খালি পড়ে আছে ১৮০০ সরকারি ফ্ল্যাট

সমীক্ষা ছাড়াই নির্মাণ করা হয়েছে আবাসিক ভবন। চাহিদার বিষয়টি আমলে নেওয়া হয়নি।

উপসচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের আবাসনের জন্য বানানো হয়েছে ১৪ তলা এই ভবন। কিন্তু দুই বছর ধরে ফাঁকা পড়ে আছে। সম্প্রতি রাজধানীর মিরপুর ৬ নম্বরের কাঠের কারখানা এলাকায়

সরকারের উপসচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের আবাসনের সুবিধার্থে রাজধানীর মিরপুর–৬ নম্বর সেকশনের কাঠের কারখানা এলাকায় পাঁচটি বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এসব ভবনের অধিকাংশ ফ্ল্যাট দুই বছর ধরে খালি। কর্মকর্তারা সেখানে যেতে আগ্রহী নন। একই সেকশনের শিয়ালবাড়ি এলাকার চিত্র আরও খারাপ। সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য সেখানে ছয়টি ভবন করা হয়েছে। গত জুন থেকে সব ভবনই ফাঁকা পড়ে আছে।

কাঠের কারখানা ও শিয়ালবাড়ি এলাকার দূরত্ব প্রায় এক কিলোমিটার। দুই এলাকার এই ১১টি ভবনের প্রতিটি ১৪ তলা। খালি এসব ফ্ল্যাটে কর্মকর্তাদের ওঠার জন্য সরকারের আবাসন পরিদপ্তর থেকে বারবার বিজ্ঞপ্তি দিয়েও সাড়া মিলছে না। শুধু রাজধানীর এই দুই এলাকায় নয়, নোয়াখালী ও নারায়ণগঞ্জে নির্মিত আরও ১৫টি বহুতল ভবন এভাবে খালি পড়ে আছে। এসব ভবনের মোট ২ হাজার ৩৪৮টি ফ্ল্যাটের মধ্যে ১ হাজার ৮০০টির বেশি খালি পড়ে আছে।

বিপুল টাকা খরচ করে এসব ভবনের নির্মাণ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকল্প গ্রহণের আগে সঠিকভাবে সমীক্ষা করা হয়েছে কি না, খতিয়ে দেখা উচিত। এ ধরনের অপরিকল্পিত প্রকল্প রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয় ছাড়া আর কিছু নয়।

‘মিরপুরে খালি ফ্ল্যাটে উঠতে আমরা বারবার বিজ্ঞপ্তি দিচ্ছি, কিন্তু সাড়া মিলছে না। কর্মকর্তারা দূরত্বের কথা বলছেন। মিরপুরের চেয়ে ইস্কাটন, মতিঝিল ও আজিমপুরে ফ্ল্যাটের চাহিদা অনেক বেশি। মিরপুরের এসব ফ্ল্যাট ব্যবহারের উপায় খোঁজা হচ্ছে।’
শহিদুল ইসলাম, আবাসন পরিদপ্তরের পরিচালক (যুগ্ম সচিব)

রাজধানীর মিরপুরে ভবন খালি পড়ে থাকলেও উল্টো চিত্র মতিঝিল, ইস্কাটন ও আজিমপুরের। এসব এলাকায় নির্মিত সরকারি ফ্ল্যাটে উঠতে কর্মকর্তা–কর্মচারীরা ভিড় করছেন। ফ্ল্যাট বরাদ্দ পেতে যে যার মতো মন্ত্রী, সচিবদের মাধ্যমে তদবির করছেন। ফলে প্রতিদিনই বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হচ্ছে আবাসন পরিদপ্তরের কর্মকর্তাদের।

গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন আবাসন পরিদপ্তরের অফিস থেকেই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেওয়া হয়। গত ৩০ ও ৩১ অক্টোবর কার্যালয়ে গিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভিড় দেখা যায়। বিসিএস প্রশাসন, পুলিশ, কৃষিসহ বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকর্তারা পছন্দের ফ্ল্যাটের জন্য আবেদন নিয়ে আসছেন। আছেন তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরাও। প্রায় সবাই মতিঝিল, ইস্কাটন ও আজিমপুর এলাকায় আবাসন চান। মিরপুরে কেউ যেতে রাজি হচ্ছেন না।

