ছাত্রলীগের দুই কেন্দ্রীয় নেতা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নেতাকে থানায় নিয়ে মারধরের ঘটনার চার দিনের মাথায় এসে পুলিশ বলছে, সাময়িক বরখাস্ত হওয়া এডিসি হারুন অর রশিদের ওপরই প্রথম হামলা হয়েছে। হামলা করেছেন রাষ্ট্রপতির সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) আজিজুল হক। তিনি সঙ্গে করে ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকেও নিয়ে গিয়েছিলেন।
এ ঘটনা নিয়ে রাষ্ট্রপতির এপিএস আজিজুল হক গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত মুখ খোলেননি। তবে তাঁর স্ত্রী ঢাকা মহানগর পুলিশের এডিসি (অতিরিক্ত উপকমিশনার) সানজিদা আফরিন ঘটনাটি নিয়ে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল আইকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। গতকাল চ্যানেল আইয়ের অনলাইনে প্রচারিত ওই সাক্ষাৎকারে সানজিদা বলেছেন, এডিসি হারুনকে তাঁর স্বামী আজিজুল মারধর করেছেন।
এদিকে শনিবার রাতে ছাত্রলীগের তিন নেতাকে থানায় নিয়ে মারধরের ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক। তিনি গতকাল দুপুরের পর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছাত্রলীগের এক নেতাকে দেখতে গিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেন।
ভুক্তভোগী ছাত্রলীগের নেতাদের অভিযোগ, রাষ্ট্রপতির এপিএস আজিজুল হক ওই দিন সন্ধ্যায় ছাত্রলীগের তিন নেতাকে ডেকে নেন। তিনি বারডেম হাসপাতালে তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে এডিসি হারুনকে দেখতে পেয়ে বাগ্বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন। পরে পুলিশ ডেকে ছাত্রলীগের নেতাদের শাহবাগ থানায় নিয়ে বেদম মারধর করা হয়। মারধরের শিকার ছাত্রলীগের নেতারা হলেন কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন, বিজ্ঞানবিষয়ক সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের সাধারণ সম্পাদক শরীফ আহমেদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান। তাঁদের মধ্যে গুরুতর আহত আনোয়ার হোসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসাধীন।
এ ঘটনায় সোমবার এডিসি হারুনকে সাময়িক বরখাস্ত করে পুলিশ অধিদপ্তরে সংযুক্ত করা হয়। গতকাল বরখাস্ত হারুনকে পুলিশের রংপুর রেঞ্জে সংযুক্ত করে আদেশ জারি হয়।
ঘটনার দিন (গত শনিবার) সন্ধ্যার পর বারডেমে কী হয়েছিল, সে বিষয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন-অর-রশীদ গতকাল সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। ডিবিপ্রধান বলেন, ‘এ ঘটনার সূত্রপাত যে কারণে হয়েছে, যিনি সূত্রপাত করেছেন, তিনিও একজন সরকারি কর্মকর্তা (রাষ্ট্রপতির এপিএস আজিজুল হক)। উনি আমাদের পুলিশের (এডিসি হারুন) ওপর হামলাটি করেছেন।’
ডিবিপ্রধানের ভাষ্য, ‘আজিজুল হক ইচ্ছা করলে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাতে পারতেন, অবহিত করতে পারতেন। অথবা তাঁর (জনপ্রশাসন) ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাতে পারতেন। সেটি না করে হাসপাতালের ভেতরে অসংখ্য মানুষের সামনে একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে ধাওয়া করা, তাঁর চশমা ভেঙে ফেলা, তাঁর ওপর আঘাত করা—এটা সঠিক করেছেন কি না, জানি না। তবে এটার তদন্ত হওয়া উচিত।’
ডিবিপ্রধানের এই বক্তব্য প্রসঙ্গে পরে ডিএমপি কমিশনার গণমাধ্যমকে বলেন, ‘হারুন এই তথ্য কোথায় পেল, হারুন বলতে পারবে।’
শনিবার রাতের ঘটনার নেপথ্যের কারণ হিসেবে রাষ্ট্রপতির এপিএস আজিজুল ও এডিসি হারুনের মধ্যে ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের বিষয়টি সামনে আসে। সেই দ্বন্দ্ব ছিল আজিজুলের স্ত্রী সানজিদাকে কেন্দ্র করে। প্রশাসন ক্যাডারের আজিজুল ও পুলিশের এডিসি হারুন দুজনই ৩১তম বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন।
