হাটুরে কবিতার সংগ্রাহক

জালাল খান ইউসুফীর সংগৃহীত বিভিন্ন পুঁথির কোলাজ
জালাল খান ইউসুফীর সংগৃহীত বিভিন্ন পুঁথির কোলাজ

আড়াই দশক আগের ঘটনা। তখনো প্রযুক্তির এতটা বিকাশ ঘটেনি। সে সময়টাতে গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে কিছু কবিকে পয়ার ছন্দে লেখা দীর্ঘ কবিতা সুরে সুরে আওড়ে পথচলতি মানুষকে আনন্দ দিতে দেখা যেত। প্রেম-বিরহের কাহিনি থেকে শুরু করে সমসাময়িক নানা ঘটনাই এসব কবিতার বিষয়বস্তু। এসব কবিতাকে কেউ বলতেন ‘হাটুরে কবিতা’, আবার কেউবা বলতেন ‘পথকবিতা’ কিংবা ‘ভাটকবিতা’। রচয়িতারা চারণকবি, পথকবি, হাটুরে কবি ও ভাটকবি অভিধায় স্বীকৃতি পেতেন।

প্রযুক্তির উত্থানে বিনোদনের নানা ক্ষেত্র তৈরি হয়। আবেদন কমে গ্রামীণ কবিদের। এ অবস্থায় ভাটা পড়ে হাটুরে কবিতা লেখায়। গ্রামের মেঠো পথ, মফস্‌সল শহর আর নৌঘাট ঘুরে, সুরে সুরে গাওয়া পুঁথি ফেরি করতে দেখা যায় না পুঁথিপাঠকদের। তবে কালেভদ্রে যে এমন কবির দেখা মেলে না, তা-ও কিন্তু নয়। কিছু কিছু কবিকে এখনো শহর-বন্দর-গ্রাম ঘুরে পুঁথিপাঠ করতে দেখা যায়। তাঁদেরই একজন জালাল খান ইউসুফী (৫১)। তাঁর বাড়ি সিলেটের ওসমানীনগর উপজেলার প্রথমপাশা গ্রামে। বর্তমানে ঢাকা শহরে বসবাস করছেন।

এর মধ্যে রয়েছে ‘মনির-খুকুর ফাঁসি’, ‘তোরাব আলী ও রোকেয়া সুন্দরীর প্রেমকাহিনি’, ‘ইরাক-আমেরিকার যুদ্ধ’, ‘চিত্রনায়ক সালমান শাহের রহস্যজনক মৃত্যুর কাহিনি’, ‘সূচরাজা ও সুখপাখির কবিতা’ এবং ‘লাইলী-মজনুর প্রেম কাহিনি’।
জালাল খান ইউসুফী

জালাল খান ১০ ভাই-বোনের মধ্যে তৃতীয়। স্ত্রী, দুই ছেলে ও পাঁচ মেয়েকে নিয়ে তাঁর সংসার। জালাল নিজে যেমন অসংখ্য হাটুরে কবিতার পুস্তিকা আর পুঁথির সংগ্রাহক, তেমনই দুহাত ভরে লিখেছেনও। এ পর্যন্ত তাঁর মুদ্রিত পুঁথির সংখ্যা ১০০। এ ছাড়া পুঁথিবিষয়ক তাঁর বেশ কিছু গবেষণাগ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছে। সাধারণত একটি মুদ্রিত পুঁথিতে একটিই কবিতা থাকে। অবশ্য এর ব্যতিক্রমও আছে।

জালালের বাবা ইউসুফ খানও (২০০০ সালে প্রয়াত) ছিলেন একজন নামকরা হাটুরে কবি। বাবার হাত ধরেই মূলত জালালের পুঁথি রচনায় হাতেখড়ি। প্রায় তিন শ গ্রামীণ কবির লেখা অন্তত পাঁচ শ হাটুরে কবিতার মুদ্রিত পুথি তাঁর সংগ্রহে আছে, যেগুলোর কোনো কোনোটির বয়স ৬০ থেকে ৭০ বছর। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা ও মফস্‌সল শহর থেকে এসব পুঁথি মুদ্রিত হয়েছে।