মিরপুরের ফ্ল্যাটে না ওঠার ‘তিনটি যুক্তি’ দেখাচ্ছেন কর্মকর্তারা। প্রথমত, অফিস থেকে দূরত্ব বেশি। দ্বিতীয়ত, ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই এবং তৃতীয়ত, বেতনের বড় একটি অংশ যাবে বাসা ভাড়ায়। তার চেয়ে অফিসের আশপাশে ভাড়া বাসায় থাকা ভালো।

তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে আবাসন পরিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, মিরপুরের ওই দুই এলাকায় ফ্ল্যাট নির্মাণের আগে কোনো সমীক্ষাই করা হয়নি। আদৌ সেখানে কর্মকর্তারা যাবেন কি না, চাহিদা আছে কি না—সেসব বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্তারা নিজেদের সিদ্ধান্তে এসব বহুতল ভবন করেছেন। ঢাকার বাইরে অপরিকল্পিতভাবে খেয়ালখুশিমতো ভবন বানানো হয়েছে। আবাসন পরিদপ্তরের কোনো মতামত নেওয়া হয়নি।

ফ্ল্যাটগুলো যেহেতু বানানো হয়ে গেছে, এখন সরকারের সিদ্ধান্ত কর্মকর্তাদের মানতে হবে। তাঁরা সেখানে যেতে বাধ্য। তাঁরা না গেলেও এসব ফ্ল্যাট খালি রাখা ঠিক হবে না। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির অনেক কর্মচারী আছেন, যাঁদের ফ্ল্যাট খুব জরুরি। নতুন কোনো নীতিমালা করে তাঁদের এসব ফ্ল্যাটে ওঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
ইফতেখারুজ্জামান, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক

জানতে চাইলে আবাসন পরিদপ্তরের পরিচালক (যুগ্ম সচিব) শহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘মিরপুরে খালি ফ্ল্যাটে উঠতে আমরা বারবার বিজ্ঞপ্তি দিচ্ছি, কিন্তু সাড়া মিলছে না। কর্মকর্তারা দূরত্বের কথা বলছেন। মিরপুরের চেয়ে ইস্কাটন, মতিঝিল ও আজিমপুরে ফ্ল্যাটের চাহিদা অনেক বেশি। মিরপুরের এসব ফ্ল্যাট ব্যবহারের উপায় খোঁজা হচ্ছে।’

আবাসন পরিদপ্তরের তথ্যমতে, মতিঝিল, আজিমপুর ও ইস্কাটন এলাকায় কর্মকর্তা–কর্মচারীদের আবাসনের ১ হাজার ১০০টি আবেদন জমা আছে।

পাঁচটি ভবন প্রায়ই খালি

সচিবালয় থেকে মিরপুর–৬ নম্বর সেকশনের দূরত্ব প্রায় ১৩ কিলোমিটার। কাঠের কারখানা এলাকায় ১০ একর জায়গায় ১৪ তলা বিশিষ্ট ১০টি ভবন নির্মাণের কাজ শেষ হয় ২০১৯ সালে। এর মধ্যে উপসচিব ও সমমর্যাদার কর্মকর্তাদের জন্য ১ হাজার ৫০০ বর্গফুট ফ্ল্যাটের ৫টি ভবন নির্মাণ করা হয়। প্রতিটিতে ৭৪টি করে ফ্ল্যাট হিসেবে ৫টি ভবনে মোট ফ্ল্যাট ৫৯২টি। বাকি ৫টি ভবনে ১ হাজার ২০০ বর্গফুটের ৪৭২টি ফ্ল্যাট করা হয়। জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের জন্য এসব ফ্ল্যাট বানানো হয়েছে।

গত ২৯ আগস্ট ও ২৭ অক্টোবর দুই দফা সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপসচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের জন্য নির্মিত পাঁচটি ভবনের মধ্যে একটিতে এখনো কেউ ওঠেননি। বাকি চারটিতে ১০, ২০, ২৬ ও ১৫—মোট ৭১টি পরিবার উঠেছে। জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের পাঁচটি ভবনেও বেশ কিছু ফ্ল্যাট এখনো খালি।

