রেলের চালকসহ ‘রানিং স্টাফরা’ মাইলেজ জটিলতায় আট ঘণ্টার বাড়তি দায়িত্ব পালন থেকে বিরত রয়েছে। তাঁদের এই সিদ্ধান্তের কারণে বিপাকে পড়েছে রেলওয়ে। যাত্রীবাহী আন্তনগর ট্রেনগুলো চললেও গত রোববার থেকে চট্টগ্রাম থেকে সারা দেশে পণ্যবাহী ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে। ফলে সড়কপথে পণ্য আনা-নেওয়ার খরচ বেড়ে যাবে।
রেলওয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, চালকসংকটের কারণে অনেক দিন ধরে ট্রেনে করে পণ্য পরিবহন পরিচালনা করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এর মধ্যে চালকদের বাড়তি কাজ না করার সিদ্ধান্তে নতুন করে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে।
রানিং স্টাফ বলতে ট্রেনের চালক, সহকারী চালক, গার্ড ও টিকিট পরিদর্শকদের (টিটি) বোঝানো হয়। তাঁরা ১৬০ বছর ধরে মাইলেজ সুবিধা (রানিং অ্যালাউন্স) পাচ্ছিলেন। অর্থাৎ দৈনিক আট ঘণ্টার বেশি কাজ করলে মূল বেতনের হিসেবে বাড়তি অর্থ পেতেন। এ ছাড়া অবসরকালীন ভাতায়ও এ জন্য বাড়তি অর্থ পেতেন তাঁরা।
কিন্তু এই পদ্ধতিতে পেনশন দেওয়ার সুযোগ নেই জানিয়ে গত ১৮ জুন রেল মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। ওই চিঠিতে বলা হয়, অর্থ বিভাগের সম্মতি ছাড়া মহাপরিচালকের মাধ্যমে পেনশন পরিশোধবিষয়ক আদেশ জারি রেলওয়ের এখতিয়ারবহির্ভূত। তাই রানিং অ্যালাউন্স যোগ করে পেনশন ও আনুতোষিক সুবিধা দেওয়ার যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, তা অর্থ বিভাগের মূল আদেশের পরিপন্থী। এই নির্দেশনা আদেশ বাতিলযোগ্য।
রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলে রানিং স্টাফের পদ রয়েছে প্রায় ১ হাজার ৭০০টি। কিন্তু এর বিপরীতে কর্মরত আছেন ৯০০ জন। প্রায় অর্ধেক পদ শূন্য থাকায় বিদ্যমান জনবলকে বাড়তি সময় দায়িত্ব পালন করতে হয়।
এই চিঠির বিষয়ে জানাজানি হওয়ার পর রোববার থেকে রেলের রানিং স্টাফরা আট ঘণ্টার বাড়তি দায়িত্ব পালন বন্ধ করে দেন। রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলে রানিং স্টাফের পদ রয়েছে প্রায় ১ হাজার ৭০০টি। কিন্তু এর বিপরীতে কর্মরত আছেন ৯০০ জন। প্রায় অর্ধেক পদ শূন্য থাকায় বিদ্যমান জনবলকে বাড়তি সময় দায়িত্ব পালন করতে হয়।
গত বছরের ১০ এপ্রিল অর্থ বিভাগ রেলওয়ের রানিং স্টাফদের মূল বেতনের সঙ্গে রানিং অ্যালাউন্স যোগ করে পেনশন ও আনুতোষিক প্রদানের প্রস্তাব খারিজ করে দিয়েছিল। এর প্রতিবাদে ওই বছরের ১৩ এপ্রিল সারা দেশে রানিং স্টাফরা ধর্মঘট আহ্বান করলে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পরে রেলমন্ত্রীর আশ্বাসের পর ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হয়।
রেলওয়ের তথ্য অনুযায়ী, চলতি মাসে চট্টগ্রামের হালিশহরে সিজিপিওয়াই (চট্টগ্রাম গুডস পোর্ট ইয়ার্ড) থেকে ঢাকার কমলাপুরে আইসিডি (ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো) পর্যন্ত ৫৪টি কনটেইনার ট্রেন চলাচল করেছে। এর মধ্যে ১৯টি ট্রেনই বিলম্বে পৌঁছেছে। সর্বনিম্ন এক থেকে সর্বোচ্চ আট ঘণ্টা পর্যন্ত দেরি হয়েছে। চালকসংকটের কারণে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এভাবে বাড়তি সময় লাগায় চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনারের জট লাগছে।
রেলওয়ে সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, এই অবস্থা চলতে থাকলে আমদানি ও রপ্তানিকারকেরা ট্রেনের মাধ্যমে কনটেইনার পরিবহনে উৎসাহ হারাবেন। এতে রেলের আয় যেমন কমবে, তেমনি দেশের বাণিজ্য ও উৎপাদনমুখী শিল্পকারখানার ওপর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ট্রেন চলাচলে বাড়তি সময় কমানোর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
ট্রেনে করে পণ্য পরিবহনের খরচ তুলনামূলকভাবে কম। এখন তা বন্ধ হয়ে গেলে সড়কপথে পণ্য আনা-নেওয়ার খরচ বেড়ে যাবে, যা শেষ পর্যন্ত ভোক্তাদের কাঁধে চাপবে।মাহবুবুল আলম, চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি
চট্টগ্রামের সিজিপিওয়াই থেকে পণ্যবাহী ট্রেনগুলো ঢাকার কমলাপুর আইসিডিসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। চট্টগ্রাম বন্দরের জেটি থেকে বিভিন্ন ধরনের পণ্যবাহী (বিভিন্ন ধরনের খাদ্যশস্য, পোশাক কারখানার পণ্য, পাথর, সার) কনটেইনার এবং নগরের পতেঙ্গা এলাকায় অবস্থিত তেল শোধনাগার থেকে জ্বালানিবাহী ওয়াগন প্রথমে সিজিপিওয়াইয়ে নিয়ে আসা হয়। এরপর তা দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হয়। সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এই পণ্যবাহী ট্রেনের সুবিধা নিয়ে থাকে।
রেলওয়ের রানিং স্টাফ ও শ্রমিক কর্মচারী সমিতির সভাপতি রফিক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, রানিং স্টাফের পদগুলোয় যে পরিমাণ জনবল থাকা দরকার, আছে তার অর্ধেক। তাই তাঁরা বাড়তি দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। এ জন্য মাইলেজ ভাতা (রানিং অ্যালাউন্স) দেওয়া হতো। কিন্তু এখন তা বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। এই মাইলেজ ভাতা ১৮৬২ সাল থেকে দেওয়া হচ্ছে। মাইলেজ ভাতা না দিলে লোকোমাস্টাররা (চালক) কেন বাড়তি কাজ করবেন? তাঁরা এখন থেকে ৮ ঘণ্টা ডিউটি করবেন।
রানিং স্টাফরা দৈনিক আট ঘণ্টার বেশি কাজ করলে বেসিকের হিসেবে বাড়তি অর্থ পেতেন। এ ছাড়া অবসরের পর বেসিকের সঙ্গে এর ৭৫ শতাংশ অর্থ যোগ করে অবসরকালীন অর্থের হিসাব হতো।
চলাচল করছে না লোকাল ট্রেনও
চালক না থাকায় চট্টগ্রাম স্টেশন থেকে নাজিরহাট ও দোহাজারীগামী লোকাল ট্রেনগুলোও চালাতে পারছে না রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। এই দুটি রুটে প্রতিদিন দুই জোড়া করে মোট চার জোড়া ট্রেন চলাচল করে। রোববার থেকে ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকায় বিপাকে পড়েছেন যাত্রীরা।
রেল বন্ধ হলে পণ্য আনা-নেওয়ার খরচ বাড়বে
ট্রেনে পণ্য পরিবহন বন্ধ হয়ে গেলে সড়কপথে পণ্য আনা-নেওয়ার খরচ বেড়ে যাবে বলে উল্লেখ করেন চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এই বাড়তি খরচের বোঝা শেষ পর্যন্ত ভোক্তাদের কাঁধে চাপবে। তাই রেলের চালকদের দাবি বিবেচনায় নিয়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি দ্রুত সমাধান করা প্রয়োজন বলে মনে করেন ব্যবসায়ী মাহবুবুল আলম।
রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, মাইলেজ ভাতা নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হওয়ায় পরিস্থিতি একটু খারাপ হয়েছে। চালকের অভাবে পণ্যবাহী ট্রেন চলাচল কার্যত বন্ধ হয়ে আছে। চললেও অনেক স্টেশনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকছে। লোকাল ট্রেনও চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। বিষয়টি সমাধান করার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কাজ করে যাচ্ছে।