প্রতিদিন মোসলেহ উদ্দিনের ছুটি হয় বিকেল পাঁচটায়। গতকাল শনিবার অফিসের গাড়িটা মেরামত করা দরকার ছিল। তাই বিকেল সোয়া চারটার দিকে বেরিয়ে যান। এর ১০ মিনিট পরই ভয়াবহ বিস্ফোরণ হয় কারখানায়।
মোসলেহ উদ্দিন বলেন, ‘আমিও হয়তো আর বেঁচে না–ও থাকতে পারতাম। অফিস ছুটির আগেই বের হয়ে যাওয়ায় বেঁচে গেছি। কিন্তু যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের জন্য কষ্ট হচ্ছে। এত দিন একসঙ্গে কাজ করলাম। মুহূর্তের মধ্যে তাঁরা আজ আমাদের মাঝে নেই।’
গতকাল বিকেলে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার কদমরসুল এলাকায় সীমা অক্সিজেন লিমিটেড কারখানায় ভয়াবহ বিস্ফোরণ হয়। এতে নিহত হয়েছেন ছয়জন। গুরুতর আহত ২৫ জন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
আজ রোববার সকালেই কারখানায় ছুটে আসেন গাড়িচালক মোসলেহ উদ্দিন। তিনি প্রায় পাঁচ বছর ধরে কারখানাটিতে চাকরি করছেন।
কারখানার প্রধান ফটকের সামনে কথা হয় মোসলেহ উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, যখন বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে, তিনি তখন ভাটিয়রীর একটি ওয়ার্কশপে গাড়ি মেরামতের কাজ তদারক করছিলেন। তখন কারখানা থেকে একজন শ্রমিক ফোন করে বলেন, কারখানার তত্ত্বাবধায়ক মো. আজাদের অবস্থা খুব খারাপ। তাঁকে হাসপাতালে যেতে বলেন। মোসলেহ উদ্দিন ভেবেছিলেন মো. আজাদ সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন। কিন্তু হাসপাতালে গিয়ে যে পরিস্থিতি দেখেছেন, তা কল্পনাও করতে পারেননি। সেখানেই জানতে পারেন ভয়াবহ বিস্ফোরণের কথা।
নিরাপত্তারক্ষী জালাল আহমেদ আর সেলিম উদ্দিনের গল্পটা আলাদা। তাঁদের অফিস ছিল বেলা দুইটা পর্যন্ত। তাই কাজ শেষ করেই বাড়ি চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু আজ সকালে কারখানায় এসে পরিস্থিতি দেখে হতভম্ব দুজনই।
৫৫ বছর বয়সী জালাল আহমেদ বলেন, বিকেলেই বাড়িতে বসে কারখানায় বিস্ফোরণের কথা শুনেছিলেন। কিন্তু এমনভাবে সব বিধ্বস্ত হয়ে যাবে, তা কল্পনাও করিনি। সব শেষ হয়ে গেছে।
একই কথা বলেন নিরাপত্তারক্ষী সেলিম উদ্দিন। তিনি বলেন, তাঁদের কারখানার সবকিছু তছনছ হয়ে গেছে। বিস্ফোরণে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের জন্য আফসোসের সীমা নেই দুজনের। আর এখন এই দুই নিরাপত্তারক্ষী দুশ্চিন্তায় আছেন ভবিষ্যতের রুটিরুজি নিয়ে।
এ কারখানায় একসময় গাড়িচালক ছিলেন মো. কামাল উদ্দিন। ১৬ বছর চাকরি করার পর ২০২০ সালে অবসরে যান। তবে সাবেক কর্মস্থলে বিস্ফোরণের ঘটনা শুনে ঘরে থাকতে পারেননি তিনি। আজ সকালে তাই ছুটে আসেন কারখানায়। এসে দেখেন, চাকরিজীবনে যে গাড়ি চালাতেন, তা বিস্ফোরণে বিধ্বস্ত হয়েছে। এই প্রতিবেদককে তা দেখিয়ে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন ৭২ বছর বয়সী কামাল উদ্দিন। প্রথম আলোকে বলেন, এই কারখানা থেকে আয় করে জীবন নির্বাহ করেছেন। সংসার চালিয়েছেন। আজ সেটি বিস্ফোরণে ধসে গেল।
ফেসবুকে বিকেলেই কারখানার খবর জেনেছিলেন কামাল উদ্দিন। কিন্তু কাজ থাকায় আসতে পারেননি। তাই আজ ঘুম থেকে উঠেই কারখানায় চলে আসেন। কারখানার এমন ভয়াবহ আর বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে মন খারাপ হয়ে গেছে।
বিএম ডিপোর বিস্ফোরণের বছর না ঘুরতেই আবারও ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটল চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে। শিল্পে ব্যবহৃত অক্সিজেন উৎপাদনের কারখানায় হঠাৎ বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে কারখানার আশপাশের অন্তত এক বর্গকিলোমিটার এলাকা। বিচ্ছিন্ন লোহার টুকরা ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। বিস্ফোরণস্থল থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার দূর পর্যন্ত উড়ে যায় লোহার পাত।
এর আগে গত বছরের ৪ জুন রাতে সীতাকুণ্ডের কেশবপুরে বিএম ডিপোয় আগুন থেকে ভয়াবহ বিস্ফোরণে নিহত হন ৫০ জন। এ কারখানা থেকে সীমা অক্সিজেন কারখানার দূরত্ব পৌনে এক কিলোমিটার।