জালাল খান ইউসুফী জানান, তাঁর দাদা চান্দ আলী খান (চান খাঁ) হাটুরে কবিতার সমঝদার ছিলেন। দাদা-বাবার উত্তরাধিকার হয়েই তিনি হাটুরে কবিতা রচনা শুরু করেন। এখন আর সারা দেশে খুব একটা হাটুরে কবিদের দেখা মেলে না। হাতে গোনা কিছু ব্যক্তি এ ধরনের কবিতা লিখছেন। গ্রামীণ মানুষের বিনোদনের অনেক ক্ষেত্র তৈরি হয়ে যাওয়ায় লোকসাহিত্যের উর্বর এ ধারাটি ধীরে ধীরে বিলুপ্তির দিকে যাচ্ছে। তবে এখনো যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা পেলে হাটুরে কবিতার ধারাটি সজীব ও প্রাণবান রাখা সম্ভব। গ্রামীণ এ কবিতার ধারাটিকে টিকিয়ে রাখতে তিনি ভবিষ্যতে হাটুরে কবিতার একটি একাডেমি গড়ে তোলারও স্বপ্ন দেখছেন।

জালাল খান ইউসুফীর সংগৃহীত হাটুরে কবিতার পুঁথির মধ্যে ‘আশ্চর্য কবিতা’, ‘রাজীব গান্ধীর হত্যাকাণ্ডের রহস্য’, ‘প্রেমের এসিড’, ‘অমূল্য খুকু–রানীর কবিতা’, ‘প্রেম আর প্রেম’, ‘মাইক বাজান্যা ও মচুদা সুন্দরীর নতুন কবিতা’, ‘জয় বাংলার কবিতা’, ‘পাঁচালী গানের কবিতা’, ‘সিরাজ মিয়া ও কুসুমবালার প্রেমের জীবনী’, ‘ইলেকশনের কবিতা’, ‘জয় বাংলা জয়গীতি’, ‘বিষাদ সাগর’, ‘১১ দফা দাবি ও গণতন্ত্রের কবিতা’, ‘মরহুম শেরে বাংলার মৃত্যুতে শোকপ্রকাশ’ উল্লেখযোগ্য। সমসাময়িক ঘটনা থেকে শুরু করে প্রেম, পুরাণ, ঐতিহাসিক ঘটনা এসবই পুঁথির বিষয়বস্তু। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি এসব কবিতা সুরে সুরে পরিবেশন করে থাকেন।

একজন হাটুরে কবিতার সংগ্রাহক হিসেবেই কেবল জালাল খান ইউসুফী সুপরিচিত নন। বরং ৮০ ও ৯০–এর দশকে তাঁর রচিত অসংখ্য পুঁথি গ্রামেগঞ্জে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। এর মধ্যে রয়েছে ‘মনির-খুকুর ফাঁসি’, ‘তোরাব আলী ও রোকেয়া সুন্দরীর প্রেমকাহিনি’, ‘ইরাক-আমেরিকার যুদ্ধ’, ‘চিত্রনায়ক সালমান শাহের রহস্যজনক মৃত্যুর কাহিনি’, ‘সূচরাজা ও সুখপাখির কবিতা’ এবং ‘লাইলী-মজনুর প্রেম কাহিনি’।

যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা পেলে হাটুরে কবিতার ধারাটি সজীব ও প্রাণবান রাখা সম্ভব। গ্রামীণ এ কবিতার ধারাটিকে টিকিয়ে রাখতে তিনি ভবিষ্যতে হাটুরে কবিতার একটি একাডেমি গড়ে তোলারও স্বপ্ন দেখছেন।

পুঁথিগবেষকদের অনেকেই জালাল খানের সংগ্রহে থাকা পুঁথি নিয়ে গবেষণা করেছেন। ফোকলোরে বাংলা একাডেমি পদকপ্রাপ্ত গবেষক সাইমন জাকারিয়া উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন জালাল খান ইউসুফীর। সাইমন বলছিলেন, ‘হাটুরে কবিতা রচনা এবং সুরে সুরে পরিবেশন এখন বিলুপ্তপ্রায়।

বর্তমানে এই ঐতিহ্যগত চর্চায় খুব কম মানুষকে প্রত্যক্ষ করা যায়। জালাল খান ইউসুফী হাটুরে কবিতার ঐতিহ্যগত সংরক্ষণে ও পুনর্জাগরণে বিশেষ একটি ভূমিকা রেখে চলেছেন। তিনি যেমন নিজে লিখে হাটুরে কবিতা পুঁথি আকারে প্রকাশ করে ছড়িয়ে দিচ্ছেন, তেমনই দেশে প্রকাশিত অসংখ্য হাটুরে কবিতার পুঁথি সংগ্রহ করে জাতীয় দায়িত্বও পালন করেছেন। তাঁর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা।’