রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

ছাত্রলীগের মারধর, চাঁদাবাজিতে অভিযোগ হয়, প্রতিকার হয় না

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রক্টরের দপ্তরে চলতি বছর ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে মারধর ও চাঁদাবাজির ছয়টি লিখিত অভিযোগ জমা পড়েছে। লিখিত অভিযোগগুলোর কোনো সুরাহা হয়নি। তবে মৌখিক অভিযোগ রয়েছে অনেক।

গত অক্টোবরে আবাসিক হল খুলে দেওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে হলের কক্ষ দখল, সিট বাণিজ্য, মারধর, চাঁদাবাজি ও হুমকির ২০টি অভিযোগ পাওয়া গেছে। কিন্তু এসব অভিযোগের কোনো সুরাহা হয়নি।

ছাত্রলীগের মারধর ও চাঁদাবাজির সর্বশেষ শিকার হন অর্থনীতি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী সামছুল ইসলাম। এ ঘটনার বিচার চেয়ে ১৯ আগস্ট তিনি প্রক্টরের দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। এই অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত চলছে। এ নিয়ে ক্যাম্পাসে আন্দোলনও চলছে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আসাবুল হক প্রথম আলোকে বলেন, তিনি চলতি বছর ফেব্রুয়ারিতে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে অন্তত ৩০টির মতো অভিযোগ পেয়েছেন। তবে মারামারি, চাঁদাবাজি, হুমকি—এই ধরনের অভিযোগ পেয়েছেন ছয়টির মতো।

এসব অভিযোগের মধ্যে তিন-চারটি পরে দুই পক্ষ সমঝোতা করে নিয়েছে। তদন্তের ব্যবস্থা নেওয়া হয় না বলে লিখিত অভিযোগ কম আসে কি না, জানতে চাইলে প্রক্টর বলেন, অনেক সময় শিক্ষার্থীরা হয়তো আস্থা পান না। আবার অভিযোগ দিলেও ভবিষ্যতে হুমকি বিবেচনায় প্রত্যাহার করে নেন অনেকেই।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ১৭ অক্টোবর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসিক হল খুলে দেওয়ার পর প্রথমে কক্ষ দখলে ছাত্রলীগ তালা লাগাতে থাকে। পরে কোন কক্ষ খালি হচ্ছে, সেই তথ্য নিতে থাকে তারা। সেসব খালি হওয়া কক্ষে তারা টাকার বিনিময়ে তাদের কর্মীসহ শিক্ষার্থীদের তুলতে থাকে। প্রাধ্যক্ষের মাধ্যমে ওঠা শিক্ষার্থীদের ভয়ভীতি দেখিয়ে নামিয়ে দেয় তারা। এর পরও না নামলে তারা গভীর রাতে ওই শিক্ষার্থীদের মেরে হল ত্যাগে বাধ্য করে। ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে একের পর এক মারধর ও চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠতে থাকে।

চলতি মাসের ১১ তারিখ ক্যাম্পাসের একটি দোকানের ক্যাশবাক্স থেকে ৫০ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগ ওঠে শহীদ জিয়াউর রহমান হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি রাশেদ মিয়ার বিরুদ্ধে। ওই ঘটনায় দোকান মালিক সেলিম হোসেন ছাত্রলীগ নেতাসহ তিনজনের নাম উল্লেখ করে প্রক্টর দপ্তরে অভিযোগ করেন। ছাত্রলীগের চাঁদাবাজি ও মারধর থেকে ছাত্রলীগও রেহাই পায়নি। ১৭ আগস্ট রাতে মারধর করে ৪০ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় শহীদ হবিবুর রহমান হল শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রেজোয়ান গাজি ওরফে মহারাজ প্রক্টর দপ্তরে অভিযোগ করেছেন।

তিনি অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহসম্পাদক মুশফিকুর রহমান, মতিহার হলের সাংগঠনিক সম্পাদক মাহফুজ আলম, শাহ মখদুম হলের সহসভাপতি শামীম শিকদার, সৈয়দ আমীর আলী হল ও শহীদ হবিবুর রহমান হলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জুয়েল হোসেন ও মিম মো. মাজেদ মিয়ার নাম উল্লেখ করেছেন। এ ছাড়া ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে ভর্তি পরীক্ষা চলাকালে চাঁদাবাজি, ক্যাম্পাসে উন্নয়ন প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকেও চাঁদা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগ দেওয়া হলেও সবগুলো প্রক্টর দপ্তর আমলে নেয়নি। কিছু বিষয় পুলিশের দ্বারস্থ হতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

গত ৩০ মে মাদার বখশ হলের টিভি রুমে বাংলা বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিডিমর্নিংয়ের প্রতিনিধি মো. শাহাবুদ্দিনকে মারধর করার অভিযোগ ওঠে হল শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি গিয়াস উদ্দিনের বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি হওয়ার পর প্রতিবেদন প্রাধ্যক্ষের কাছে জমা দেওয়া হয়। তবে সেই প্রতিবেদন এখনো হলেই রয়ে গেছে। এ বিষয়ে হল প্রাধ্যক্ষ শামীম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, এখন এটা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চেয়ে নেবে নাকি তাঁরা দেবেন, তা জানেন না। এটা আলোচনা করতে হবে।

এ বিষয়ে মারধরের শিকার শাহাবুদ্দিন বলেন, ‘সবাই জিজ্ঞাসা করে তোরা সাংবাদিক হয়ে মার খেয়ে কিছুই করতে পারলি না। আর অন্যরা কী করবে?’ প্রাধ্যক্ষ তদন্ত প্রতিবেদন বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন জমা দিচ্ছেন না, তা তিনি বলতে পারবেন না।

এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি গোলাম কিবরিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আসে, সেগুলোর সঙ্গে ছাত্রলীগ শতভাগ জড়িত না। এসব ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেলে তাঁরা সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেবেন।

এদিকে গত ২৩ জুন গভীর রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব আব্দুল লতিফ হল থেকে মুন্না ইসলাম নামে এক শিক্ষার্থীকে মেরে বের করে দেন হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকসহ তিন নেতা–কর্মী। পরদিন রাতে এ নিয়ে তদন্ত কমিটি হয় এবং অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতা–কর্মীকে হল ত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হয়। এ ঘটনায় ছাত্রলীগ হল ত্যাগ করেনি, তদন্ত প্রতিবেদনও জমা হয়নি।

হল প্রাধ্যক্ষ বলেন, তদন্ত কমিটির আহ্বায়কের বাবার অসুস্থতার জন্য তিনি বাইরে ছিলেন। এ কারণে প্রতিবেদন জমা দেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে দ্রুতই প্রতিবেদন জমা দেবেন তাঁরা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন খান দীর্ঘদিন ধরে আবাসিক হলে সিট দখল ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে সরব রয়েছেন। তিনি বলেন, শিক্ষার্থী দেখছে এই ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ মহাপরাক্রমশালী। তারা যা বলে তা–ই হয়। প্রশাসনের ওপরে তারা ছড়ি ঘোরায়। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়ে যে বিচার পাবে না এই আশঙ্কা সবারই আছে। এ কারণে ঘটনা অনেক হলেও লিখিত অভিযোগ কম। প্রশাসন তদন্ত করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিলে এ ধরনের ঘটনা কমবে।