শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-বাড়িতে মারধর, চুল টানা, কান মলাসহ শিশুদের শাস্তি বন্ধ নেই

গত বছর শিশু নির্যাতন বিষয়ে সহায়তা চেয়ে ১৫ হাজার ৭৮৫টি কল এসেছে, যা ২০২২ সালের তুলনায় দ্বিগুণ।

শ্রেণিকক্ষে দুষ্টুমি করায় ১২ বছরের এক শিশুকে বেত দিয়ে পিটিয়ে আহত করেন শিক্ষক। পেটানোর সময় শিক্ষকের নির্দেশে দুই ছাত্র শিশুটির হাত-পা চেপে রাখে।

কেন মারা হয়েছে জানতে অভিভাবকেরা এলে শিশুটির বাবাসহ চারজনকে একটি কক্ষে আটকে রেখে মারধর করেন এলাকাবাসী। জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ নম্বরে কল পেয়ে পুলিশ তাঁদের উদ্ধার করে। শিক্ষককে গ্রেপ্তার করা হয়।

ঘটনাটি ঘটে গত ৪ ফেব্রুয়ারি, মাদারীপুরের ডাসার উপজেলার একটি মাদ্রাসায়। ঘটনাটি সম্পর্কে ডাসার থানার ওসি এস এম শফিকুল ইসলাম গত শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, প্রাথমিক তদন্তে শিশুশিক্ষার্থীকে মারধরের সত্যতা পাওয়া যায়। শিক্ষককে গ্রেপ্তার করা হয়। শিশু আইন ২০১৩-এর ৭০ ধারায় মামলা হয়। পরে শিক্ষার্থীর পরিবার শিক্ষকের সঙ্গে আপস করে। শিক্ষক জামিন পান। তিনি চাকরিতেও বহাল আছেন।

দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি দেওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে একটি পরিপত্র জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিন্তু শাস্তি বন্ধ হয়নি।

অভিভাবকেরা বলছেন, অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বেত বা স্কেল দিয়ে শিক্ষার্থীদের মারার ঘটনা কম। তবে বাড়ির কাজ না আনা, লিখতে-পড়তে ভুল করা, দুষ্টুমি করার মতো কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশুকে দাঁড় করিয়ে রাখা, চুল টানা, কান মলা, সহপাঠীদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে পাঠদানে বিরত রাখা, বকাঝকার করার মতো শাস্তি অহরহ দেওয়া হয়। আবার কোনো কোনো অভিভাবক শিশুদের শাসন করার জন্য কিছু ‘মারধরের’ প্রয়োজন আছে বলেও মনে করেন।

গবেষক গওহার নঈম ওয়ারা প্রথম আলোকে বলেন, মাদ্রাসায় শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনাগুলো বেশি প্রকাশ পায়। তবে অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও শিশুদের শাস্তি দেওয়া হয়। দাঁড় করিয়ে রাখা, প্রধান শিক্ষকের কক্ষে নিয়ে আটকে রাখা, দেয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড় করিয়ে রাখার মতো ঘটনা ঘটে। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে এ ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা বন্ধ করা যাচ্ছে না।

এমন প্রেক্ষাপটে আজ ৩০ এপ্রিল পালন করা হয় শিশুদের শারীরিক শাস্তি বিলোপের আন্তর্জাতিক দিবস। শিশুদের প্রতি সব ধরনের নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলাই দিবসটির লক্ষ্য।

সমাজসেবা অধিদপ্তর পরিচালিত চাইল্ড হেল্পলাইন ১০৯৮-এর তথ্য অনুসারে, গত বছর শিশু নির্যাতন বিষয়ে সহায়তা চেয়ে ১৫ হাজার ৭৮৫টি কল এসেছে, যা ২০২২ সালের তুলনায় দ্বিগুণ।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-বাড়িতে শারীরিক শাস্তি

গত বছরের মে মাসে বেসরকারি বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সায়েন্সেস (বিইউএইচএস) প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ৮৮ শতাংশ শিশু কমপক্ষে একবার এবং ৫৫ শতাংশ শিশু একাধিকবার শারীরিক (মারধর, চড়, লাথি, চুল টানা, কান মলা, হাত মোচড়ানো), মানসিক (বকাঝকা, চিৎকার, গালি, অন্য শিশুর সঙ্গে তুলনা, অপমান) ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। পরিবারে ৫৮ শতাংশ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৫৬ শতাংশ, খেলার মাঠে ৬৫ শতাংশ শিশু শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়।