সানজিদা আফরিন গতকাল ওই বেসরকারি চ্যানেলে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তিনি শনিবার (৯ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়েছিলেন।
চিকিৎসক দেখাতে সহকর্মী হিসেবে এডিসি হারুনের সহায়তা নেন তিনি। হঠাৎ তাঁর স্বামী আজিজুল হক কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে হাসপাতালে গিয়ে অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করেন। এডিসি হারুন ও তাঁকে মারধর করেন তাঁর স্বামী। সানজিদা আরও বলেন, তাঁর স্বামীর সঙ্গে থাকা কয়েকজন অসৎ উদ্দেশ্যে দুজনের (এডিসি হারুন ও সানজিদা) ভিডিও করেন। তাঁদের হাত থেকে বাঁচার জন্য এডিসি হারুন থানা-পুলিশকে খবর দেন। পরে পুলিশ এসে হারুনকে উদ্ধার করে।
আজিজুল ‘টোটালি আউট অব মাইন্ড’ ছিলেন উল্লেখ করে সানজিদা বলেন, ‘ইনটেনশন (উদ্দেশ্য) দেখে মনে হয়েছে, তাঁরা দুজনকে (হারুন ও সানজিদা) পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে একটা ভিডিও করতে চাচ্ছেন। পরবর্তী সময়ে তাঁরা সেটি ইউজ (ব্যবহার) করবেন একটি অসৎ উদ্দেশ্যের জন্য।’
সানজিদার এই বক্তব্য প্রসঙ্গে ডিএমপি কমিশনার গণমাধ্যমকে বলেন, সানজিদা এভাবে বক্তব্য দিয়ে থাকলে সেটা ঠিক করেননি। কারণ, কমিশনারের অনুমতি ছাড়া তিনি এভাবে বক্তব্য দিতে পারেন না।
ডিবিপ্রধান মোহাম্মদ হারুন-অর-রশীদ এবং সানজিদা আফরিনের বক্তব্যের বিষয়ে রাষ্ট্রপতির এপিএস আজিজুল হকের বক্তব্য জানতে মুঠোফোনে কল করা হলে তিনি ফোন ধরেননি। মুঠোফোন ও হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পাঠানো হলেও তিনি সাড়া দেননি। এর আগে গত রোববার ও সোমবারও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তিনি সাড়া দেননি।
তবে ওই ঘটনায় পুলিশের মারধরের শিকার হওয়া ছাত্রলীগের নেতা শরীফ আহমেদ গতকাল সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, এডিসি সানজিদার সাক্ষাৎকার তিনি দেখেছেন। খুবই অবাক হয়েছেন।
শরীফ আহমেদ বলেন, ‘আমরা সেদিন বারডেমে গিয়ে দেখি, বিষয়টি পারিবারিক। তখন আমরা কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করিনি। কাউকে মারধর তো প্রশ্নই আসে না। কারও ভিডিও আমরা করিনি।’
বিএসএমএমইউতে চিকিৎসাধীন ছাত্রলীগের আনোয়ার হোসেনকে (নাঈম) গতকাল দুপুরে দেখতে যান ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘সেদিন থানায় যা ঘটেছে, সে জন্য দুঃখ প্রকাশ করছি। এ ঘটনায় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা নাঈম (আনোয়ার হোসেন) আহত হয়েছেন। তাঁর শারীরিক অবস্থা ও চিকিৎসার খবর নিতে সহকর্মীদের নিয়ে হাসপাতালে এসেছি। এখনো তিনি বেশ অসুস্থ। সুস্থ হতে আরও একটু সময় লাগবে।’
মারধরের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি কাজ করছে জানিয়ে ডিএমপি কমিশনার বলেন, এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এডিসি হারুন অর রশিদকে সরকার সাময়িক বরখাস্ত করেছে। মারধরের ঘটনায় জড়িত আরেকজন কর্মকর্তা শাহবাগ থানার পরিদর্শক (অপারেশন) গোলাম মোস্তফাকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পর তাঁদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থাসহ অন্যান্য ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ঘটনায় কার কতটুকু দোষ, কে গিয়েছিল, কেন গিয়েছিল, সেটি নির্ণয় করা হবে।
এ ঘটনায় রোববার ডিএমপি তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি করে। দুই দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেওয়ার কথা থাকলেও কমিটি তা দিতে পারেনি। তদন্ত কমিটির একজন সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, দুই দিনে তদন্ত শেষ করা সম্ভব নয়। এ জন্য তাঁরা সময় বাড়ানোর আবেদন করবেন। তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে তাঁরা থানায় মারধরের সত্যতা পেয়েছেন। এর আগে বারডেম হাসপাতালে কী ঘটেছিল, সেটাও তদন্ত করে বের করা হবে।