে চান রওনক জাহান। পাশাপাশি গণমাধ্যম, বিশেষ করে নাগরিকের কণ্ঠস্বর যাতে কখনোই রুদ্ধ না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

রাষ্ট্র সংস্কারে ১১ প্রস্তাব

আলোচনায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন এশীয় প্রবৃদ্ধি গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক নজরুল ইসলাম। তিনি প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা, সরকারের মেয়াদ হ্রাস (পাঁচ বছর থেকে চার বছর), সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ বিলোপ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন, স্থানীয় সরকারব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ, প্রাদেশিক সরকারব্যবস্থা চালু, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ, নির্বাচন কমিশন শক্তিশালীকরণ ও আনুপাতিক নির্বাচনব্যবস্থা প্রবর্তনসহ রাষ্ট্র সংস্কারে ১১টি প্রস্তাব নিয়ে প্রবন্ধে আলোচনা করেন।

প্রবন্ধে বলা হয়, বিশ্বের প্রায় ৭০ শতাংশ দেশ আনুপাতিক নির্বাচনব্যবস্থা অনুসরণ করে। এই নির্বাচনব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের আগে ক্রম অধিকারসম্পন্ন প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করে। এরপর দেশব্যাপী যে রাজনৈতিক দল যত শতাংশ ভোট পায়, সংসদে তত শতাংশ আসন পায়।

অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, রাষ্ট্র সংস্কারের বহু প্রস্তাব-আলোচনা হতে পারে। কিন্তু আনুপাতিক নির্বাচনটা হচ্ছে সবচেয়ে কার্যকর। এটা করলে অনেক সমস্যার সমাধান হবে, সেদিকে নজর দেওয়া দরকার। রাষ্ট্র সংস্কারের যেসব প্রস্তাব সাধারণভাবে আলোচিত হচ্ছে, সংবিধানের মৌলিক পরিবর্তন ছাড়াই তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব। সংবিধানের নবলিখন ও পুনর্লিখন নিয়ে কথা হচ্ছে। এটা করতে হলে দীর্ঘ আলোচনা দরকার হবে এবং যে রাজনৈতিক শক্তিগুলো আছে, তাদের সম্পৃক্ত করে আলোচনা করতে হবে।

গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া কতটা শক্তিশালী হচ্ছে, তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া থাকলে নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী হলেই চলে।
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির সদস্য

রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন দরকার

আলোচনায় নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার বলেন, যদি রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন না ঘটে এবং রাজনীতিবিদদের মধ্যে ঐকমত্য সৃষ্টি না হয়, তাহলে সংস্কার টেকসই হবে না। রাজনীতিবিদেরা অতীতে অনেক অঙ্গীকার করেছেন, পরে কথা রাখেননি। রাজনীতিবিদেরা যদি কথা না রাখেন, তাঁদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি যদি পরিবর্তন না হয় এবং তাঁদের মধ্যে কতগুলো মৌলিক বিষয়ে যদি ঐকমত্য না হয়, তাহলে সংস্কার টেকসই হবে না।

সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনের বিষয়টি গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে বলে মনে করেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। তিনি বলেন, অনেক রাজনৈতিক দল এ বিষয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছে। বড় দলগুলো এর বিরোধিতা করার যুক্তি পাবে না, যদি সমাজে জনমত তৈরি হয়।

গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির সদস্য অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া কতটা শক্তিশালী হচ্ছে, তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া থাকলে নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী হলেই চলে। তাহলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দরকার হয় না।

এই আলোচনা অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সমাজ গবেষণা কেন্দ্রের সভাপতি তাজুল ইসলাম। আলোচনার শুরুতে তিনি বলেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বিগত সরকারের পতন হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এসেছে। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। তার মধ্যে একটা প্রধান বিষয় হলো রাষ্ট্র সংস্কার। সাধারণ মানুষ আশা করে সংস্কারের মাধ্যমে একটা নতুন ধরনের কিছু বাংলাদেশে আসবে, যাতে ভবিষ্যতে আর কোনো স্বৈরাচার তৈরি না হয়।

সরকারের মেয়াদ হ্রাস করে চার বছর করা যেতে পারে বলে মনে করেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। তাঁর মতে, জনগণের ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা শক্তিশালী করা দরকার। জাতীয় বাজেটের ৩০-৪০ শতাংশ স্বয়ংক্রিয়ভাবে স্থানীয় সরকারে যাতে যায়, সে জন্য আইন করার পরামর্শ দেন তিনি।

অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন ও বাসদের সহকারী সম্পাদক রাজেকুজ্জামান।

অনুষ্ঠানের সঞ্চালক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনৈতিক গবেষণা ব্যুরোর চেয়ারম্যান এম এম আকাশ। তিনি বলেন, মানুষ স্বৈরাচারের পুনরাবৃত্তি রোধ করতে চায়। বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে যেতে চায়।