প্রথম আলোর ২৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে কর্মীদের কাছে লেখা আহ্বান করা হয়েছিল। তাঁরা লিখেছেন প্রথম আলোকে নিয়েই। কর্মীদের নির্বাচিত কিছু লেখা নিয়েই এ আয়োজন
কয়দিন আগে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে গল্প হচ্ছিল। সাংবাদিকতার ছাত্র বলেই প্রথম আলো বিষয়ে তাঁদের কৌতূহলের শেষ নেই। নানান গল্পের ফাঁকে একজনের সরল প্রশ্ন-
-প্রথম আলোর কর্মীরা সচরাচর চাকরি ছেড়ে যান না বা ছাড়েন না, ম্যাজিকটা কী?
স্মিত হেসে বললাম, ‘এই প্রশ্নের উত্তর হবে কি না, জানি না। তার চেয়ে বরং একটি ঘটনা বলি।’
২০১৮ সালের আগস্ট মাস। দুই দিন হয় বড় মেয়ে প্রিয়তার বেশ জ্বর, বমি ও পেটব্যথা। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা চলছে। সন্ধ্যার পর আলট্রাসনোগ্রাফি রিপোর্ট আসে, একিউট প্যানক্রিয়াটাইটিস। শিশিরদার (শিশির মোড়ল, বিশেষ প্রতিনিধি) পরামর্শে ওই দিন রাত সাড়ে ১১টায় ভর্তি করাই শিশু হাসপাতালের সার্জারি ইউনিটে। রাতটাকে মনে হয় কঠিন ও দীর্ঘতম! অজানা আশঙ্কা, ভয় আর অনিশ্চয়তায় ভরা এক যাত্রার শুরু করি।
সকাল সাড়ে ১০টা নাগাদ আমাদের জ্যেষ্ঠ অফিস সহকারী ফরিদ উদ্দিনের ফোন, ‘আপনি কোন ফ্লোরে, কত নম্বর ওয়ার্ডে আছেন?’ ফরিদ ভাই আসেন, টাকা ভরা একটা খাম হাতে তুলে দেন। জানান, অফিস থেকে পাঠিয়েছে। দুপুর নাগাদ জানতে পারি, মেয়ের প্যানক্রিয়াস ঠিক আছে। নির্ণয় হয় ডেঙ্গু, প্লাটিলেট সাতান্ন হাজার এবং পেটে ফ্লুইড আছে। নতুন করে শুরু হয় ডেঙ্গুর চিকিৎসা। সহযোগী সম্পাদক সুমনা শারমীন আপা ফোন করেন, খবর নেন, সাহস দেন। উপসম্পাদক লাজ্জাত এনাব মহছি ভাই ফোন করে বলেন, তাঁর বাসা কাছেই, যেকোনো প্রয়োজনে যেন জানাই। এভাবে হাসপাতালে থাকা আট দিন প্রতিনিয়ত সহকর্মীদের ফোন পেতে থাকি, অনেক সহকর্মী হাসপাতালে দেখতে আসেন। আমাকে সাহস দেন, আশ্বাস দেন যেকোনো সহযোগিতার। আমার একা বোধ হয় না। পরিবারসহ আমি আপ্লুত হই! সম্পাদক মতিউর রহমান, আমাদের মতি ভাই প্রতিদিন খোঁজ নিচ্ছেন, পরামর্শ দিচ্ছেন। ফোন করে বলে দিচ্ছেন।
এক দিনের কথা বলি। অল্প সময়ের জন্য বিশেষ প্রয়োজনে অফিসে এসেছি। মতি ভাই ডেকে পাঠালেন। মেয়ের অসুস্থতার বিষয়ে হালনাগাদ জেনে নিয়ে তাঁর পরিচিত দুজন শিশুবিশেষজ্ঞকে ফোন করে পরামর্শ নিলেন। তারপর আমার স্ত্রীকে ফোন করলেন।
-ভাবি, আমি মতি। মতিউর রহমান।
-স্লামালেকুম, মতি ভাই।
-রোজই আপনার মেয়ের খবরাখবর রাখছি। চিন্তা করবেন না, ঠিক হয়ে যাবে।
-জি, মতি ভাই।
-যে চিকিৎসা হচ্ছে, আপনি সন্তুষ্ট তো?
-জি।
- আরও কিছু প্রয়োজন হলে কিংবা অন্য কোথাও চিকিৎসা করাতে চাইলে আমাকে জানাবেন, ব্যবস্থা করব।
-জি, মতি ভাই। দোয়া করবেন।
আমরা যাঁরা প্রথম আলোয় কাজ করি, তাঁরা জানি, এটা শুধু ‘বলার জন্য বলা’ নয়, এটা আমাদের ভরসা। আর এই ভরসাটুকু আমাদের মানসিক শক্তি পেতে এবং সামনের বন্ধুর পথ চলার সাহস জোগায়!
আরও কিছু কথা না বললেই নয়। সহকর্মী আনোয়ার হোসেন মৃধা ভাই তাঁর মেয়েসহ টিফিন ক্যারিয়ার ভর্তি করে খাবার নিয়ে আসেন। সহকর্মী নাহার রান্না করে খাবার নিয়ে আসেন। আবদুল মুন্নাফ ভাই প্রতিদিন হাসপাতালে দেখতে আসতেন। আরেক সহকর্মী কামাল উদ্দিন হাসপাতালে এসে কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে আমার হাতে কয়টা টাকা গুঁজে দিয়ে বলেন, ‘স্যার, এই সময়ে নগদ টাকা খুব প্রয়োজন হয়, রাখেন।’ তাঁর ভাবনার গভীরতা আর ভালোবাসা আমায় আবেগ তাড়িত করে। নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েও শেষে তাঁর ভালোবাসার কাছে পরাজিত হই!
আমাদের অধিকাংশ সহকর্মীর এমন দু-একটি অভিজ্ঞতা আছেই। প্রথম আলোর কর্মী নয়, পরিবারের সদস্য হিসেবে পরিচয় দিতেই আমরা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। এটাকে ম্যাজিক বলেন আর যা-ই বলেন, প্রথম আলো একটি পরিবার, আর কোনো সদস্যই পরিবারকে ছেড়ে যায় না!
এ বি এম খায়রুল কবীর, ব্যবস্থাপক, প্রশাসন