বিভাগীয় চ্যাম্পিয়ন হয়ে খুদে দাবাড়ুরা যখন কক্সবাজার জেলার সীমারেখায় প্রবেশ করেন, তখন থেকেই তাঁরা টের পাচ্ছিলেন তাঁদের বরণ করার জন্য আলাদা কিছু অপেক্ষা করছে। চ্যাম্পিয়ন দলকে বহনকারী গাড়িটি যতই গন্তব্যের কাছাকাছি যাচ্ছে, ততই রাস্তার দুই পাশে মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকে। উচ্ছ্বাস–আনন্দ সবার চোখেমুখে। ভালোবাসা ও ফুলের পাপড়িতে চ্যাম্পিয়ন দলকে বরণ করে নেয় সৈকতের নগরী কক্সবাজার। ‘মার্কস অ্যাক্টিভ স্কুল চেস চ্যাম্পস’ প্রতিযোগিতায় চট্টগ্রাম বিভাগীয় চ্যাম্পিয়ন হয়ে এমন রাজকীয় অভ্যর্থনা ও বুকভরা ভালোবাসা পেয়ে নিজ এলাকায় ফেরে মহেশখালীর হোয়ানক আদর্শ বিদ্যাপীঠের দাবাড়ুরা।
গত ১৬ নভেম্বর চট্টগ্রামের এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে ‘মার্কস অ্যাক্টিভ স্কুল চেস চ্যাম্পসে’র চট্টগ্রাম বিভাগীয় পর্যায়ের খেলা অনুষ্ঠিত হয়। চট্টগ্রামের নাসিরাবাদ সরকারি উচ্চবিদ্যালয়কে হারিয়ে প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয় কক্সবাজারের মহেশখালীর হোয়ানক আদর্শ বিদ্যাপীঠের দাবা দল।
চ্যাম্পিয়ন দলের সদস্য দশম শ্রেণিপড়ুয়া মো. সাকের উল্লাহ। তারা ৯ ভাই। সবাই কমবেশি দাবা খেলায় দক্ষ। দাবা খেলা শুরুর অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে সাকের উল্লাহ বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই দাবা আমার খুব ভালো লাগত। যেখানেই অন্যদের দাবা খেলতে দেখতাম, দাঁড়িয়ে যেতাম। এমনো হয়েছে, দাবা খেলা দেখতে দেখতে স্কুলের সময় পার হয়ে গেছে। প্রাথমিকভাবে কেউ হাত ধরে দাবা খেলা শেখায়নি আমাকে।
দেখতে দেখতে এবং নিজেই চর্চা করতে করতে খেলা শিখে গেছি। আমার বড় ভাই আর কাকা খুব ভালো দাবা খেলতেন। তাঁরা দুজন অবসর পেলেই দাবার বোর্ড নিয়ে বসে যেতেন। একদিন কাকা বোর্ড আর ঘুঁটি নিয়ে বসে আছেন কিন্তু সহখেলোয়াড় বড় ভাইয়ের দেখা নেই। তখন কাকা জানতে চাইলেন আমি খেলব কি না? সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলাম। কাকাও খেলার পার্টনার পেয়ে খুশি।’
আত্মবিশ্বাসী সাকের উল্লাহ জানায়, ‘সবচেয়ে আনন্দের বিষয়, কাকাকে প্রথম খেলাতেই আমি হারিয়ে দিই। কাকা ভীষণ অবাক হয়েছিলেন। জানতে চাইলেন, এত ভালো দাবা খেলা আমি শিখলাম কীভাবে? যখন জানতে পারলেন অন্যদের খেলা দেখতে দেখতেই শিখেছি—তখন কাকা হেরে গিয়েও খুশি! পরবর্তী সময়ে আমি দাবা খেলার জন্য এলাকায় কোনো খেলোয়াড় পেতাম না। কারণ, আমার সঙ্গে যে–ই খেলত, হেরে যেত। তাই বড়রাও আমাকে দাবা খেলায় নিতেন না।’
