বাংলাদেশের শ্রম পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) চলতি অধিবেশনে পশ্চিমা দেশগুলো প্রশ্ন তুলেছে। শ্রম অধিকার চর্চা, শ্রমিকদের ওপর হামলা–নির্যাতন বন্ধসহ শ্রম আইনের প্রয়োজনীয় সংস্কার হয়নি বলে তারা মন্তব্য করেছে।
একই অধিবেশনে ভারত, চীন, সৌদি আরব, ইরানসহ বেশ কয়েকটি দেশ বাংলাদেশের শ্রম পরিস্থিতির উন্নয়নে সরকারের পদক্ষেপের প্রশংসা করেছে।
গতকাল মঙ্গলবার সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় আইএলওর চলতি ৩৫০তম অধিবেশনে বাংলাদেশের শ্রম পরিস্থিতির অগ্রগতি নিয়ে এক পর্যালোচনা হয়। অধিবেশনটি অনলাইনে সম্প্রচারিত হয়।
আলোচনার শুরুতে আইনমন্ত্রী আইএলওর পথনকশা অনুযায়ী বাংলাদেশ কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে, সেটি উপস্থাপন করেন। তিনি শ্রম আইন সংশোধনে বাংলাদেশের জোরালো রাজনৈতিক অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, পরিস্থিতির উন্নয়নে বাংলাদেশের উদ্যোগের যথাযথ স্বীকৃতি না দিলে আইএলওসহ আন্তর্জাতিক অংশীজনদের সঙ্গে আস্থার সংকট তৈরি হতে পারে।
আইনমন্ত্রীর বক্তব্যের পর বিভিন্ন দেশ, জোট, সংগঠন ও আইএলওর পরিচালনা পরিষদের সদস্যসহ ২৪ জন বাংলাদেশের শ্রম পরিস্থিতি ও প্রতিবেদনের ভিত্তিতে তাঁদের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন।
বাংলাদেশ নিয়ে গতকালের অধিবেশনে আলোচনা শুরু করেন আইএলওর পরিচালনা পরিষদের সভাপতি রিচার্ড এ আদেজোলা। তিনি গত ২৯ জানুয়ারি আইএলওর কাছে উত্থাপিত বাংলাদেশের প্রতিবেদনের উল্লেখ করে বলেন, সামগ্রিকভাবে ২০২১ থেকে ২০২৬ সালের মধ্যে আইএলওর কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বাংলাদেশ শ্রম আইন সংশোধনসহ প্রয়োজনীয় সংস্কারের বিষয়ে জোরালো অঙ্গীকার প্রতিফলিত হয়েছে। শ্রম আইনের প্রয়োজনীয় সংস্কারের জন্য ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে সরকার ও অংশীজনদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ত্রিপক্ষীয় আলোচনা এগিয়ে নিতে হবে। প্রয়োজনে আইএলওর কারিগরি সহায়তা এবং মালিক ও শ্রমিকপক্ষের সহায়তা নেওয়া যেতে পারে।
এরপর আইএলওর পরিচালনা পরিষদের সভাপতি বাংলাদেশের আইনমন্ত্রীকে বক্তব্য দেওয়ার আহ্বান জানান।
আইনমন্ত্রী তাঁর বক্তৃতায় লিখিত প্রতিবেদনের ধারাবাহিকতায় এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে, তা তুলে ধরেন। এরপর জাতীয় নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতে কেন শ্রম আইনের সংশোধন করা গেল না, তা ব্যাখ্যা করেন। সংসদের আগামী অধিবেশনে তিনি শ্রম আইন সংশোধনের বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। তিনি জানান, শ্রমিকনেতা শহীদুল ইসলাম হত্যার অভিযোগপত্র তৈরি করা হয়েছে। দ্রুতই সম্পন্ন হবে বিচারকাজ।
আনিসুল হক আরও বলেন, আইএলওর সঙ্গে সম্মত পথনকশা অনুযায়ী চারটি ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের শ্রম পরিস্থিতির উন্নয়নে নতুন সরকারের জোরালো রাজনৈতিক অঙ্গীকার আছে। পরিস্থিতির উন্নতির স্বার্থে বাংলাদেশকে আরও অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে। তবে বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, সেগুলোর যথাযথ স্বীকৃতি না দেওয়া ও যান্ত্রিকভাবে পরিস্থিতির উন্নতিতে চাপের বিষয়গুলো অংশীদারত্বের মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি করতে পারে। বাংলাদেশের যে অঙ্গীকার রয়েছে, সেটির প্রশংসা করা প্রয়োজন।
