৬ মাসে রোহিঙ্গাদের জন্য প্রতিশ্রুত সহায়তার মাত্র ২৬% এসেছে। সহায়তা কম পাওয়ায় রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্য ও পুষ্টি নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে।
বছরের ছয় মাস চলে গেছে। কিন্তু বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের প্রতিশ্রুত মানবিক সহায়তার মাত্র ২৬ ভাগ অর্থ পাওয়া গেছে। রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তার জন্য পরিচালিত সমন্বয়কারী সংস্থা ইন্টার সেক্টর কো-অর্ডিনেশন গ্রুপের (আইএসসিজি) সর্বশেষ প্রকাশিত হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
মানবিক সহায়তা সংস্থা এবং শরণার্থীবিষয়ক গবেষকেরা এ পরিস্থিতিকে উদ্বেগজনক বলেছেন। সহায়তা কম পাওয়ায় রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্য ও পুষ্টি নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। রোহিঙ্গাদের কারও কারও শিবির ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য এমন পরিস্থিতি দায়ী বলে মনে করা হচ্ছে।
এমন অবস্থায় আজ ২০ জুন পালিত হচ্ছে বিশ্ব শরণার্থী দিবস। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয়, ‘মাতৃভূমি থেকে দূরেও আশা’।
খাবারের দেওয়া বরাদ্দ কমে গেছে। দাতারা আর টাকা নাকি দিতে পারছে না শুনেছি। তাই বরাদ্দ কমেছে। আমরা খুব চিন্তিত।বদরুল ইসলাম, হেড মাঝি, জাদিমূড়া শালবাগান রোহিঙ্গা শিবির, টেকনাফ
রোহিঙ্গাদের জন্য প্রতিশ্রুত বরাদ্দ কমে যাওয়ার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে টেকনাফের জাদিমূড়া শালবাগান ২৬ নম্বর রোহিঙ্গা শিবিরের ব্যবস্থাপনা কমিটির চেয়ারম্যান (হেড মাঝি) বদরুল ইসলাম বলেন, ‘খাবারের দেওয়া বরাদ্দ কমে গেছে। দাতারা আর টাকা নাকি দিতে পারছে না শুনেছি। তাই বরাদ্দ কমেছে। আমরা খুব চিন্তিত।’
বাংলাদেশে ২০১৭ সালে মিয়ানমার থেকে বাস্তচ্যুত রোহিঙ্গাদের ঢল নামে। এর পর থেকেই যৌথ সাড়াদান কর্মসূচির (জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যান–জেআরপি) আওতায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে। তবে প্রতিবছরই প্রতিশ্রুত সহায়তা চেয়ে বরাদ্দ এসেছে কম। চলতি বছর ৮৭ কোটি ৫৯ লাখ ডলার সহায়তা চাওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে ছয় মাসে পাওয়া গেছে ২২ কোটি ৪৩ লাখ ডলার।
রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের পুষ্টি সমস্যা বাড়ছে। খাবারের খোঁজে শিবিরের বাইরে চলে যাচ্ছে রোহিঙ্গারা। সহায়তা কমে যাওয়ায় চোরাচালান, মানব পাচার থেকে শুরু করে অপরাধমূলক তৎপরতা বাড়ছে। আমাদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি সৃষ্টিকারী নানা ঘটনা ঘটছেমোহাম্মদ মিজানুর রহমান, শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার
আইএসসিজির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের সহায়তায় জেআরপিতে ৪৩ কোটি ৪০ লাখ ডলারের প্রতিশ্রুতি থাকলেও শেষ পর্যন্ত পাওয়া গিয়েছিল ৩১ কোটি ৭০ লাখ ডলার। ২০১৮ সালে প্রতিশ্রুত ১০০ কোটি ডলারের বিপরীতে ৬৫ কোটি ৫০ লাখ ডলার এবং ২০১৯ সালে ৯২ কোটি ডলারের বিপরীতে ৬৯ কোটি ৬০ লাখ ডলার পাওয়া গিয়েছিল। পরবর্তী ২০২০, ২০২১ এবং ২০২২ সালে প্রতিশ্রুতির চেয়ে যথাক্রমে ৬০, ৭৩ ও ৬৩ ভাগ সহায়তা পাওয়া গেছে।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ক্রমাগতভাবে দাতাদের সহায়তা কমে যাচ্ছে। ছয় মাসে এর আগে এত কম বরাদ্দ আর কখনোই সম্ভবত আসেনি।