শিয়ালবাড়ির ছয়টি ভবনই ফাঁকা

মিরপুর–৬ নম্বর সেকশনের শিয়ালবাড়ি এলাকায় ১৪ তলা ৬টি ভবনের তিনটিতে উপসচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের জন্য ১ হাজার ৫০০ বর্গফুট এবং বাকি তিনটিতে জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের জন্য ১ হাজার ২০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট বানানো হয়। মাল্টিপারপাস হল হিসেবে আরেকটি চারতলা ভবন আছে। গত জুনে প্রকল্পের কাজ শেষ হয়।

আবাসন পরিদপ্তর বলছে, কর্মকর্তারা এসব ভবনে উঠতে আগ্রহী হচ্ছেন না। তাই শর্ত শিথিল করে নবম গ্রেডের কর্মকর্তাদের জন্য বরাদ্দ দেওয়া যায় কি না, সেই চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে।

গণপূর্ত অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী সাইফুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা ঠিকাদারের কাছ থেকে শিগগিরই ভবনগুলো বুঝে নেবেন। ডিসেম্বরের মধ্যে যে কেউ চাইলে উঠতে পারবেন।

নোয়াখালী সদরে নয়টি ভবন

নোয়াখালীর মাইজদী শহরে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য নয়টি আবাসিক ভবন নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শেষ হয় গত জুনে। সেখানে ৬৫০ বর্গফুট থেকে ১ হাজার ২৫০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট রয়েছে।

জেলা নির্বাহী প্রকৌশলী সা’দ মোহাম্মদ আন্দালিব বলেন, গণপূর্তের কাছে গত জুনে ঠিকাদার ভবন বুঝিয়ে দিয়েছেন। এখনো কোনো কর্মকর্তা–কর্মচারী আবাসনের জন্য আবেদন করেননি। তবে তাঁরা ডিসেম্বরে আবেদন আহ্বান করলে ভালো সাড়া পাবেন বলে আশা করছেন।

নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আবদুল কাইয়ুম প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য এসব ভবন নির্মাণের আগে স্থানীয় বাসিন্দাদের মতামত নেওয়া জরুরি ছিল। এখানে বাসাভাড়ায় বেতনের বড় অংশ চলে যাবে। অথচ শহরে অপেক্ষাকৃত কম ভাড়ায় বাসা পাওয়া যায়। আবার ৩২৪টি ফ্ল্যাটে ওঠার মতো নোয়াখালী সদরে এত সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারী আছেন কি না, সেটিও দেখা উচিত ছিল।

সচিবালয় থেকে নারায়ণগঞ্জের আলীগঞ্জের দূরত্ব ১৫ কিলোমিটার। সেখানে ১৪ তলা করে ৬টি ভবন তৈরি করা হয়েছে। এর মধ্যে ৮০০ থেকে ১ হাজার ২৫০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট রয়েছে। এসব ভবনও খালি।

আবাসন পরিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, আলীগঞ্জে আবাসন প্রকল্প নেওয়ার আগে তাঁদের

কোনো মতামত নেওয়া হয়নি। কোনো কর্মকর্তা সেখানে উঠতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।

ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক আদিল মুহাম্মদ খান প্রথম আলোকে বলেন, কর্মকর্তা–কর্মচারীরা সেখানে যাবেন কি না, ওই এলাকার পরিবেশ কেমন—এসব নিয়ে কখনো বিস্তারিত সমীক্ষা করা হয় না। খামখেয়ালিভাবে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে ফ্ল্যাট খালি পড়ে আছে। এতে শুধু অর্থেরই অপচয় হয় না, এসব ভবনের কাজের মানও ভালো হয় না।

সার্বিক বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ফ্ল্যাটগুলো যেহেতু বানানো হয়ে গেছে, এখন সরকারের সিদ্ধান্ত কর্মকর্তাদের মানতে হবে। তাঁরা সেখানে যেতে বাধ্য। তাঁরা না গেলেও এসব ফ্ল্যাট খালি রাখা ঠিক হবে না। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির অনেক কর্মচারী আছেন, যাঁদের ফ্ল্যাট খুব জরুরি। নতুন কোনো নীতিমালা করে তাঁদের এসব ফ্ল্যাটে ওঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে।