‘জলদস্যুরা জাহাজে উঠেই নাবিকদের খুঁজতে থাকে। একপর্যায়ে অস্ত্রের মুখে জাহাজের সব নাবিককে একটি কক্ষে জিম্মি করে ফেলে। হাত তুলে আমরা আত্মসমর্পণ করি। দস্যুদের সরদার প্রথমেই নাবিকের তালিকা নিল। এরপর ক্যাপ্টেনকে বলল, ওকে, গো টু সোমালিয়া। উদ্বেগ–আতঙ্কের মধ্যেই পরদিন ভারতীয় নৌবাহিনীর দুটি টহল জাহাজ দুই পাশে ঘেরাও করে। এমন সময় দস্যুরা নাবিকদের দিকে আবারও অস্ত্র তাক করে ক্যাপ্টেনকে নির্দেশ দেয়, দুই মিনিটের মধ্যে জাহাজ দুটিকে সরে যাওয়ার নির্দেশ দাও। না হলে হত্যার হুমকি দেয়। নৌবাহিনীর জাহাজকে নির্দেশনা দেওয়ার পর তারা চলে যায়। শুরু হয় বন্দিদশা।’
প্রায় ১৩ বছর আগে সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাতে জিম্মি হওয়ার এমন দুঃসহ ঘটনার কথা প্রথম আলোর কাছে তুলে ধরেছেন নাবিক মোহাম্মদ ইদ্রিস। ২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর এমভি জাহান মণিতে থাকা মোহাম্মদ ইদ্রিসসহ ২৬ জনকে জিম্মি করেছিল সোমালিয়ার জলদস্যুরা। কবির গ্রুপের মালিকানাধীন জাহাজটি ১০০ দিন পর সব নাবিকসহ উদ্ধার করা হয়েছিল।
গত মঙ্গলবার বেলা দেড়টায় একই কোম্পানির আরেকটি জাহাজ সোমালিয়ার জলদস্যুদের কবলে পড়ার পর ১৩ বছর আগের ঘটনাটি আবার আলোচনায় এসেছে। সে সময় ১০০ দিন জলদস্যুদের হাতে জিম্মি থাকার সময় কীভাবে কেটেছিল, কোন পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়েছে, তা নিয়ে কথা বলেছেন নাবিক মোহাম্মদ ইদ্রিস। আজ বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম নগরের আগ্রাবাদে সমুদ্র পরিবহন কার্যালয়ের সামনে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন তিনি।
২০১০ সালের ২১ নভেম্বর ইন্দোনেশিয়া থেকে আকরিক নিয়ে গ্রিসের পথে যাচ্ছিল এমভি জাহান মণি। ওই জাহাজে ২৫ জন নাবিক ও প্রধান প্রকৌশলীর স্ত্রী ছিলেন। পথে সিঙ্গাপুর থেকে জাহাজের জন্য খাবার ও জ্বালানি নেওয়া হয়। সিঙ্গাপুরে অবস্থানের সময় দেশে কন্যাসন্তান জন্মের খবর পান মোহাম্মদ ইদ্রিস। আনন্দে আত্মহারা ইদ্রিসের অপেক্ষা যেন শেষ হচ্ছিল না। কারণ, জাহাজটি গ্রিসে যাওয়ার আগে সুয়েজ খালে পৌঁছানোর পর তিনি নেমে যাবেন। চুক্তি শেষ হওয়ায় তিনিসহ তিনজন নেমে যাওয়ার কথা ছিল।
এ আনন্দ মিলিয়ে যেতে খুব বেশি দিন সময় লাগেনি। সিঙ্গাপুর থেকে ভারত মহাসাগর হয়ে গ্রিসের দিকে যাওয়ার পথে লাক্ষা দ্বীপের কাছে জলদস্যুদের কবলে পড়েন তাঁরা। সেদিন ছিল ২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর। ওই দিন বেলা তিনটায় মাছ ধরার জাহাজ থেকে ছোট্ট একটি নৌযান নামিয়ে প্রথমে চার জলদস্যু অস্ত্রসহ জাহাজে উঠে পড়ে। জাহাজে উঠেই নাবিকদের জিম্মি করে ফেলে। এভাবে ১০০ দিনের বন্দিদশা শুরু হয়।
দস্যুরা ১১ জন ছিল জানিয়ে মোহাম্মদ ইদ্রিস বলেন, ‘প্রথম দিন আমরা খুব ভয় পেয়ে যাই। পরদিনও ভারতীয় নৌবাহিনীর দুটি জাহাজ উদ্ধার করতে আসার পর আবারও হুমকি দিয়েছিল দস্যুরা। তারাও সরে গেল। অনিশ্চিত যাত্রা শুরু হয়। মনে হয়েছিল, আর কোনো দিন ফিরতে পারব না।’