ত্রাণসহায়তা কমে যাওয়ায় বড় ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের পুষ্টি সমস্যা বাড়ছে। খাবারের খোঁজে শিবিরের বাইরে চলে যাচ্ছে রোহিঙ্গারা। সহায়তা কমে যাওয়ায় চোরাচালান, মানব পাচার থেকে শুরু করে অপরাধমূলক তৎপরতা বাড়ছে। আমাদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি সৃষ্টিকারী নানা ঘটনা ঘটছে।’
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে সংকটের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু যুদ্ধের জন্য অস্ত্রের সরবরাহ তো কমছে না। এই পীড়িত মানুষগুলোর জন্য অর্থের বরাদ্দের ক্ষেত্রেই অনীহা দেখা যাচ্ছে। এটা অন্যায়ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ
আইএসসিজির দেওয়া তথ্যে খাতওয়ারি হিসাবে, গত ছয় মাসে জেআরপির প্রতিশ্রুত অর্থের সবচেয়ে বেশি পেয়েছে জীবনযাপন ও দক্ষতা উন্নয়ন খাত। তা–ও সেটি ৪৯ শতাংশ। কোনো অর্থই আসেনি সমন্বয় ও জরুরি টেলিযোগাযোগ খাতে। এরপর সবচেয়ে কম এসেছে স্বাস্থ্য খাতে। সেখানে মাত্র ২ শতাংশ অর্থের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। মাত্র ৪ শতাংশ চাহিদা পূরণ হয়েছে পানি ও স্যানিটেশন খাতে। খাদ্যচাহিদার ৩২ শতাংশ অর্থ পাওয়া গেছে।
দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে। গত বছরও রোহিঙ্গা শিবিরে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছিল। কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরের ডেঙ্গু আক্রান্তদের তথ্য নেই। সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী, এ বছর এক হাজারের বেশি রোহিঙ্গা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, এখন রোহিঙ্গা শিবিরে জোর তৎপরতা দরকার। বরাদ্দ কমে যাওয়ায় সেখানে ডেঙ্গুজনিত স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে।
জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের ডেপুটি হাইকমিশনার কেলি টি ক্লেমেন্টস চার দিন বাংলাদেশ সফর করে ৫ জুন একটি বিবৃতি দেন। সেখানে তিনি বলেন, শিবিরে বসবাসকারী রোহিঙ্গারা তাদের মৌলিক চাহিদার জন্য মানবিক সাহায্যের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। তারপরও এই সহায়তার জন্য ন্যূনতম তহবিলও এখন পাওয়া যাচ্ছে না। মানবিক সংস্থাগুলো এখন বাধ্য হচ্ছে শুধু বেশি গুরুত্বপূর্ণ চাহিদাগুলো চিহ্নিত করে কাজ করতে। এর ফলে অনেক মৌলিক চাহিদা অপূর্ণ থেকে যাচ্ছে। এর পরিণাম মারাত্মক।
চাহিদার তুলনায় রোহিঙ্গাদের সহায়তার ক্ষেত্রে ঘাটতিকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং মানবিক সংস্থাগুলোর চরম ব্যর্থতা হিসেবে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে সংকটের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু যুদ্ধের জন্য অস্ত্রের সরবরাহ তো কমছে না। এই পীড়িত মানুষগুলোর জন্য অর্থের বরাদ্দের ক্ষেত্রেই অনীহা দেখা যাচ্ছে। এটা অন্যায়।’