‘ভায়োলেন্স এগেইনস্ট চিলড্রেন অ্যান্ড ইটস অ্যাসোসিয়েটেড ফ্যাক্টরস ইন আরবান এরিয়া অব ঢাকা, বাংলাদেশ’ শিরোনামের গবেষণাটি হয় ২০১৯ সালে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আওতাধীন মিরপুরের দুটি ওয়ার্ডে করা এই গবেষণায় নিম্নবিত্ত পরিবারের ১০ থেকে ১৬ বছর বয়সী ৪০১টি শিশু অংশ নেয়।

বিইউএইচএসের গবেষণা অনুসারে, ১০ বছর বয়সের আগেই বেশির ভাগ শিশুর প্রথম নির্যাতনের অভিজ্ঞতা হয়। পরিবারের সদস্যরাই শিশুদের নির্যাতন করে বেশি। এই হার ৩৯। শিক্ষক, আগন্তুক, বন্ধু, প্রতিবেশী ও অন্যরা যথাক্রমে ১৭, ১৫, ১৩, ৫ ও ১১ শতাংশ নির্যাতন করে।

রাজধানীর একটি ভালো মানের স্কুলে শিক্ষার্থীর নির্যাতনের শিকার হওয়ার একটি ঘটনা উল্লেখ করে নাম প্রকাশ  না করার শর্তে এক অভিভাবক প্রথম আলোকে বলেন, স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া অনুষ্ঠানের জন্য শিক্ষকেরা ব্যস্ত ছিলেন। শিশুশিক্ষার্থীরা যেন শ্রেণিকক্ষে বিশৃঙ্খলা না করে, সে জন্য বড় ক্লাসের শিক্ষার্থীকে ‘মনিটর’ হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। দুষ্টুমি করার কারণে ‘মনিটর’ তাঁর সন্তানকে ২০ বার কান ধরে ওঠবস করায়। তাঁর ছেলে বাসায় এসে খুব কান্নাকাটি করে। সে আর স্কুলে যেতে চাইছিল না।

শিশুদের নিয়ে গবেষণায় নেতৃত্ব দেওয়া বিইউএইচএসের প্রজনন ও শিশুস্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান, অধ্যাপক বেগম রওশন আরা প্রথম আলোকে বলেন, যেকোনো ধরনের শাস্তি শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত করে। শিশু হতাশাগ্রস্ত হয়, পড়াশোনায় অমনোযোগী হয়ে পড়ে। ফলে শিশুর বিভিন্ন গ্যাংয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়ে মাদক গ্রহণ ও অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। এ ধরনের ঘটনা রোধে মাদ্রাসা, সাধারণ স্কুল, নামী স্কুল ও ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে পড়াশোনার মানে যে বৈষম্য আছে, তা দূর করতে নজরদারি বাড়াতে হবে। সমস্যা সমাধানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্ক্রিনিং কর্মসূচি রাখতে হবে। সন্তানকে সময় দিতে হবে মা–বাবার।

সামাজিক সচেতনতা দরকার

গবেষক গওহার নঈম ওয়ারা প্রথম আলোকে বলেন, এখনো অনেক শিক্ষক ও অভিভাবক বিশ্বাস করেন, ‘মাইরের ওপর ওষুধ নাই’। এই মনোভাব সামাজিক–সংস্কৃতির একদম গভীরে প্রোথিত। জনপ্রিয় অনেক নাটকে হামেশাই চড়থাপ্পড় দিতে দেখা যায়। এসব দেখে শিশুর সামনে মা-বাবা হেসে গড়াগড়ি খান। সহিংসতা দেখে মজা পাওয়ার এই প্রবণতা শিশুর মনের ওপর কী ধরনের দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, তা নিয়ে গবেষণা হওয়া দরকার। শিশুদের যেকোনো ধরনের শাস্তির বিরুদ্ধে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করা প্রয়োজন।