ইদ্রিস জানান, সাড়ে তিন দিনের মাথায় জাহাজটি সোমালিয়ার উপকূলের কাছে পৌঁছে যায়। তখন আনুমানিক আরও ৩০ দস্যু জাহাজে উঠে পড়ে। জিম্মি করার পাঁচ দিন পর নাবিকদের স্যাটেলাইট ফোনে পরিবারের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ করে দেয় দস্যুরা। সুযোগ পেয়ে স্ত্রীকে ফোন করেন ইদ্রিস। খবর নেন সন্তানের। তার হৃদ্যন্ত্রে সমস্যার কথা জানতে পেরে মন খারাপ হয়।
সিঙ্গাপুর থেকে রসদ নেওয়ায় জাহাজে পর্যাপ্ত খাবার ছিল বলে জানান মোহাম্মদ ইদ্রিস। তিনি বলেন, ‘দস্যুরা খাবারে ভাগ বসানোর কারণে ধীরে ধীরে খাবার ফুরিয়ে যেতে থাকে। মাছ, মাংস শেষ হয়ে গেলে দস্যুরা সপ্তাহে দুটি দুম্বা নিয়ে আসত। একটি আমাদের দিত। আরেকটি তারা রান্না করে খেত।’
ইদ্রিস জানান, খাবারের মতো পানিও দ্রুত ফুরিয়ে যায়। পানি নেওয়ার ব্যবস্থা ছিল না। পানিসংকটের কারণে এক মাসের বেশি গোসল করেনিন। খুব জরুরি না হলে বিশুদ্ধ পানি ব্যবহার করতেন না কেউ। জ্বালানিও ফুরিয়ে যেতে থাকে। একপর্যায়ে শুধু জরুরি প্রয়োজনের সময় জেনারেটর চালু রাখা হতো।
মোহাম্মদ ইদ্রিস জানান, এভাবে প্রতিটি দিন অনিশ্চয়তায় কাটছিল। একপর্যায়ে দস্যুরা জানায়, জাহাজ কোম্পানির সঙ্গে আলোচনা চলছে। তাঁরা মুক্তি পাবেন। তখন কিছুটা আশার সঞ্চার হয়।
মুক্তির আগে কী ঘটেছিল জানতে চাইলে মোহাম্মদ ইদ্রিস প্রথম আলোকে বলেন, ‘দস্যুদের সঙ্গে যেদিন সমঝোতা হয়, তার পরদিন ভোর পাঁচটায় তারা নেমে যায়। এরপর জাহাজটি ওমানের সালালা বন্দর অভিমুখে রওনা হয়। দুটি টাগবোট এসে আমাদের পানি সরবরাহ করে। নতুন জীবন ফিরে পাওয়ার আনন্দে তখন আত্মহারা সবাই।’
মোহাম্মদ ইদ্রিস এখন তিন মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে চট্টগ্রামের হালিশহরে থাকেন। জাহান মণির ঘটনার পরও এখনো নাবিকজীবন ছাড়েননি। সর্বশেষ গত ১১ ফেব্রুয়ারি ৯ মাসের যাত্রা শেষ করে দেশে এসেছেন। তিনি বলেন, ‘জাহান মণির ঘটনায় জাহাজের মালিকপক্ষের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। অনেক ক্ষতি হলেও তারা নাবিকদের উদ্ধার করেছে। জিম্মিদশার সময় নাবিকদের পরিবারকে সহযোগিতা করেছে।’
এমভি জাহান মণি অপহরণের ১০০ দিন পর, ২০১১ সালের ১৩ মার্চ ভোরে জলদস্যুরা নাবিকদের মুক্তি দেয়। তবে মুক্তিপণের টাকা দেওয়া নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছিল। উড়োজাহাজ থেকে দুটি পানিরোধী ব্যাগ সাগরে ফেলা হয়েছিল বলে তখন আলোচনা হয়। তবে বিষয়টি সম্পর্কে মোহাম্মদ ইদ্রিস জানেন না বলে দাবি করেন।
গত মঙ্গলবার জলদস্যুদের কবলে পড়া এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের নাবিকদের বিষয়ে ইদ্রিস বলেন, জাহাজ যেহেতু জলদস্যুদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় গেছে, সে জন্য এখন সমঝোতা ছাড়া বিকল্প নেই। আগের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এবারও নিশ্চয়ই মালিকপক্ষ উদ্ধার করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে বলে তাঁর আশা।