আজ বুধবার সকালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গুম করা নিয়ে অভিযোগ জানাতে যান মাইকেল চাকমা
আজ বুধবার সকালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গুম করা নিয়ে অভিযোগ জানাতে যান মাইকেল চাকমা

আমার গুমের জন্য শেখ হাসিনাই দায়ী, বললেন মাইকেল চাকমা

ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) সংগঠক মাইকেল চাকমা বলেছেন, ‘আমি মনে করি যে প্রতিহিংসার আমি শিকার হয়েছি, প্রধান আসামি হিসেবে আমার গুমের জন্য শেখ হাসিনাকেই দায়ী করছি। তাঁর সঙ্গে আরও যারা জড়িত ছিল, তাঁকে যারা সহযোগিতা করেছে তাঁদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ দেব। লিখিত অভিযোগে বিস্তারিত দেওয়া হবে।’

আজ বুধবার সকালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তাঁকে (মাইকেল চাকমা) গুম করা নিয়ে অভিযোগ জানাতে গিয়ে মাইকেল চাকমা সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন। মাইকেল চাকমা ২০১৯ সালের ৯ এপ্রিল নিখোঁজ হয়েছিলেন।

মাইকেল চাকমা পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারা দেশের সব জাতিসত্তার মানুষের মুক্তি ও গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ে রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় ছিলেন। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের পতনের দুদিন পর ৭ আগস্ট চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি সড়কের একটি স্থানে তাঁকে চোখ বাঁধা অবস্থায় ছেড়ে দেওয়া হয়।

মাইকেল চাকমা আরও বলেন, ‘জিজ্ঞাসাবাদে তিনবার একটি বিষয় আমাকে বলেছে, পার্বত্য চুক্তি কেন গ্রহণ করতে পারিনি? চুক্তি গ্রহণ না করা মানে সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে না পারা। চুক্তি (পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি) যেহেতু সরকারের সঙ্গে জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সঙ্গে হয়েছে সুতরাং চুক্তির বিরোধিতা করা মানে রাষ্ট্রবিরোধী অপরাধ—এমন বলেছে আমাকে।’

মাইকেল চাকমা আরও বলেন, ‘আমি কী গ্রহণ করব, না করব এর অধিকার আছে। মূলত শেখ হাসিনা যে খুন গুম করে মানুষের প্রতিবাদ-প্রতিরোধ ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য, আজীবন ক্ষমতায় থাকার জন্য এগুলো করেছেন।’ তবে কারা গুম করেছিল, তাদের পরিচয়, চেহারা জানতে পারেননি। প্রশ্ন করাও বারণ ছিল বলে জানান তিনি।

গুম করার ঘটনা বর্ণনা করে মাইকেল চাকমা বলেন, ঢাকার কল্যাণপুরে একটা জায়গায় গিয়েছিলেন। সেখানে পেছন থেকে একজন তাঁর নাম ধরে ডাকেন। তিনি তাকাতেই কয়েকজন মিলে তাঁর জামার কলার, কোমরের বেল্ট ও হাত ধরে ফেলেন। তাৎক্ষণিক একজন মুঠোফোনে গাড়ি ডাকেন। দ্রুত গাড়ি চলে আসে এবং তাঁকে ওই গাড়িতে (মাইক্রোবাসে) তোলা হয়।

গাড়িতে তুলেই হাতে হাতকড়া এবং চোখ কালো কাপড়ে বাঁধা হয় জানিয়ে মাইকেল বলেন, চোখ বাঁধার আগে চালকের পাশের আসনে একটি ওয়াকিটকি তিনি দেখেছিলেন। পেছনের আসনে কয়েকটি বাটন মোবাইলও দেখেন। পরে ঘণ্টাখানেক যাত্রা করে তাঁকে একটি স্থানে নেওয়া হয়। সেখানে এক রাত রেখে আরেক জায়গায় নেওয়া হয়। সেখানেই তিনি পাঁচ বছর তিন মাস ২৭ দিন ছিলেন বলেও জানান।

মাইকেল চাকমা আরও বলেন, শেখ হাসিনা ২০১৩ সালে খাগড়াছড়িতে একটি নির্বাচনী সমাবেশে গিয়েছিলেন। সেদিন তাঁদের ছাত্র সংগঠনের একটি অবরোধ ছিল। সমাবেশ দুইটায় শুরুর কথা থাকলেও অবরোধের কারণে দুই ঘণ্টা দেরিতে বিকেল চারটার দিকে শুরু হয়। সেই সমাবেশের বক্তব্যে শেখ হাসিনা অবরোধ পালনকারীদের দেখে নেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন।

মাইকেল চাকমার মৌখিক অভিযোগ নেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, গোপন কারাগার, যেটা বহুল আলোচিত গোপন বন্দীশালায় মাইকেলকে আটক রাখা হয়েছিল। তাঁকে যে গুম করা হয়, সেই গুমের ধরন, তাঁকে যেভাবে রাখা হয়েছিল—সেসব তিনি মৌখিক আকারে জানিয়েছেন। ওনার বক্তব্য থেকে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, গত সরকারের আমলে পদ্ধতিগতভাবে যে গুম করা হতো, এর শিকার তিনি হয়েছিলেন। একই বক্তব্য তিনি গুম কমিশনের কাছেও দিয়েছেন।

চিফ প্রসিকিউটর বলেন, যেহেতু এটা আন্তর্জাতিক আইনে একটি অপরাধ। সেই অপরাধের বিচার চাইতে তিনি এখানে এসেছেন। সবকিছু মিলে তাঁর মৌখিক অভিযোগ আমলে নিচ্ছি। এসব বিষয়ে তাঁরা তদন্ত করবেন এবং বিচারের জন্য আদালতের কাছে উপস্থাপন করবেন। তিনি আরও বলেন, আজকে তিনি কোনো লিখিত বক্তব্য নিয়ে আসেননি। মৌখিকভাবে যেটা দিয়েছেন সেটাই আমরা আমলে গ্রহণ করছি। কয়েক দিনের মধ্যে গুছিয়ে লিখে বিস্তারিত তথ্য দেবেন। ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের কাছে তিনি মৌখিকভাবে যে অভিযোগ করেছেন সেটাই আমলে নিচ্ছি। সেটাকে সূত্র ধরেই আমাদের তদন্ত শুরু করা হবে।

মাইকেল যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছেন, তাদের অধিকাংশের বিরুদ্ধেই মামলা চলমান রয়েছে। তবে অতিরিক্ত কারও সন্ধান পেলে তদন্ত করা হবে। দেশের সব গুমের মূলত একটা সূত্র ধরেই তদন্ত করা হচ্ছে। প্রয়োজনে পৃথকভাবে তদন্ত করা হবে বলেও জানান তিনি।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মাইকেল চাকমার সঙ্গে বাংলাদেশের আলোকচিত্রী ও মানবাধিকারকর্মী শহিদুল আলম, তাঁর স্ত্রী রেহনুমা আহমেদ এবং ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর আবদুল্লাহ আল নোমান প্রমুখ ছিলেন।