কিন্তু যার মগজে মিশে আছে সাদা–কালো ঘুঁটির দুর্দান্ত সব চাল, সে কি থেমে থাকবে? থেমে থাকেননি সাকেরও। এক শুভাকাঙ্ক্ষীর পরামর্শে সাকের সরাসরি চলে যান স্থানীয় সংসদ সদস্যের ছেলে অধ্যক্ষ সরোয়ার কামালের অফিসে। জানান নিজের দাবা খেলার প্রতি আগ্রহের কথা। সাকেরের আগ্রহ ও সাহস দেখে খুবই খুশি হন সরোয়ার কামাল। উৎসাহ দিতে নিজেই বসে যান সাকেরের সঙ্গে দাবা খেলতে।
দাবা নিয়ে এ রকম নানা অনুপ্রেরণার গল্প আছে সাকেরের। আছে সাফল্যও। সাকের উল্লাহর সাফল্য পেরিয়ে গেছে দেশের গণ্ডি। মালদ্বীপে অনুষ্ঠেয় একটি দাবা প্রতিযোগিতায় দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করছেন তিনি। সমুদ্রপাড় জেলা কক্সবাজারকে এবার দেশসেরার খেতাব এনে দেওয়ার লক্ষ্যেই অনুশীলন চালিয়ে যাচ্ছে সাকের।
হোয়ানক আদর্শ বিদ্যাপীঠের চ্যাম্পিয়ন দাবা দলের বাকি সদস্যরা হলেন দশম শ্রেণিপড়ুয়া গিয়াস উদ্দিন, মো. ফারাজ উদ্দিন, মো. রাসেল, আলাউদ্দিন এবং নবম শ্রেণিপড়ুয়া মো. মহিন উদ্দিন। এদের মধ্যে গিয়াস উদ্দিন দুই বছর ধরে দাবা খেলা শুরু করেছে। নিয়মিত অনুশীলনের মাধ্যমে নিজেকে আরও দক্ষ করে তুলতে চায় সে।
তবে মহিন উদ্দিনের অনুভূতিটা অন্য রকম। সে বলে, ‘জীবনে প্রথম কোনো দাবা টুর্নামেন্টে অংশ নিয়েই চ্যাম্পিয়ন হয়েছি—এ আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।’
একই ক্লাসে পড়ার কারণে মো. ফারাজ উদ্দিন, মো. রাসেল ও আলিউদ্দিনের মধ্যে ভালো বন্ধুত্ব। দাবা খেলা নিয়ে নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়াটাও চমৎকার। ক্লাসের ফাঁকে সময় পেলেই নিজেরা বসে যায় দাবার বোর্ড আর ঘুঁটি নিয়ে। ঝালিয়ে নেয় নিজ নিজ মেধা। ধৈর্য, একাগ্রতা আর নিষ্ঠার মাধ্যমে তৈরি করছে সেরা দাবাড়ু হওয়ার পথ।
মহেশখালীর চ্যাম্পিয়ন দলের এই ছয় খুদে দাবাড়ুই বড় হচ্ছে সমুদ্রের বিশালতা দেখতে দেখতে। এই বিশালতা বুকে ধারণ করে দাবা খেলার মাধ্যমে নিজ জেলার নাম উজ্জ্বল করতে চায়। জিতে নিতে চায় বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশনের তত্ত্বাবধানে এবং আবুল খায়ের গ্রুপের পৃষ্ঠপোষকতায় আয়োজিত ‘মার্কস অ্যাক্টিভ স্কুল চেস চ্যাম্পস’–এর জাতীয় পর্যায়ের চ্যাম্পিয়ন ট্রফি। তবে লক্ষ্যটি পূরণে বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হবে খুদে এ দাবাড়ুদের। সেই চেষ্টা আর আত্মবিশ্বাস নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছে তারা।