পরে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও আর্জেন্টিনা বাংলাদেশের শ্রম পরিস্থিতি নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন তোলে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠন সলিডারিটি সেন্টারের পরিচালক জেফরি ভগ্ট বলেন, বাংলাদেশে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়নে যুক্ততার ক্ষেত্রে যথাযথ স্বাধীনতা নেই। দর–কষাকষিতে যুক্ততার হার খুবই কম। শ্রমিকেরা প্রতিনিয়ত নানা ধরনের সহিংসতার মুখোমুখি হচ্ছেন। নারী কর্মীরা নানাভাবে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। বাংলাদেশের শ্রম আইনে যে সংস্কার হয়েছে, তা একেবারেই ন্যূনতম।
ইইউর প্রতিনিধি লিজিন ইলিইস বলেন, ‘যে সংস্কার বাংলাদেশে হয়েছে তা আংশিক, যা উদ্বেগের। আমাদের প্রত্যাশা থাকবে বাংলাদেশের নতুন সরকার সব অংশীজনকে নিয়ে দ্রুত শ্রম অধিকার নিশ্চিতের বিষয়গুলোতে প্রয়োজনীয় সংস্কার আনবে। ২০২৩ সালে যেসব শ্রমিক নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, সেগুলোর দ্রুত তদন্ত করে সুরাহা করা হবে। রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকায় (ইপিজেড) সব শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিত করতে সংগঠনের বিষয়টিকে বিবেচনায় নেওয়া হবে।’
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি সারাহ মরগ্যান বলেন, ‘আইএলওর ৮১, ৮৭ ও ৯৮ নম্বর সনদ বাস্তবায়নের পাশাপাশি বাংলাদেশ শ্রম আইন ও ইপিজেড আইনে প্রয়োজনীয় সংস্কার দ্রুত করতে হবে। ট্রেড ইউনিয়নবিরোধী তৎপরতার বিরুদ্ধে সরকার যেসব ব্যবস্থা নিয়েছে, সেগুলোকে সাধুবাদ জানাই। দুই বছর পেরিয়ে গেলেও শ্রমিকনেতা শহীদুল হত্যার বিচার না হওয়ার পাশাপাশি আরও বেশ কয়েকজন শ্রমিকনেতার নির্যাতনের শিকার হওয়ার বিষয়গুলো অত্যন্ত উদ্বেগের।’ শ্রমিকদের বিরুদ্ধে আনা ভিত্তিহীন অভিযোগগুলো প্রত্যাহারের আহ্বান জানান তিনি।
আইএলওর পরিচালনা পরিষদের অন্যতম সদস্য জার্মানির রেনাটে ড্রাউস বাংলাদেশের শ্রম পরিস্থিতির উন্নতির তাগিদ দেওয়ার পাশাপাশি এখন পর্যন্ত নেওয়া উদ্যোগের প্রশংসা করেন। আর ভারত, চীন, সৌদি আরব, ইরানের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশের গৃহীত পদক্ষেপের প্রশংসা করেন। তাঁরা আইএলওর ২৬ ধারা অনুযায়ী ৮১, ৮৭ ও ৯৮ সনদ অনুসরণ না করায় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে, তা তুলে নেওয়ার প্রস্তাব করেন।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক প্রশ্নোত্তর পর্বে বলেন, গত আড়াই বছরে বাংলাদেশ অন্তত চার থেকে পাঁচবার শুনানিতে অংশ নিয়েছে। এই সময়কালে বাংলাদেশের শ্রম পরিস্থিতির অগ্রগতির চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। তিনি বাংলাদেশের বিচারাধীন বিষয়কে অভিযোগ হিসেবে বিবেচনায় না নেওয়ার অনুরোধ জানান। তিনি বাংলাদেশ আইএলওর সনদ মেনে চলছে না বলে যে অভিযোগ আনা হয়েছে, সেটা প্রত্যাহারের অনুরোধ জানান।
আইএলওর পথনকশা অনুযায়ী বাংলাদেশের শ্রম পরিস্থিতির কতটা উন্নতি হলো, তা নিয়ে আগামী অক্টোবর–নভেম্বরে অনুষ্ঠেয় সংস্থার ৩৫২তম অধিবেশনের আগে প্রতিবেদন দেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে।