ফারদিনের মৃত্যু নিয়ে ‘সব প্রশ্নের জবাব পেয়েছেন’ বুয়েট শিক্ষার্থীরা

আজ শনিবার সন্ধ্যায় বুয়েট ক্যাম্পাসের শহীদ মিনারের পাশে দাঁড়িয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন শিক্ষার্থীরা
ছবি: প্রথম আলো

গোয়েন্দা পুলিশ ও র‌্যাব কর্মকর্তাদের সঙ্গে দুই দফা বৈঠকের পর বুয়েট শিক্ষার্থীরা বলেছেন, তাঁদের সহপাঠী ফারদিন নূরের মৃত্যু নিয়ে তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে তাঁদের সব সন্দেহ দূর হয়েছে।

আজ শনিবার সন্ধ্যায় বুয়েট ক্যাম্পাসের শহীদ মিনারের পাশে দাঁড়িয়ে সাংবাদিকদের এ কথা বলেন শিক্ষার্থীরা। তাঁরা বলেন, ফারদিনের লাশ উদ্ধারের পর থেকে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের দাবি নিয়ে তাঁরা বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছিলেন। ডিবি ও র‌্যাব থেকে ব্যাখ্যা পাওয়ার পর নতুন আর কোনো কর্মসূচিতে যাচ্ছেন না। তবে ফারদিনের পরিবারের যেকোনো যৌক্তিক দাবির পক্ষে তাঁরা থাকবেন।

গত ৭ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদী থেকে ফারদিন নূরের লাশ উদ্ধার হয়। তিনি হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন বলে প্রাথমিক ধারণার কথা জানিয়েছিলেন ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক। এরপর এটিকে হত্যাকাণ্ড ধরে মামলার তদন্ত এগোলেও সম্প্রতি তদন্ত সংস্থা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, ফারদিন নূর আত্মহত্যা করেছিলেন। এ ঘটনার ছায়া তদন্ত করা র‌্যাবের পক্ষ থেকেও একই কথা বলা হয়। দাবির পক্ষে যুক্তি হিসেবে রাতের আঁধারে ডেমরার সুলতানা কামাল সেতু থেকে একজনের নদীতে ঝাঁপ দেওয়ার একটি ভিডিও হাজির করেছিল তাঁরা।

তবে তাঁদের এই বক্তব্য মেনে নেয়নি ফারদিনের পরিবার। ফারদিন ‘হত্যাকাণ্ডের’ বিচার দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে আসা বুয়েট শিক্ষার্থীরাও ডিবি–র‌্যাবের বক্তব্য নিয়ে কয়েকটি বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন। এই প্রেক্ষাপটে গত বৃহস্পতিবার শিক্ষার্থীদের একটি দল ডিবি কার্যালয়ে যান। সেখানে প্রায় তিন ঘণ্টা ডিবি কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনার পর শিক্ষার্থীরা সাংবাদিকদের বলেন, ডিবির তদন্তের প্রচেষ্টায় তাঁরা সন্তুষ্ট। তবে কিছু গ্যাপ রয়েছে, যেগুলো স্পষ্ট করতে হবে। এরপর গতকাল শুক্রবার শিক্ষার্থীদের র‌্যাবের সদর দপ্তরে ডেকে নেওয়া হয়। সেখানেও প্রায় তিন ঘণ্টা বৈঠক করেন তাঁরা। এই শিক্ষার্থীরা আজ বুয়েট ক্যাম্পাসে এসে অপর শিক্ষার্থীদের কাছে বিষয়গুলো তুলে ধরেন। এরপর সংবাদ সম্মেলন করে নিজেদের অবস্থান জানান শিক্ষার্থীরা।

সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষার্থীরা জানান, তদন্তকারীরা ফারদিনের আত্মহত্যার কথা বলার পর তাঁদের মনে পাঁচটি প্রশ্ন জেগেছিল। ডিবি ও র‌্যাবের কাছে সেসব বিষয়ে জানতে চেয়েছিলেন তাঁরা। দুটি সংস্থাই তথ্যপ্রমাণ দিয়ে তাঁদের সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে। এখন সন্দেহ করার মতো আর কোনো বিষয় নেই।

শিক্ষার্থীরা বলেন, তাঁরা ডিবি ও র‌্যাব কর্মকর্তাদের বলেছিলেন, ফারদিনের আত্মহত্যা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। অন্য সবার মতো তাঁদের মনেও সন্দেহ ছিল। পরে ডিবি থেকে ডেকে নিয়ে তাঁদের সেই সন্দেহের বিষয়ে সরাসরি প্রশ্ন করার সুযোগ দেওয়া হয়।

ফারদিন নূর

শিক্ষার্থীরা ডিবি ও র‍্যাবের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, ময়নাতদন্তের পর চিকিৎসক বলেছিলেন ফারদিনের শরীরে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। তাহলে এখন কীভাবে আত্মহত্যা হলো? পরবর্তী সময়ে র‍্যাব ও গোয়েন্দা পুলিশ ওই ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে জানিয়েছে, ফারদিনের শরীরে থাকা আঘাতগুলো অনেকটা কিলঘুষির মতো। কাটা চিহ্ন ছিল না। বেশির ভাগ আঘাতের জায়গায় রক্ত জমা ছিল। এটা সেতু থেকে লাফ দেওয়া কিংবা পানির আঘাত ও স্প্যানের আঘাত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই চিকিৎসক বলেছেন, এই আঘাতের ভিত্তিতে বলা সম্ভব না যে এটা হত্যা না কি আত্মহত্যা।

শিক্ষার্থীরা আরও জানতে চেয়েছিলেন, যে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখিয়ে বলা হয়েছে ফারদিন সেতু থেকে লাফ দিয়েছেন। এর সত্যতা কোথায়? জবাবে বলা হয়েছে, ফারদিনের মুঠোফোনের শেষ অবস্থান দেখা গেছে যাত্রাবাড়ী থেকে একটি লেগুনায় উঠেছেন। সেই লেগুনা তাঁকে সুলতানা কামাল সেতুর তারাব প্রান্তে নামিয়ে দেয়। সেই লেগুনাচালককে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এ ছাড়া চালকের মোবাইলের লোকেশন ও ফারদিনের ইন্টারনেট ব্রাউজিং লোকেশন ভেরিফাই করা হয়েছে। এর মাধ্যমে তাঁরা নিশ্চিত হয়েছেন। তদন্তকারীরা বলেছেন, ফারদিন বিভিন্ন ওয়েবসাইট ব্রাউজ করছিলেন। এটা করতে করতে তিনি সেতুর মাঝামাঝি চলে আসেন। পরবর্তী সময়ে যে স্থান থেকে লাফ দেন, সেখানে তার মোবাইলের লোকেশন পাওয়া যায়। তাই তদন্তকারীদের ধারণা, এই একই সময়ে অন্য ব্যক্তির লাফ দেওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এ ছাড়া তাঁরা আরও দেখেছেন, ওই সময়ের পরপরই ফারদিনের মোবাইল ও ঘড়ি ওই জায়গায় বন্ধ হয়ে যায়। তাই তাঁদের ধারণা, এটা ফারদিনই ছিলেন।

শিক্ষার্থীরা জানতে চেয়েছিলেন, ফারদিন যেসব স্থানে ঘুরে বেড়িয়েছেন বলে বলা হচ্ছে, তার সঠিক প্রমাণ আছে কি না? এর ব্যাখ্যায় ডিবি ও র‌্যাব কর্মকর্তারা বলেছেন, ফারদিন রাত ১১টার দিকে বুয়েটের এক সহপাঠীর সঙ্গে দীর্ঘ সময় ধরে কথা বলেছেন। ওই সময় ফারদিন স্বাভাবিক ছিলেন। তিনি স্পেন যাওয়া নিয়ে আলোচনা করেছেন। রাত ১টা ৫৭ মিনিটে ফেসবুকের মেসেঞ্জারে এক বন্ধুর সঙ্গে কথা বলেন। সেই সময়েও তাঁকে স্বাভাবিক মনে হয়েছে।

শিক্ষার্থীরা জানতে চেয়েছিলেন, লেগুনাচালক কত দিন আগে ফারদিনকে কোথাও নামিয়ে দিয়েছেন, এটা তিনি কীভাবে মনে রেখেছেন? এর ব্যাখ্যায় ডিবি ও র‌্যাবের কর্মকর্তারা বলেছেন, এ বিষয়ে লেগুনাচালক বলেছেন, যাত্রাবাড়ী থেকে সুলতানা কামাল সেতুর তারাবো এলাকায় অল্প দূরত্বে দুজনকে নামিয়েছিলেন। ফারদিনের মোবাইলের লোকেশন অনুযায়ী দুই স্থানের কোনো একটিতে নেমেছেন বলে পুলিশের ধারণা। আর লেগুনাচালকের দেওয়া তথ্যের সঙ্গে ফারদিনের মোবাইলের তথ্য মিলেছে।

সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষার্থীরা জানান, মাদক, চনপাড়া বস্তি, রায়হান গ্যাংসহ কয়েকটি বিষয় আলোচনায় এসেছে। এসব প্রশ্নের যৌক্তিক উত্তর পাওয়ার দরকার ছিল। এই তথ্যগুলো যেহেতু র‍্যাবের বরাত দিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে এসেছে, তাই এর জবাব র‍্যাবের কাছে জানতে চেয়েছিলেন। জবাবে র‍্যাব কর্মকর্তারা বলেছেন, তাঁরা যখন প্রথম তদন্ত শুরু করেন, তখন তিনটি প্রশ্ন সামনে রেখে কাজ শুরু করেন। এটা পরিকল্পিত হত্যা, দুর্ঘটনা কি না এবং আত্মহত্যা কি না। তদন্তের শুরুতে তাঁরা ফারদিনের রবি নম্বরের নেটওয়ার্ক ধরে কাজ শুরু করেন। ওই নম্বর অনুযায়ী ফারদিনের সর্বশেষ অবস্থান তারাবো ও চনপাড়া বস্তি এলাকায় দেখা যায়। চনপাড়া বস্তি অপরাধপ্রবণ এলাকা হওয়ায় র‍্যাব সেই বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত শুরু করে। চনপাড়ার বেশ কয়েকজনের কাছ থেকে ফারদিনকে হত্যা করা হয়েছে বলেও তথ্য পাওয়া গিয়েছিল। তবে পরবর্তী সময়ে সে তথ্য যাচাই-বাছাই করে মিল পাওয়া যায়নি। এরপরে তাঁরা সুলতানা কামাল সেতুর দিকে নজর দেন। আর ফারদিনকে গাড়িতে তোলা বা তাঁর সিএনজি অটোরিকশায় ওঠার বিষয়টি র‍্যাব জানত না। সিএনজি অটোরিকশায় ওঠার ফুটেজ তাঁদের কাছে আসেনি। এটা ভুল হওয়ার কারণ হলো ফারদিনের শরীরে ছিল শার্ট, কিন্তু সিএনজিতে ওঠা তরুণের গায়ে ছিল কালো গেঞ্জি। তাছাড়া সিএনজি অটোরিকশার সঙ্গে ফারদিনের মুঠোফোনে লোকেশনের মিল পাওয়া যায়নি।